বৃহস্পতিবার, ০৯ মে ২০২৪ ।। ২৫ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১ জিলকদ ১৪৪৫


দেওবন্দের প্রথম মুহতামিম হযরত হাজী সাহেব রহ.-এর দেওবন্দ পরিচালনা

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

|| তাওহীদ আদনান ইয়াকুব ||

প্রথম পর্বের পর...

...দারুল উলুম দেওবন্দের প্রধান প্রবর্তক ও প্রতিষ্ঠাতা ছাড়াও তিনি ছিলেন দারুল উলুম দেওবন্দের মজলিস শুরার অন্যতম সদস্য এবং প্রথম মুহতামিম। দারুল উলুম দেওবন্দের পরিচালনার দায়িত্ব তার হাতে তিন তিনবার ন্যস্ত হয়। তিনি সর্বমোট দেওবন্দের মুহতামিম ছিলেন একে একে দশ বছর। শেষ পর্যন্ত অতি ব্যস্ততার কারণে তিনি পরিচলনা পদ থেকে চূড়ান্তভাবে ইস্তেফা গ্রহণ করেন।

আরো পড়ুন>>> দারুল উলুম দেওবন্দের প্রথম মুহতামিম হাজি সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ আবেদ হুসাইন রহ.

প্রথমবার প্রতিষ্ঠা দিবস ১৫ মুহররম ১২৮৩ হিজরি মোতাবেক ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১২৮৪ হিজরির রজব মোতাবেক ১৮৬৭ সাল পর্যন্ত মুহতামিম ছিলেন। ১২৮৪ হিজরিতে হজরত হাজী সাহেব হজে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। ফলে তখন একটি বড় ও বৈষয়িক ঘটনা ঘটেছিল যে, দেওবন্দের সমস্ত লোক এবং মাদ্রাসার উস্তাদ ও ছাত্ররা বলাবলি করা শুরু করে দিয়ছিল যে, এই প্রতিষ্ঠান এখন চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব। অর্থাৎ হাজী সাহেব হজে যাওয়ার দৃঢ় ইচ্ছা করে বসেছেন। আর তার অবস্থাভেদে মনে হচ্ছিল তিনি আর হিন্দুস্তান ফিরে আসবেন না। অপরদিকে আশেপাশের এলাকায় তাঁর প্রতি ভক্তি ও শ্রদ্ধা ছিল অত্যাধিক। তাঁর কারণেই ছাত্রদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়েছিল আসানীর সাথে এবং অনুদানও দেওয়া হতো খুব উৎসাহের সাথে। এখন যদি মনে হয় যে, তিনি আর এ প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় থাকবেন না তাহলে তো বিষয়টি সবার জন্য কষ্টকরই বটে। কারণ দেওবন্দের বাসিন্দাদের মধ্যে দৃশ্যত এমন কেউ ছিল না যিনি মাদরাসা পরিচালনার জন্য জান-প্রাণ দিয়ে মাঠে নামবেন। তাই সবার মুখে মুখে এই কথা প্রচলিত হয়ে গেলো যে, এখন আর এই প্রতিষ্ঠান চালু রাখা সম্ভব হবে না। দেখতে দেখতে হাজী সাহেব হজের সফরে চলেই যান। ফলে মজলিসে শুরা অপারগ হয়ে তার অনুপস্থিতে মাদরাসা পরিচালনার জন্য বিকল্প খুঁজতে বাধ্য হন। এক পর্যায়ে রুকনে শুরার মুখলিস ও বুযুর্গ সদস্যদের অন্তর ধাবিত হলো মাওলানা রফীউদ্দীন সাহেব রহ.-এর প্রতি। তারা যথাযোগ্য বিবেচনা করে ১২৮৪ হিজরির শাবান মাসে তাকে পরিচালনার দায়িত্ব অপর্ণ করেন।

দ্বিতীয়বার হযরত হাজী সাহেব রহ. হজ থেকে প্রত্যাবর্তনের পর ১২৮৬ হিজরি মোতাবেক ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে পুনরায় পরিচালনা পদে নিযুক্ত হন এবং ১২৮৮ হিজরি মোতাবেক ১৮৭১ সাল পর্যন্ত এই পদে অধিষ্ঠিত থাকেন। ১২৮৮ হিজরিতে দারুল উলুম দেওবন্দ পরিচালনার পাশাপাশি দেওবন্দ এলাকার জামে মসজিদের নির্মাণও হাজী সাহেব রহ.-এর তত্ত্বাবধানে হচ্ছিল। উভয় কাজের জন্য সময় ও অবসর প্রয়োজন ছিল অনেক। তাই হাজী সাহেব রহ.-এর কাজের বোঝা হালকা করণ ও কমানো ছিল অত্যন্ত জরুরি। তাই রুকনে শুরার মশওয়ারাক্রমে হুজুরকে কাজের সুবিধার্থে বিশ্রামের সুযোগ প্রদান করতঃ মাওলানা রফিউদ্দীন সাহেব রহ.-কে পুনরায় পরিচালনার দায়িত্ব ন্যস্ত করা হয়। তবে অতীব গুরুত্বপূর্ণ কাজের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে হাজী সাহেবকেই বহাল রাখা হয়।

