ফিয়াদ নওশাদ ইয়ামিন
সম্প্রতি দেশে একের পর এক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাসমূহ, বিশেষ করে আমদানি-রপ্তানির জন্য গুরুত্বপূর্ণ স্থানে আলাদাভাবে আগুন লাগার ঘটনা ঘটছে। বিশেষ করে চট্টগ্রামের গার্মেন্টস সেক্টর এবং পরবর্তীতে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আগুন লাগার পর স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠে এই আগুন কি শুধু দুর্ঘটনা, নাকি পরিকল্পিত নাশকতা? দেশের বিভিন্ন স্থাপনায় নাশকতার বিষয়ে ইতিমধ্যেই সতর্কবার্তা সরকারের বিভিন্ন মহলে পৌঁছেছে।
তবু আগাম সতর্কবার্তার পরও এই ঘটনা ঘটছে কার নিষ্ক্রিয়তার কারণে? শুধু দুর্ঘটনা বা অসাবধানতার কারণে কি একের পর এক স্থানে আগুন লাগা স্বাভাবিক? এর প্রভাব বিমান চলাচল, উৎপাদন, রপ্তানি, শ্রমিকদের নিরাপত্তা এবং সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের ওপরও বিরূপ। আমরা শুধু আগুনের দৃশ্য দেখছি, কিন্তু এর প্রভাব দেশের অর্থনীতিতে গভীর এবং সরাসরি। আগুনের কারণে শুধু ক্ষতির সম্মুখীন হয় না, বরং পরোক্ষ ক্ষতি অনেক বেশি। বিশেষ করে কারখানাগুলোতে আগুন লাগলে আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের মনে সঙ্কট সৃষ্টি হয়; তারা অর্ডার বাতিল করতে পারে, স্থানীয় প্রতিষ্ঠানকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করতে পারে এবং বাংলাদেশের শিল্প-অর্থনৈতিক সেক্টরকে আন্তর্জাতিক নজরে বিপদের মুখে দাঁড় করাতে পারে।
দেশে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়ে এই ইস্যুগুলো গুরুত্বপূর্ণ। আগুন যেখানে লাগছে, সেখানে আন্তর্জাতিক দৃষ্টি পড়ছে—মিরপুরের পোশাক কারখানা, চট্টগ্রামের ইপিজেড এবং ঢাকার বিমানবন্দর। আগুনের ফ্লেমের কালার, ধোঁয়ার ঘনত্ব, দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার ধরণ—সব কিছু একই রকম। সাধারণ আগুনে ফায়ার ফাইটারদের এত হিমশিম খেতে হয় না। এত ইউনিট আগাম অবস্থানে থাকা সত্ত্বেও আগুন নিভছে না এটা স্বাভাবিক নয়।
গার্মেন্টস বা অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানে আগুন লাগলে ব্যবসায়ীরা কেবল উৎপাদন বন্ধের সমস্যার মুখোমুখি হন না; তাদের ব্যবসায়িক দায়বদ্ধতা, ঋণ পরিশোধের চাপ, এবং কর্মচারীদের বেতন দেওয়ার দায়িত্বও মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হয়। আগুনের কারণে উৎপাদন বন্ধ হলে উদ্যোক্তাদের ব্যাংক ঋণ, লিজ বা ক্রেডিট লাইন মেটাতে অসুবিধা হয় এবং অনেক ক্ষেত্রে তারা অপ্রত্যাশিত আর্থিক সংকটে পড়ে। ফলে, ক্ষতি শুধুমাত্র অগ্নিকান্ডের সরাসরি ক্ষতিতে সীমাবদ্ধ থাকে না—এটি পরোক্ষভাবে কর্মচারীর জীবনযাত্রা, পরিবার এবং দেশের অর্থনীতির স্থিতিশীলতাকেও ঝুঁকির মধ্যে ফেলে। এ কারণে এ ধরনের দুর্ঘটনা শুধু প্রযুক্তিগত বা নিরাপত্তাগত ব্যর্থতা নয়, বরং এটি অর্থনৈতিক সুরক্ষারও একটি বড় সংকেত।
এই পরিস্থিতি শুধু অর্থনৈতিক ঝুঁকি নয়, এটি দেশের শিল্প ও নাগরিক নিরাপত্তার জন্য একটি সতর্কবার্তা। গুদাম, ফ্যাক্টরি, বিমানবন্দর—সবক্ষেত্রেই অগ্নি নির্বাপক ব্যবস্থা, জরুরি বের হওয়া রুট এবং নিয়মিত নিরাপত্তা প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা আবশ্যক। সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও শিল্প মালিকদের একযোগে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া ছাড়া, ভবিষ্যতে এই ধরনের আগুনে ক্ষতি অমূল্য জীবন ও অর্থনৈতিক কাঠামোর জন্য পুনরায় ধ্বংসাত্মক প্রভাব ফেলবে। এছাড়াও শুধু প্রতিশ্রুতি দিয়ে নয়, কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। গুদাম, ফ্যাক্টরি, অফিস, বিমানবন্দর সব ক্ষেত্রেই অগ্নি নির্বাপক ব্যবস্থা, জরুরি বের হওয়া রুট এবং নিয়মিত নিরাপত্তা প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করা উচিত। সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থা এবং শিল্প মালিকদের একযোগে কাজ করতে হবে। নিরাপত্তার জন্য এই মুহূর্তের উদাসীনতা ভবিষ্যতে জীবন ও অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও শিল্প স্থাপনাগুলো আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বচ্ছ এবং নিরাপদ প্রমাণ করতে হবে। প্রতিটি জীবন এবং ব্যবসার মূল্য অনস্বীকার্য। তাই, কর্তৃপক্ষকে এখনই অবহেলা পরিহার করে দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে এমন অগ্নি বিপর্যয় আর কখনো পুনরাবৃত্তি না ঘটে।
লেখক: কলামিস্ট ও শিক্ষার্থী, কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অফ বাংলাদেশ
এলএইস/