সোমবার, ০৪ আগস্ট ২০২৫ ।। ২০ শ্রাবণ ১৪৩২ ।। ১০ সফর ১৪৪৭

শিরোনাম :

শায়খুল হিন্দ রহ.-এর বিশিষ্ট ছাত্র, খলীফায়ে থানভী মাওলানা মুহাম্মদ রামুভী রহ.

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার
হাফেজ মুহাম্মদ আবুল মঞ্জুর

হাফেজ মুহাম্মদ আবুল মঞ্জুর

মাওলানা মুহাম্মদ রামুভী রহ. দারুল উলুম দেওবন্দের প্রথম যামানার কৃতি ছাত্র। যিনি আযাদী আন্দোলনের সংগ্রামী সিপাহসালার, দারুল উলুম দেওবন্দের প্রথম ছাত্র ও পরবর্তী সময়ের শায়খুল হাদিস, শায়খুল হিন্দ আল্লামা মাহমুদুল হাসান দেওবন্দী রহ. এর স্নেহধন্য সরাসরি ছাত্র। সেই সাথে তিনি বিশ্বসমাদৃত মুহাদ্দিস আল্লামা আনওয়ার শাহ কাশ্মীরী রহ.-এর সহপাঠী ও বন্ধু।

ক্ষণজন্মা মনীষী মাওলানা মুহাম্মদ রহ. বাংলার ইতিহাসের অপ্রকাশিত এক সোনালী অধ্যায়। ইতিহাস- ঐতিহ্যসমৃদ্ধ প্রাচীন জনপদ কক্সবাজার জেলার রামু উপজেলার ভূমিপুত্র তিনি। এ উপজেলার দক্ষিণ মিঠাছড়ি ইউনিয়নের উমখালী গ্রামে এক বুনিয়াদি পরিবারে ১২৮৭ হিজরী সনে জন্মেছিলেন কীংবদন্তি এই মেধাবী ব্যক্তিত্ব। পিতা আইন উদ্দিন পণ্ডিতও ছিলেন একজন আলেম ও  কবি।

পিতা নিজের মেধাবী সন্তান মাওলানা মুহাম্মদ রামুভীকে ইলমে নববী আহরণের জন্যে বিশ্ববিখ্যাত ইসলামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দে ভর্তি করে দেন। সেখানে তিনি অসাধারণ মেধা ও বহুমাত্রিক প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন। তিনি অতি স্বল্পতম সময়ে পবিত্র কুরআন শরীফ হিফজ করে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপনে সক্ষম হন। 

তথাপি দারুল উলুম দেওবন্দের প্রথম দিকের কৃতি ছাত্র হিসেবে প্রতিটি স্তরে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হয়ে এই মেধাবী সন্তান বিদেশের মাটিতে দেশের ভাবমর্যাদা উজ্জ্বল করেন। এ বিষয়ে দেশের একজন প্রবীণ আলেম, সিলেটের শায়খুল হাদীস মাওলানা নুরুল ইসলাম খানের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, "একদিন আল্লামা আনওয়ার শাহ কাশ্মীরী রহ. সহপাঠী মাওলানা মুহাম্মদ রামুভী রহ. কে  বললেন, "মুহাম্মদ আজ থেকে গণনা করে ৩০ তম দিনে আমার কাছ থেকে পুরো বোখারী শরীফ মুখস্থ শুনবে।" এ কথা শুনে হযরত আনওয়ার শাহ কাশ্মীরাী রহ. কে মাওলানা মুহাম্মদ রহ. বললেন " আমার কাছ থেকে ২৯ তম দিনে তুমি পুরো বোখারী শরীফ মুখস্থ শুনবে।" ঠিকই ২৯ তম দিনে মাওলানা মুহাম্মদ রামুভী রহ.,  আর ৩০ তম দিনে আল্লামা আনওয়ার শাহ কাশ্মীরী রহ. পরস্পরকে পুরো বোখারী শরীফ মুখস্থ শুনিয়েছিলেন।"

নিবিষ্ট চিত্তে গভীর অধ্যাবসায়ে অভ্যস্ত মেধাবী শিক্ষার্থী মাওলানা মুহাম্মদ রহ, তাফসীর, হাদীস, ফিকহসহ প্রয়োজনীয় বিষয়ে বুৎপত্তি অর্জন করে দারুল উলুম  দেওবন্দ থেকে দাওরায়ে হাদিস ডিগ্রি লাভ করেন। প্রখর মেধাবী হওয়ায় তাঁকে মাদ্রাসায় অনেকে জ্বীনের পুত্র বলতেন। তবে তিনি বিশেষত মুহাম্মদ চাটগামী বা মুহাম্মদ মুহাম্মদ রামুভী নামেই অধিক প্রসিদ্ধ ছিলেন। 