তৃতীয়বার ১৩০৬ হিজরী মাওলানা রফিউদ্দীন সাহেব হজের সফরে গিয়ে সেখানেই বাকী জীবন কাটানোর নিয়ত করেন। ফলে আরাকিনে শুরা পুনরায় হাজী সাহেবকে দেওবন্দের মুহতামিম হওয়ার আবেদন করেন। ১৩০৬ হিজরির সংরক্ষিত রিপোর্টের সঙ্গে সংযুক্ত একটি এলান পাওয়া যায়। এলানের প্রতিটি শব্দ থেকে হাজী সাহেব রহ.-এর সম্মান ও মর্যাদা যথেষ্ট অনুমিত হয়। সেই এলানে লেখা ছিল:-

“পরসমাচার এই যে, মাদরাসায়ে ইসলামিয়্যাহ দেওবন্দের বর্তমান মুহতামিম জনাব মৌলভী মুহাম্মাদ রফিউদ্দীন সাহেব হজ্জ্বের নিয়তে মক্কা মুয়াজ্জমার পথে রওয়ানা হয়ে গেছেন। যেহেতু মাদরাসা পরিচালনার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো পরিচালনা পদ। আর পরিচালনার সুবিধার্থে বিক্ষিপ্ত বহু কার্যক্রম ন্যস্ত পরিচালকের হাতে। যেমন:- দরস ও তাদরিসের ব্যবস্থাপনা ও তত্ত্বাবধান, লেখা-পড়ার উন্নতি ও অগ্রগতি, ছাত্রদের খাদ্য ও পোশাক ব্যপস্থাপনা, দূর দূরান্ত থেকে আগত ছাত্রদের দেখভাল, মাদরাসার আয় ও ব্যয়ের যথাযথ হিসাব-কিতাব, মাদরাসা সংশ্লিষ্ট ছাত্র-উস্তাদ ও স্টাফগণের খরচাদি ইত্যাদি ইত্যাদি।

তাই বর্তমান মুহতামিম জনাব মৌলভী মুহাম্মাদ রফিউদ্দীন সাহেব হজ্জ্বের নিয়তে মক্কা মুয়াজ্জমার পথে রওয়ানা হয়ে চলে যাওয়ায় এবং সেখানেই বাকী জীবন কাটানোর নিয়ত করায় মাদরাসার সকল শুভাকাক্সক্ষী খুবই চিন্তিত ও বিচলিত। তাই অপারগতাবশত এই পরিকল্পনা ছাড়া আর কোন উপায় নেই যে, সকলের ঐকমত্যে হযরত হাজী সাহেবের সম্মুখে প্রস্তাব রাখতে হচ্ছে মাদরসার পরিচালনা পদটি পুনরায় গ্রহণ করার। (যিনি মাদরাসা প্রতিষ্ঠার প্রথম উদ্যোক্তা ও প্রবর্তক। প্রথম পরিচালক ও তত্ত্বাবধায়। পাশাপাশি আরাকিনে শুরার একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্যও বটে। দীর্ঘ সময় পর্যন্ত যিনি মাদরাসার পরিচালনা পদে অধিষ্ঠিতও ছিলেন। তিনি যখন হজ্জে চলে যান, তখন তার পরিবর্তে প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য মৌলভী রফিউদ্দীন সাহেবকে নিযুক্ত করা হয়। তিনি মাদরাসার হিসাব-কিতাব ও দৈনন্দিন কার্যক্রমসহ সবকিছু হযরত হাজী সাহেব রহ.-এর তত্ত্বাবধান, নির্দেশনা ও পরামর্শ মোতাবেকই পরিচালনা করতেন। মোটকথা মাদ্রাসার শুরু থেকে পরিচালনা সংক্রান্ত সকল বিষয়ে হাজী সাহেব রহ. যতটুকু অবগত অভিজ্ঞ অন্য কেউ ততটুকু অবগত অভিজ্ঞ নন। এমনকি মৌলভী রফিউদ্দীন সাহেবও নন।)

