রবিবার, ২৯ জুন ২০২৫ ।। ১৪ আষাঢ় ১৪৩২ ।। ৪ মহর্‌রম ১৪৪৭


পিআর পদ্ধতি কী? বাংলাদেশে এর সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ 

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

বর্তমান নির্বাচন ব্যবস্থার বিকল্প হিসেবে অনেকেই ‘পিআর’ বা Proportional Representation পদ্ধতির কথা বলছেন। এ পদ্ধতিতে প্রত্যেক দল তাদের প্রাপ্ত মোট ভোটের অনুপাতে সংসদে আসন পায়। একক প্রার্থী নয়, এখানে মূলত দলভিত্তিক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হয়। ফলে কোনো দলের ভোট হারিয়ে যায় না, বরং তার প্রতিফলন সরাসরি সংসদে দেখা যায়। 

পিআর পদ্ধতি কী?

পিআর পদ্ধতিতে (Proportional Representation) ভোটগ্রহণ হয় দলভিত্তিক। যে দল মোট ভোটের যত শতাংশ পাবে, সে দল তত শতাংশ আসন পাবে। এতে একটি এলাকার পরিবর্তে পুরো দেশকেই একটি একক ভোট এলাকা হিসেবে ধরা হয়। এর ফলে ছোট দল, সংখ্যালঘু ও প্রান্তিক গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হয়।

পিআর পদ্ধতির সুবিধাসমূহ

১. সকল দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়:
ছোট দলগুলোও পার্লামেন্টে জায়গা পেতে পারে, যার ফলে গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণ বাড়ে।
২. ভোটের সঠিক প্রতিফলন ঘটে:
কোনো ভোট ‘অপ্রয়োজনীয়’ হয় না। যার ফলে ভোটারদের মতামত সংসদে প্রতিফলিত হয়।
৩. সংখ্যালঘু ও ভিন্নমতের প্রতিনিধিত্ব বাড়ে:
এতে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ও সংখ্যালঘুরা তাদের কণ্ঠস্বর সংসদে তুলে ধরতে পারেন।
৪. রাজনৈতিক আপস ও সংলাপ উৎসাহিত হয়:
যেহেতু একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা কঠিন, তাই দলগুলোর মধ্যে জোট গঠন ও সমঝোতার প্রবণতা বাড়ে। রাজনৈতিক মেরুকরণ কমে আসে।

পিআর পদ্ধতির চ্যালেঞ্জ ও ঝুঁকি:

১. সরকার গঠনে জটিলতা:
অনেক সময় কোনো দল এককভাবে সরকার গঠন করতে পারে না। জোট গঠন কঠিন হয়ে পড়ে।
২. নীতিনির্ধারণে ধীরগতি:
একাধিক দল মিলে সরকার চালালে সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিলম্ব হয়।
৩. রাজনৈতিক অস্থিরতা:
জোট ভেঙে গেলে বারবার নির্বাচন দিতে হয়। এতে স্থিতিশীলতা ক্ষুণ্ন হয়।
৪. স্থানীয় প্রতিনিধিত্ব দুর্বল হয়:
নির্দিষ্ট এলাকার জনগণের সমস্যা সরাসরি সংসদে না পৌঁছাতে পারে।

বিশ্বের কোথায় কোথায় পিআর পদ্ধতি চালু আছে?

ইউরোপ মহাদেশ: নেদারল্যান্ডস, সুইডেন, ফিনল্যান্ড, বেলজিয়াম, জার্মানি (আংশিক)
এশিয়া মহাদেশ: ইসরায়েল, ইন্দোনেশিয়া, নেপাল
আফ্রিকা মহাদেশ: দক্ষিণ আফ্রিকা, নামিবিয়া
লাতিন আমেরিকা: ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা
উত্তর আমেরিকা: আংশিকভাবে কানাডা

পিআর পদ্ধতিতে ইসরায়েল:

ইসরায়েল একটি ক্লাসিক উদাহরণ, যেখানে পুরো দেশই একক ভোট এলাকা। যে দল মাত্র ৩.২৫% ভোট পায়, তারাও আসন পায়। এতে ছোট দলগুলো সবসময় সংসদে প্রবেশ করে। কিন্তু এ পদ্ধতির ফলে দেখা দেয় কিছু সমস্যাও—
১. দুর্বল জোট সরকার:
একক দল কখনোই সরকার গঠন করতে পারে না। প্রায়ই জোট ভেঙে যায়, ফলে ঘনঘন নির্বাচন হয়। (২০১৯-২০২২ সালে ৫ বার নির্বাচন!)
২. ছোট দলের অস্বাভাবিক প্রভাব:
ছোট দলগুলো ‘কিং-মেকার’ হয়ে উঠে, বড় দলগুলোকে জিম্মি করে তাদের দাবি আদায় করে নেয়।
৩. নীতিগত স্থবিরতা:
নানা দৃষ্টিভঙ্গির কারণে বড় সংস্কার নিতে দেরি হয় বা সম্ভব হয় না।
৪. ধর্মীয় চাপ:
ধর্মীয় ছোট দলগুলো আধুনিকতা ও নারী অধিকারের বিরোধিতা করে সরকারে চাপ তৈরি করে।
৫. জনগণের আস্থা হ্রাস:
ঘনঘন জোট পরিবর্তন ও রাজনৈতিক অস্থিরতায় জনগণের মধ্যে আস্থা কমে।

বাংলাদেশের জন্য কতটা উপযোগী?

বাংলাদেশে নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই বিতর্ক ও আস্থার সংকট রয়েছে। অনেক দল ভোটে অংশ নেয় না, কেউ কেউ অংশ নিলেও ফলাফল নিয়ে প্রশ্ন তোলে। এমতাবস্থায় পিআর পদ্ধতি কিছু সমাধান দিতে পারে যেমন: অংশগ্রহণমূলক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করা, সংখ্যালঘু ও ছোট দলের কণ্ঠস্বর শোনা, রাজনৈতিক মেরুকরণ কিছুটা কমানো।

তবে বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এখনো একক আধিপত্য ও ব্যক্তি-নির্ভরতায় গড়ে উঠেছে। পিআর পদ্ধতি চালুর আগে প্রয়োজন- রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সহনশীলতা, জোট গঠনের বাস্তব প্রস্তুতি, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন ব্যবস্থা।

পিআর পদ্ধতি নিঃসন্দেহে একটি অংশগ্রহণমূলক ও ন্যায্য নির্বাচন পদ্ধতি। তবে এটি কোনো যাদুর কাঠি নয়। সুষ্ঠু বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, সাংবিধানিক সংস্কার ও জনসচেতনতা। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিপক্বতা বিবেচনায় ধাপে ধাপে আংশিকভাবে পিআর পদ্ধতির পরীক্ষামূলক প্রয়োগ হতে পারে, যাতে করে ভবিষ্যতের জন্য একটি টেকসই ও ন্যায্য নির্বাচনী কাঠামো গড়ে তোলা যায়।

এমএইচ/


সম্পর্কিত খবর

সর্বশেষ সংবাদ