|| বিশেষ প্রতিনিধি ||
রাজধানীর একটি পরিচিত মাদরাসার সিনিয়র শিক্ষক তিনি। একটি ইসলামি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত হলেও বরাবরই বিএনপির প্রতি দুর্বল। এক সময় তার দল বিএনপির জোটসঙ্গী ছিল। সে হিসেবে গত কয়েকটি নির্বাচনে বিএনপির হয়ে ভোটও করেছেন ওই মাওলানা। সেদিন তিনি অনেকটা ক্ষোভের সুরে বলছিলেন- বিএনপির সঙ্গে আর বোধহয় থাকা যাবে না। বিএনপি দিন দিন আলেম-উলামা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। দলের নেতাদের লাগামহীন বক্তব্য আমাদেরকে বিব্রত করছে। আগামী নির্বাচনে বিএনপির হয়ে কাজ করা হয়ত সম্ভব হবে না।
শুধু ওই মাদরাসা শিক্ষকই নয়, এমন হাজারও আলেম পাওয়া যাবে, যারা আগে বিএনপির প্রতি দুর্বল হলেও দিন দিন দলটির ওপর আস্থা হারাচ্ছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ দেখে সেটা আঁচ করা যায়। বিশেষ করে গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বিএনপি যেন অচেনা রূপে আবির্ভূত হচ্ছে ইসলামপন্থীদের সামনে। আলেম-উলামা, ইসলামপ্রিয় জনতা কিংবা ইসলামপন্থীদের টার্গেট করে নানা সময় বিএনপির কয়েকজন নেতার বক্তব্য সমালোচনার ঝড় তুলেছে।
সবশেষ এই তালিকায় যুক্ত হলেন খোদ দলের কার্যত প্রধান তারেক রহমান। গত রোববার (১৭ আগস্ট) লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে দেওয়া একটি বক্তব্যে বাংলাদেশ যেন চরমপন্থা ও মৌলবাদের অভয়ারণ্য না হয়- সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তার এই বক্তব্যের ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। ‘মৌলবাদী’ শব্দটি একটা সময় আওয়ামী লীগ ব্যবহার করতো ইসলামপন্থীদের ঘায়েল করার জন্য। তাহলে বিএনপিও কি সেই পথেই হাঁটছে- এমন প্রশ্ন জোরেশোরে উঠছে।
‘রাজাকার’, ‘মৌলবাদী’, ‘চরমপন্থী’, ‘ধর্ম ব্যবসায়ী’ এসব শব্দ ইদানীং প্রায়ই শোনা যাচ্ছে বিএনপির নেতাদের মুখে। সম্প্রতি বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের ‘রাজনীতিতে দক্ষিণপন্থীদের উত্থান দেখছি, আমি উদ্বিগ্ন’ এমন বক্তব্য সমালোচিত হয়েছে। আর আওয়ামী লীগ থেকে বিএনপিতে আসা অ্যাডভোকেট ফজলুর রহমান তো আলেম-উলামা, মোল্লা-মৌলভিকে অনবরত তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেই চলেছেন। এর বাইরেও বিএনপির বেশ কয়েকজন নেতার সাম্প্রতিক বক্তব্যে ইসলামপন্থীরা মনঃক্ষুণ্ন হয়েছেন। তারা যে ভাষায় কথা বলছেন সেটা অনেক ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে বলে অভিযোগ করছেন কেউ কেউ।
আওয়ামী লীগ যে বয়ান হাজির করে এদেশের ধর্মপ্রিয় মানুষদের ১৫ বছর ঘায়েল করে রেখেছিল, সেটা বিএনপির মুখেও শোনা গেলে তাতে ইসলামপন্থীরা কষ্ট পাওয়ারই কথা। কেননা, এই দলটি বারবার এদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষের ভালোবাসা পেয়ে এসেছে।