আধ্যাত্মিক জগতেও মাওলানা মুহাম্মদ রহ. ছিলেন এক সফল ব্যক্তিত্ব। তিনি উপমহাদেশের প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ, বহু কিতাব রচয়িতা, হাকীমুল উম্মাত আল্লামা আশরাফ আলী থানভী রহ. এর সরাসরি খেলাফত লাভে ধন্য হন। বিদগ্ধ লেখক, বর্তমান সরকারের মুহতারাম ধর্ম উপদেষ্টা  ড.  আ. ফ. ম খালিদ হোসেন রচিত থানভী রহ. এর জীবনী গ্রন্থেও খলিফা হিসেবে ক্ষনজন্মা এই মনীষীর নাম রয়েছে। 

দেশের বিশিষ্ট ওলামায়েকেরাম সূত্রে জানা যায়, দেওবন্দের প্রথম শায়খুল হাদীস, শায়খুল হিন্দ আল্লামা মাহমুদুল হাসান দেওবন্দী রহ. নিজের অবর্তমানে সে পদে নিয়োগ দানের জন্য প্রথমেই আপন ছাত্র মাওলানা মুহাম্মদ রামুভী রহ. এর নাম প্রস্তাব করেছিলেন। যেখানে ক্রমান্বয়ে আল্লামা ওজীহুল্লাহ সন্দ্বিপী ও আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মিরী রহ. এর নামও ছিল। তবে কোন কারণে মাওলানা মুহাম্মদ রহ. ও ওজীহল্লাহ সন্দীপী রহ. দারুল উলুম দেওবন্দের শায়খুল হাদীস পদে যোগদানে অপরাগতা প্রকাশ করায় অবশেষে সে পদ অলঙ্কৃত করেছিলেন আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মীরী রহ.। 

ইসলামী সাহিত্যাঙ্গনের উজ্জ্বল নক্ষত্র, মাসিক মীদনা সম্পাদক মাওলানা মহিউদ্দীন খান রহ. লিখেছেন- "মাওলানা মুহাম্মদ রামুভীর নাম উপমহাদেশের হাদীস চর্চাকারীগণের প্রায় সবার নিকট সুবিদিত। প্রখ্যাত এই আলেমেদ্বীনসহ বহুসংখ্যক মুসলিম মনীষীদের পদভারে ধন্য হয়েছে রামুর মাটি। তাই সঙ্গত কারণেই রামুর মানুষের মধ্যে ঐতিহ্য প্রীতির সাথে একটি উদ্যমী চরিত্রও লক্ষ্য করা যায়। ( "মক্কা-মদীনার পথে" -রামু প্রবাসী কল্যাণ সংস্থা স্মারক '২০০৭ইং।)

কিংবদন্তী এ আলেমেদ্বীন দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে শিক্ষা সমাপ্ত করে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর, বৃটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামী মরহুম আব্দুল মজিদ সিকদারের সহযোগিতায় রামু চৌমুহনীতে রশিদিয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসা নামে একটি দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বুনিয়াদ স্থাপন করেন। যেখানে পড়াশোনা করে অনেক ছাত্র উচ্চতর পড়া-লেখার জন্য দারুল উলুম দেওবন্দে পাড়ি জমাতেন। তবে একটি কথা বদ্ধমুল ছিলো যে, বৃটিশ বিরোধী আযাদী আন্দোলনের ধারাকে বেগবান করার অভিপ্রায়ে ইলমে নববির আলোয় ঈমানি চেতনাদীপ্ত সৈনিক গড়ার মিশন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত দারুল উলুম দেওবন্দের শাখা হিসেবে এ ধারার মাদ্রাসাগুলোর প্রতিষ্ঠা। তাই মাওলানা মুহাম্মদ রহ. এর ওপর বৃটিশ গোয়েন্দাদের নজর পড়ে যাওয়ায় তিনি আর বেশিদিন স্থির থাকতে পারেননি। ফলে সে মাদ্রাসাও আর বেশিদিন স্থায়ীত্ব লাভ করেনি৷ তবে সে মাদ্রাসায় পড়ুয়া অনেকেই বিজ্ঞ আলিম হয়ে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। যাঁদের মধ্যে ভাষা সংগ্রামী রামুর মাওলানা আব্দুল্লাহ রহ. ও  জামেয়া দারুল উলুম চাকমারকুলের মুহাদ্দিস মাওলানা আব্দুল কাদের রহ. প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। 

কালের আবর্তনে এ মাদ্রাসার প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো বিলুপ্ত হয়ে গেলেও তাঁরই সুযোগ্য পুত্র মাওলানা আহমদ হাসান রহ.  এর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ১৯৩৫ ঈসায়ী সনে রামু জামেয়াতুল উলুম মাদ্রাসা নামে আরেকটি দ্বীনি শিক্ষাকেন্দ্র   গড়ে উঠে। যে মাদ্রাসা এখনো ইসলামী শিক্ষা বিস্তারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে চলেছে। 

