আনসারুল হক ইমরান
প্রায় পাঁচ দশক ধরে লালবাগ মাদরাসায় হাদিসের খেদমতে নিয়োজিত ছিলেন উস্তাদে মুহতারাম মাওলানা আব্দুর রহিম রহ.। সমসাময়িক অনেকেই দ্বীনি খেদমতের পাশাপাশি ঢাকায় স্থায়ী নিবাস গড়ে তুললেও তিনি এসবের প্রতি কখনো ভ্রুক্ষেপ করেননি। আজীবন মাদরাসার কামরাই ছিল তাঁর ঠিকানা। সন্তানদেরও গড়ে তুলেছেন নববী শিক্ষার আলোকে। মাঝে মাঝে কুমিল্লার বরুড়ার গ্রামের বাড়িতে যেতেন, সেখানে গ্রামের মাদরাসার খেদমত ও তত্ত্বাবধানে নিজেকে নিয়োজিত রাখতেন।
ছাত্রদের কিতাব পড়াতেন হাসিমুখে। কারও মধ্যে শরীয়তবিরোধী কিছু দেখলে রাগ নয়, বরং স্নেহ ও প্রজ্ঞার সাথে বুঝিয়ে দিতেন। সহজে রাগ করতেন না; আর কখনো রাগ করলেও মুখে নূরানি হাসির ঝলক লেগেই থাকত। জীবনে কোনো ছাত্রকে মার তো দূরের কথা, তাদের উদ্দেশ্য করে জোরে কথা বলতেও দেখিনি।
হুজুর এমনিতেই ছিলেন লাল টুকটুকে সুন্দর চেহারার অধিকারী। এর সাথে যুক্ত হয়েছিল দীর্ঘ ইলমি তাজরেবা ও আত্মিক পরিশুদ্ধতা—যা মিলেমিশে তৈরি করেছিল এক অনন্য নূরানি আকর্ষণ। তাঁকে দেখলেই মনে হতো, তিনি শুধু ছাত্র গড়ার কারিগর নন; একজন অতি আপন অভিভাবক।
২৭ ডিসেম্বর গাজীপুর খালেকিয়া মাদরাসার মাহফিলে তিনি ছাত্রদের পাগড়ি প্রদান করেন এবং গুরুত্বপূর্ণ নছীহত পেশ করেন। ২৮ ডিসেম্বর, রবিবার, লালবাগ মাদরাসায় ছাত্রদের দরস দেন।মাদরাসার অফিসের হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করেন। জোহর ও আসর নামায মসজিদে জামায়াতের সাথে আদায় করেন।
মাগরিবের আগে লালবাগ মাদ্রাসার উস্তাদ ছেলে মাওলানা ফরিদ আহমদকে জানান শরীর কিছুটা দুর্বল লাগছে। তিনি পিতাকে মাদরাসার কক্ষে নামায পড়ার পরামর্শ দিয়ে নিজে মসজিদে ইমামতির জন্য চলে যান। হুজুর রুমেই মাগরিবের নামায আদায় করেন। নামায শেষে তাসবীহ-তাহলীল পাঠ করতে থাকেন। হঠাৎ খাদেমকে বলেন শরীরটা ভালো লাগছে না, এরপর নামাযের বিছানায় শুয়ে পড়েন। খাদেম গরম পানি ও আদা দিয়ে কিছু একটা বানিয়ে আনেন। ফিরে এসে দেখেন হুজুর ঘুমাচ্ছেন। কয়েকবার ডাক দিয়েও সাড়া না পেয়ে গায়ে হাত দেন—শরীর ঠান্ডা। দ্রুত অন্যদের ডাকা হয়। তখনই নিশ্চিত হওয়া যায়, আল্লাহর এই খাস বান্দা আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে পরকালের স্থায়ী ঠিকানায় চলে গেছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
মুহূর্তেই খবর ছড়িয়ে পড়ে। জামেয়ার উস্তাদ, ছাত্র এবং বিভিন্ন স্থান থেকে আগত অনুরাগীদের ভিড়ে লালবাগ মাদরাসা ভারী হয়ে ওঠে। সবার মুখ বিষন্ন, চোখে অশ্রু।
শুনেছি, আল্লাহওয়ালাদের মৃ'ত্যু সুন্দর হয়—কিন্তু এত সুন্দর বিদায়ের দৃশ্য এই প্রথম দেখলাম। কোনো হাসপাতাল, কোনো শয্যা, কোনো চিকিৎসার ব্যস্ততা নয়। জীবনের শেষ দিনও তিনি ক্লাস নিয়েছেন, নিজের নামায নিজেই আদায় করেছেন। জিকির করতে করতেই তিনি রবের সান্নিধ্যে চলে গেছেন। এমন একজন বুযুর্গের ছাত্র হতে পেরে আমরা গর্বিত ও ধন্য।
মহান আল্লাহ তায়ালা উস্তাদে মুহতারাম মাওলানা আব্দুর রহিম রহ.-কে আপন মহিমায় জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করুন। আমীন।
লেখক: মাদরাসা শিক্ষক ও সমাজ সেবক
আরএইচ/