ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় বাস্তুচ্যুত গাজাবাসীদের জীবনের মানে হলো, ঘুমানোর জন্য কোনো গদি বা বালিশ নেই। গাজাবাসীর বালিশ হলো একমাত্র কাপড়ের ব্যাগ, যা নিয়ে অসহায় ব্যক্তিরা ঘর থেকে বের হয়েছিলেন। অস্বাস্থ্যকর অবস্থানে ঘুমানোর ফলে গাজাবাসীর ক্রমাগত পিঠ এবং পায়ে ব্যথা হয়। আবার প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় পেট ও গলা ব্যথা হয় এবং উদ্বেগের কারণে মাথা ব্যথাও বাড়ে।
গাজায় বাস্তচ্যুত হওয়া মানে পানি নেই। হাত ধোওয়া যাবে না, কাপড়ও ধোওয়া যাবে না। বাস্তুচ্যুত হওয়া মানে পান করার জন্য পরিষ্কার পানি নেই। দূষিত পানি পান করতে হবে।
পানি পান না করার কারণে গাজাবাসী মারাও যাচ্ছে।
বাস্তুচ্যুত হওয়া মানে বাথরুমে যেতে চাইলেও পালা না আসা পর্যন্ত একজন গাজাবাসীকে ৬০০ জনের পেছনে লাইনে অপেক্ষা করতে হচ্ছে। যখন পালা আসে তখন আরো ৫০০ জন লোক দরজায় কড়া নাড়ে। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে এসব বাথরুমে মোটেও পানি নেই।
বাস্তুচ্যুত হওয়া মানে রান্না করা খাবার নেই, রুটি নেই, শুধু কয়েকটি পনিরের বাক্স ছাড়া, যা গন্ধ ছড়াচ্ছে। কেউ পরিবারের জন্য রুটি আনতে বেকারিতে গেলে সাত ঘণ্টা ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য হয়। বেশির ভাগ সময় পালা আসার আগেই রুটি শেষ হয়ে যায়। আবার অপেক্ষাকালে বিমান হামলার শিকার না হওয়াটা পরম ভাগ্যের ব্যাপার।
বাস্তুচ্যুত হওয়া মানে এক রুটিকে কমপক্ষে চার ভাগ করতে হবে।
এক টুকরো রুটি মোটেও যথেষ্ট নয়। কিন্তু এই মুহূর্তে গাজায় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ‘তুমি খেয়েছ এবং এটি তোমার একটি দুর্দান্ত অর্জন।’
বাস্তুচ্যুত হওয়া মানে এক গাজাবাসীকে প্রতি মিনিটে ৩০ বার আকাশের দিকে তাকাতে তাকাতে ভাবতে হবে—‘আজ গাজায় একটি নতুন গণহত্যা ঘটবে এবং সর্বশেষ ব্রেকিং নিউজ অপেক্ষাকারী এবং তার পরিবার সম্পর্কে হবে।’
বাস্তুচ্যুত হওয়া মানে গোসল করা একটা স্বপ্ন। গাজায় এখন গোসল করা একটি গর্হিত বিলাসিতা। বাস্তুচ্যুত হওয়া মানে সব সময় চারপাশে বোমা হামলার শব্দ শুনতে পাবার পাশাপাশি দেখতেও পাওয়া। কিন্তু জানার উপায় নেই এসব বোমা কোথা থেকে আসছে।
বাস্তুচ্যুত হওয়া মানে বিদ্যুৎ নেই, মোবাইল ফোনে চার্জ নেই, কোনো কল বা মেসেজ নেই, ইন্টারনেট নেই, বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ নেই। এমনও হতে পারে, কেউ মারা গেলে পরিবারের কেউ জানতেও পারবে না যে আপনজনটি কখন মারা গেছে।
বাস্তুচ্যুত হওয়া মানে অবিরাম নিপীড়ন, উদ্বেগ, উত্তেজনা, অসহনীয় ক্ষুধা, ঘাম, যন্ত্রণা, ভ্রম, দুঃখ, অন্ধকার, প্রত্যাশা, শিশুদের জন্য ভয়, পরিবারের জন্য ভয়, বন্ধুদের জন্য ভয়, ভবিষ্যতের জন্য ভয়।
বাস্তবতা হচ্ছে, যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি গণহত্যার শেষ কোথায়, তা কেউ জানে না। এরই মধ্যে গাজার একটি বড় অংশ দখল করে নিয়েছে দখলদার বাহিনী। হত্যাযজ্ঞ ও দখলদারির মুখে বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এই স্থান দিন দিন মানুষের বসবাসের ‘অযোগ্য’ হয়ে পড়ছে। ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ মনে করছে, অবরুদ্ধ গাজায় ত্রাণ ঢোকার সুযোগ দেওয়া না হলে গাজাবাসীও গাজায় থাকতে চাইবে না।
ফ্রান্সভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ফাউন্ডেশন ফর স্ট্র্যাটেজিক রিসার্চের গবেষক অ্যাগনেস লেভালয়িসের ভাষ্য মতে, গাজাকে বসবাসের ‘অযোগ্য’ করে তোলাটাই ইসরায়েলের কৌশল। গাজার বড় অংশে নিরাপত্তা অঞ্চল সৃষ্টির পাশাপাশি তিনটি করিডর গড়ে তুলেছে ইসরায়েলি বাহিনী। সেগুলো হলো ফিলাডেলফি, মোরাগ ও নেতজারিম করিডর। এগুলো গাজাকে বিভিন্ন অংশে বিভক্ত করে ফেলেছে। গাজাবাসীর বাঁচার গ্যারান্টি নেই!
সূত্র : আল আহরাম
এসএকে/