প্রচারবিমুখ আধ্যাত্মিক মনীষী ও প্রথিতযশা আলিম  মাওলানা মুহাম্মদ রহ. আজীবন নিষ্ঠার সাথে মুরীদান, ভক্ত, অনুরক্ত, ও তৌহিদি জনতাকে দ্বীনের বিধি-বিধান শিক্ষা দেন। তাঁর দ্বীনি দাওয়াত রামু, কক্সবাজার হয়ে চকরিয়া, বাঁশখালী, আরকানের আকিয়াব, বার্মার বুচিদং পর্যন্ত বিস্তৃত ছিলো। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি আরকানের জুইফ্রাং রাজারবিল নামক এলাকায়ও একটি মাদ্রাসা গড়ে তুলেছিলেন বলে পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে। 

বাংলার কিংবদন্তী এ মনীষী আলেম আরকানের মাটিতেই চিরনিদ্রায় শায়িত হন। তিনি ১৩৩৪  হিজরীর যিলকদ মাসে আরকানে ইন্তেকাল করেন-ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। 

তাঁর সুযোগ্য উত্তরসূরীগনের অনেকেই মসজিদ-মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা, পরিচালনাসহ ইসলামী শিক্ষা-বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের রেখেছেন এবং এখনো রেখে চলেছেন। যাঁদের মধ্যে আপন সন্তান রামু জামেয়াতুল উলুম মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা আহমদ হাসান রহ., অপর সন্তান বিশিষ্ট মুনাযির মাওলানা রশিদ আহমদ সিদ্দিকী রহ. অন্যতম। 

উল্লেখ্য,  বাংলার প্রথিতযশা এ কীর্তিমান আলিমের পিতা কবি আইনুদ্দীন পণ্ডিত রচিত 'রত্নালাপ' ও ‘লোভোদ্যান’ নামক দু'টি পুঁথিকাব্য সমৃদ্ধ পাণ্ডুলিপি রয়েছে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়। এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম জামিয়া দারুল মা'আরিফ আল-ইসলামিয়ার বর্তমান মুদীর, প্রখ্যাত সাহত্যিক আল্লামা মুহাম্মদ ফুরকানুল্লাহ খলিল ( যিনি মাওলানা মুহাম্মদ রামুভী রহ. এর সুযোগ্য নাতি মাওলানা আমজাদ রাহী রহ. এর জামাতা)  লিখেছেন, 'আইনুদ্দীন পণ্ডিত ছিলেন, প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও কবি। তাঁর বিরচিত 'রত্নালাপ' ও 'লোভোদ্যান' শীর্ষক দু'টি পুঁথিগ্রন্থের পাণ্ডুলিপি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে গচ্ছিত রয়েছে বলে তাঁর নাতি মাওলানা রশীদ আহমদের ছেলে মাস্টার মুহাম্মদ উদ্দীন রহ. তথ্য প্রদান করেন। পাণ্ডুলিপি দু'টিতে তাঁর ও তাঁর বংশীয় অনেকের বিশেষতঃ তাঁর গুণধর ছেলে মাওলানা মুহাম্মদ রামুভী রহ. এর  সংক্ষিপ্ত পরিচিতি সন্নিবেশিত থাকতে পার বলেও তিনি ধারণা করেন। 

কবি আইনুদ্দীন পণ্ডিতের এই পাণ্ডুলিপি দু'টি তাঁর নাতি মাওলানা রশিদ আহমদ সিদ্দিকী (মাওলানা মুহাম্মদ রামুভী রহ. এর ছেলে) চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে জমা দেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন বাংলা বিভাগের প্রধান, বাংলা সাহিত্যের প্রবাদপুরুষ, জাতীয় অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান স্বাক্ষরিত একটি প্রাপ্তি স্বীকারপত্রও মাওলানা রশিদ আহমদ সিদ্দিকী রহ. বরাবরে পাঠানো হয়। যেখানে বিরল প্রতিভাধর এই ব্যক্তিত্বের রচিত, সমৃদ্ধ এই পাণ্ডুলিপি দু'টি বাংলা সাহিত্য ও ইতিহাস চর্চাকারীদের জন্য সহায়ক হিসেবে কাজে আসবে বলে অভিমত প্রকাশ করা হয়।  

আল্লাহ তা'আলা মাওলানা মুহাম্মদ রামুভী রহ. ও তাঁর পিতাসহ উত্তরসূরীগণের যাবতীয় দ্বীনি খেদমাত কবুল করুন। তাঁকে জান্নাতের সু-উচ্চ স্থানে সমাসীন করুন। আমিন।

তথ্য সূত্র:
১. হাকীমুল উম্মাত আল্লামা আশরাফ আলী থানভী রহ. এর জীবনীগ্রন্থ- ড. আ.ফ.ম খালিদ হোসেন।
২.মাওলানা মুহাম্মদ রামুভী রহ. এর সন্তান মাওলানা রশিদন আহমদ সিদ্দিকী রহ. এর দূর্লভ ডায়েরি। 
৩. মাওলানা আমজাদ রাহী রহ. এর জীবনালেখ্য- আল্লামা ফুরকানুল্লাহ খলীল। 

লেখক: যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক, কক্সবাজার ইসলামী সাহিত্য ও গবেষণা পরিষদ 

এমএইচ/


সম্পর্কিত খবর

সর্বশেষ সংবাদ