আওয়ামী লীগশূন্য নির্বাচনী মাঠে বিএনপি এখন নিজেদের প্রধান শক্তি বলে ভাবছে। এজন্য দলটির মধ্যে ক্ষমতার কাছাকাছি চলে যাওয়ার একটি ভাব চলে এসেছে। ভোটের মাঠে এখন বিএনপির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠছে একসময়ের ঘনিষ্ঠ সঙ্গী জামায়াতে ইসলামী। আর জামায়াত চাচ্ছে চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ প্রধান ইসলামি দলগুলো নিয়ে একটি জোট বা সমঝোতা করতে। ইতোমধ্যে সেই উদ্যোগ অনেকটা এগিয়েছেও। বিশেষ করে পিআর ইস্যুসহ কিছু দাবি-দাওয়ার ক্ষেত্রে জামায়াতসহ ইসলামি দলগুলো বিএনপির বিপরীত মেরুতে অবস্থান করছে। মূলত এ কারণেই ইসলামি দলগুলোর ওপর অসন্তুষ্ট বিএনপি। আর সেটাই দলটির কোনো কোনো নেতার বক্তব্যে ফুটে উঠছে। বিএনপি মনে করছে, ইসলামপন্থী দলগুলো সবাই একটি বাক্স দিলে এবং তাদের সঙ্গে নতুন দল এনসিপিসহ সমমনারা যুক্ত হলে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া কঠিন হয়ে যাবে।
তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, ইসলামপন্থীদের বিরাগভাজন করে বিএনপি ভোটের মাঠে সুবিধা করতে পারবে না। কেননা, ডান ও ইসলামপন্থীরাই হলো বিএনপির প্রধান শক্তি। বাম ও আওয়ামী ধারার বিপরীতে এদেশের ইসলামপ্রিয় মানুষের আস্থার ঠিকানা হলো বিএনপি। কোনো কারণে বিএনপি তাদের আস্থা হারালে রাজনীতিতে দলটি বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়বে।
ইসলামপন্থীদের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক ঐতিহাসিক। দলটি শুরু থেকেই এদেশের আলেম-উলামা ও দীনদার মুসলমানদের ভালোবাসা ও সমর্থন পেয়ে আসছে। দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান ছিলেন ইসলামপন্থীদের প্রিয়ভাজন। সংবিধানের শুরুতে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ এবং মুসলমানের বোধ ও বিশ্বাসকে ধারণ করে সংবিধানের মৌল নীতিমালায় ধর্ম নিরপেক্ষতার পরিবর্তে ‘সর্ব শক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ প্রতিস্থাপন করে জিয়াউর রহমান। পরবর্তী সময়ে খালেদা জিয়াও ইসলামপন্থীদের সঙ্গে আস্থার সম্পর্ক রেখেই দল এবং সরকার চালিয়েছেন। ২০০১ সালে ইসলামপন্থীদের অকুণ্ঠ সমর্থনেই খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে চারদলীয় জোট ক্ষমতায় আসে। খালেদা জিয়ার গোটা রাজনৈতিক জীবনে ইসলামপন্থীদের সম্পর্কে কোনো বিরূপ মন্তব্যের নজির নেই। তাঁর কথা ও আচরণে আলেম-উলামার প্রতি বরাবরই শ্রদ্ধা ও ভক্তি ফুটে উঠেছে। সুতরাং সেই দলের শীর্ষ বা পরবর্তী কোনো নেতার মুখ থেকে ইসলামপন্থীদের বিরাগভাজন হওয়ার মতো বক্তব্য দুর্ভাগ্যজনক বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা।
কারও কারও মতে, তারেক রহমানের নেতৃত্বাধীন বিএনপি আগের অবস্থান থেকে কিছুটা বেরিয়ে আসতে চায়।
ইসলামপন্থীদের নিয়ে চলার কারণে বিএনপি নানা সময় পশ্চিমা বিশ্বসহ নানা শক্তির কাছে কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এজন্য দলটি ইসলামপন্থীদের সঙ্গে মাখামাখি আগের মতো আর করতে চায় না। যদিও ভোটের রাজনীতিতে তাদের কোনো বিকল্প এখনো বিএনপির সামনে নেই। তাছাড়া প্রায় দেড় যুগ ধরে পশ্চিমা বিশ্বে অবস্থানের কারণে তারেক রহমানের মন-মস্তিষ্ক সেভাবেই গড়ে উঠেছে, যা অতীতের সঙ্গে বিএনপির আগামী রাজনীতির সুস্পষ্ট পাথর্ক্য সৃষ্টি করতে পারে বলে ধারণা অনেকেরই। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বিএনপি তার প্রতিষ্ঠাতার নীতি, আদর্শ ও দর্শন থেকে বেরিয়ে গেলে আগামী দিনে দলটিকে এর চড়া মাশুল গোনা লাগতে পারে।
এমএইচ/