ফিয়াদ নওশাদ ইয়ামিন
পৃথিবীর ইতিহাসে যত সভ্যতা গড়ে উঠেছে, যত জ্ঞানবিজ্ঞানের বিকাশ ঘটেছে, তার প্রতিটি ধাপে শিক্ষকের অবদান অনস্বীকার্য। প্লেটো, অ্যারিস্টটল কিংবা সক্রেটিস এই মহান দার্শনিকরা মানুষকে যুক্তিবোধ, ন্যায়বিচার ও জ্ঞানচর্চার পথ দেখিয়েছেন। তারা প্রমাণ করেছেন, শিক্ষকই একমাত্র ব্যক্তি যিনি একটি সমাজকে অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে যেতে পারেন। কিন্তু দুঃখজনক হলো, আজকের বাংলাদেশে সেই শিক্ষকরা নিজেদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য রাজপথে নামতে বাধ্য হচ্ছেন, আর রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তাদের প্রতি আচরণ হচ্ছে যেন তারা অপরাধী বা রাষ্ট্রবিরোধী কোনো দল। দেশের উন্নয়ন সূচকে প্রতিনিয়ত প্রবৃদ্ধি বাড়ছে, সেতু, ফ্লাইওভার, মেট্রোরেল কিংবা প্রযুক্তির প্রসারে আমরা গর্বিত।
কিন্তু শিক্ষকদের জীবনে সেই উন্নয়নের কোনো প্রতিফলন নেই। এখনো দেশের হাজারো এমপিওভুক্ত শিক্ষক মাস শেষে পনেরো হাজার টাকাও পূর্ণভাবে পান না। এই টাকায় ঢাকা শহরে বাসা ভাড়া দেওয়া দূরের কথা, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য কিনতেই হিমশিম খেতে হয়। কিন্তু অন্যদিকে ছাত্রদের পরিবারের কাছে রয়েছে গাড়ি, দালান, বিদেশ সফরের সামর্থ্য; অন্যদিকে শিক্ষক তার সন্তানের স্কুলের বেতন দেওয়া নিয়েই দুশ্চিন্তায় দিন কাটান। রিকশাচালক, ডেলিভারি ম্যান কিংবা প্রাইভেট ড্রাইভার পর্যন্ত আজ শিক্ষকের চেয়ে বেশি আয় করেন। অথচ শিক্ষকেরা সেই মানুষ, যাদের কলমের ছোঁয়ায় ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আলোকিত হয়, দেশের উন্নয়নের বীজ বপন হয়।
এই অবস্থায় যখন শিক্ষক সমাজ তাদের মৌলিক দাবি নিয়ে রাজপথে নামেন, তখন রাষ্ট্রের উচিত ছিল তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল ও শ্রদ্ধাশীল আচরণ করা। কিন্তু দেখা গেল সম্পূর্ণ উল্টো দৃশ্য। অক্টোবর মাসজুড়ে রাজধানীতে হাজারো শিক্ষক তাদের দাবি জানাতে শাহবাগ থেকে শুরু করে শহীদ মিনার পর্যন্ত অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন। তাদের দাবি খুবই সামান্য ২০ শতাংশ বাড়ি ভাড়া ভাতা বৃদ্ধি, চিকিৎসা ভাতা ১৫০০ টাকা নির্ধারণ এবং উৎসব ভাতা ৭৫ শতাংশ করা। এই দাবিগুলো বিলাসিতা নয়, মৌলিক মানবিক প্রয়োজন। কিন্তু সেই দাবির জবাবে পুলিশি বল প্রয়োগ, লাঠিচার্জ, টিয়ারশেল নিক্ষেপ এ যেন স্বাধীন দেশে এক লজ্জাজনক অধ্যায়।
প্রশ্ন উঠেছে, শিক্ষকরা কি অপরাধী? তারা কি রাষ্ট্রবিরোধী আন্দোলন করছে? আসলে না। তারা যে দাবিগুলো করছেন, সেটি রাষ্ট্রেরই ব্যর্থতার প্রতিফলন। যখন শিক্ষককে রাস্তায় নামতে হয়, সেটা বোঝায় শিক্ষা খাতে ন্যায়বিচার অনুপস্থিত। অতীতে আমরা দেখতে পাই বাংলাদেশের যত যৌক্তিক ছাত্র আন্দোলন হয়েছে শিক্ষকরা তাদের পরিবারের কথা না ভেবে ছাত্রদের সাথে রাজপথে নেমেছেন নিজেদের সন্তানের মত তাদের রক্ষা করেছেন। অনেক শিক্ষক নির্যাতিত হয়েছেন। কিন্তু আজ শিক্ষকদের সাথে এই ব্যবহার কেন?