সকলে তার নিকট উপস্থিত হয়ে তাকে এই বলে অনুরোধ করতে থাকেন যে, এই মাদরাসা তো আপনারই হতে গড়া। এর পরিচালনার দায়িত্ব তো আপনারই। এক পর্যায়ে তিনি অনেকটা অনিচ্ছা সত্ত্বেও সকলের পিড়াপিড়িতে পুনরায় মাদরাসার মুহতামিমের পদ অলঙ্কৃত করেন। আল্লাহ পাকের অপার মহিমায় তিনি তার অনড় অবস্থা থেকে সরে আসেন। রহমাতুল্লিল আলামীন ﷺ -এর উপর অসংখ্যা অগণিত দরূদ ও মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ পাকের শুকুর ও কৃতজ্ঞতা যে, হাজী সাহেব রহ. সকলের অনুরোধে সায় দিয়েছেন। আল্লাহ পাক তাকে উত্তম জাযা দান করুন, আমীন”

সুতরাং তিনি তৃতীয়বারের মতো ১৩০৬ হিজরী মোতাবেক ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে পুনরায় দেওবন্দের মুহতামিম পদে অধিষ্ঠিত হন এবং ১৩১০ হিজরীর শাবান মোতাবেক ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এ পদে বহাল থাকেন। ২৩ জুমাদাল উলা ১৩০৬ হিজরির প্রদত্ত এই এলানে তৎকালীন সমস্ত রুকনে শুরার স্বাক্ষর ছিল। তন্মধ্যে অন্যতম হলেন, হযরত মাওলানা রশীদ আহমাদ গাঙ্গুহী রহ., মাওলানা জিয়াউদ্দীন রামপুরী রহ., মুশতাক আহমাদ দেওবন্দী রহ., যুল ফিকার আলী দেওবন্দী রহ., মুহাম্মাদ ফজলুর রহমান দেওবন্দী রহ. ও মুহাম্মাদ ফজল হক দেওবন্দী রহ.। সর্বশেষ ১৩১০ হিজরিতে এসে হযরত হাজী সাহেব রহ.-এর ব্যস্ততা অনেক অনেক বৃদ্ধি পেয়ে যায়। ফলে তিনি পরিচালনার পদ অন্য কারো হাতে ন্যস্ত করে দিতে চান। ফলে হাজী মুহাম্মাদ ফজল হক দেওবন্দী রহ.-কে মুহতামিম নিযুক্ত করা হয় এবং তিনি স্থায়ীভাবে ইস্তফা গ্রহণ করেন।

১৩১০ হিজরিতে তখন আরেকটি এলান প্রকাশিত হয়। সেই এলানের ভাষ্য ছিল নিম্নরূপ:

হযরত হাজী মুহম্মদ আবিদ হুসাইন সাহেব’র নিকট দূর-দূরান্ত থেকে তাঁর সাক্ষাত ও দোয়া প্রত্যাশী হয়ে সমস্যার সমাধান ও রোগ-বালাই থেকে মুক্তির জন্য ঝাড়-ফুঁক নিতে আসা ব্যক্তিদের সময় প্রদানসহ আরো নানাবিধ খেদমতে খলকে আত্মনিয়োগের দরুন সীমাহীন ব্যস্ততায় থাকতে হয় এমনকি তার উত্তম আখলাকের দরুন সকলকেই তিনি যথাযথ সময় প্রদান করতে যারপরনাই সচেষ্ট থাকেন ফলে মাদরসা সংশ্লিষ্ট কাজগুলো আঞ্জাম দিতে গিয়ে তাকে সীমাহীন কষ্টের মুখোমুখী হতে হতো ফলে তিনি মাদরাসার দায়িত্বসমূহ হাজী ফজল হক সাহেবকে অর্পণ করাই সঙ্গত মনে করলেন, যিনি মাদরাসার একজন সদস্য এবং ইতিপূর্বে দীর্ঘ সময় এ মাদরাসা পরিচালনাও করেছিলেন। আর তিনি কেবল শুরার সদস্যদের সাথে যুক্ত থাকাই মুনাসেব মনে করলেন। আহলে শুরা বিষয়টির যুক্তিকতা বিবেচনায় নিয়ে তার আবেদন গ্রহণ করে নিলেন।

ইন্তেকাল: ২৭ জিলহজ্জ ১৩৩১ হিজরী মোতাবক ২৭ নভেম্বর ১৯১৩ ঈসায়ী রোজ বৃহস্পতিবার ৮১ বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন। দারুল উলূম দেওবন্দের উত্তরে কাসমী কবরস্থানের উত্তর-পূর্ব দিকের একটি এরিয়া সমাহিত হন, যা তার নামানুসারে আবেদী কবরস্তান নামে পরিচিত।

লেখক: ফাযেলে দারুল উলুম দেওবন্দ ও নদওয়াতুল উলামা লাখনৌ; মুহাদ্দিস, আল-মাদরাসাতুল ইসলামিয়্যাহ আল-ক্বওমিয়্যাহ শরীয়তপুর

কেএল/


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