একজন শিক্ষক যদি সারা জীবন জাতি গঠনে শ্রম দেন, অথচ তার সন্তান চিকিৎসার অভাবে কষ্ট পায়, সেটি কেবল একজন মানুষের নয়, গোটা জাতির পরাজয়।
সক্রেটিস বলেছিলেন, `শিক্ষাই মানুষকে স্বাধীন করে।‘ এই শিক্ষার আলোকবর্তিকা যারা জ্বালিয়ে রাখেন, তাদের হাতেই আমরা বারবার আঘাত হানছি। অথচ পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে শিক্ষককে জাতির অভিভাবক হিসেবে গণ্য করা হয়। ইউরোপ কিংবা জাপানে শিক্ষকরা সবচেয়ে সম্মানিত নাগরিক। তাদের জীবনমান উন্নত, তাদের দাবিগুলোকে সরকার সবসময় অগ্রাধিকার দেয়। কারণ তারা জানে, শিক্ষককে অবমূল্যায়ন করা মানেই ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অন্ধকারে ঠেলে দেওয়া।
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা এখন চরম সংকটে। একদিকে শিক্ষকরা অপ্রতুল বেতনে জীবনযুদ্ধ চালাচ্ছেন, অন্যদিকে নতুন প্রজন্ম এই পেশা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। যদি এখনই সরকার শিক্ষকদের দাবি না মেনে সংলাপের মাধ্যমে সমস্যা সমাধান না করে, তাহলে আগামী দিনে কেউ আর শিক্ষক হতে চাইবে না। সমাজে তখন জ্ঞানের চেয়ে চাকচিক্য, আদর্শের চেয়ে অর্থের মূল্য বাড়বে।
রাষ্ট্রের দায়িত্ব শুধু শাসন করা নয়, বরং ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা। যারা ছাত্রজীবনে আমাদের হাতে কলম তুলে দিয়েছেন, পরীক্ষার খাতায় ভবিষ্যৎ স্বপ্ন লিখেছেন, তাদের গায়ে হাত তোলা কেবল একটি নৈতিক অপরাধ নয় এটি সভ্যতার পরাজয়। শিক্ষককে অপমান মানে জ্ঞানকে অপমান করা, সমাজের আলোকবর্তিকাকে নিভিয়ে দেওয়া।
অতএব, এখনই সময় সরকার, শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রশাসনের একসঙ্গে বসে শিক্ষকদের ন্যায্য দাবি মেনে নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া। আলোচনার টেবিলে সংলাপই পারে এই সংকটের সমাধান করতে। কারণ শিক্ষা কোনো বিলাসিতা নয়, এটি রাষ্ট্রের ভিত্তি। আর সেই ভিত্তি যদি দুর্বল হয়ে পড়ে, তাহলে উন্নয়নের কোনো সেতুই জাতিকে টিকিয়ে রাখতে পারবে না। শিক্ষকরা জাতির নির্মাতা—তাদের সম্মান রক্ষা করা আমাদের প্রত্যেকের নৈতিক দায়িত্ব, মানবিক কর্তব্য এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রতি অঙ্গীকার।
লেখক: শিক্ষার্থী, কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ
এলএইস/