শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১৪ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫


কওমি রাজনীতির ভবিষ্যত: কী ভাবছেন দায়িত্বশীল আলেমগণ

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

দেশে কওমি মাদরাসার সংখ্যা অপ্রতুল নয়। শহরে-নগরে অলিগলিতে দেখা যায় কওমি মাদরাসা। কওমি মাদরাসা উচ্ছৃঙ্খল রাজনীতি নেই। রাজনীতি বাধ্যতামূলকও নেই কোথাও। তবে রাজনৈতিক সচেতনা যেন তৈরি হয়, সেজন্য অনেক মাদ্রাসায় রয়েছে রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার স্বেচ্ছাধিকার। ইদানিং কোন কোন মহল থেকে আওয়াজ তোলা হচ্ছে, আইনী প্রক্রিয়ায় যেন কওমি মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়। তাতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় কওমি মহলে। কওমি মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি নিয়ে কেমন ভাবছেন আলেমগণ, এ বিষয়ে বিজ্ঞদের সাথে কথা বলেন আওয়ার ইসলামের প্রতিবেদক আবু সাঈদ



দেশে কওমি মাদরাসার সংখ্যা অপ্রতুল নয়। শহরে-নগরে অলিগলিতে দেখা যায় কওমি মাদরাসা। কওমি মাদরাসায় উচ্ছৃঙ্খল রাজনীতি নেই। রাজনীতি বাধ্যতামূলকও নয় কোথাও। তবে রাজনৈতিক সচেতনা যেন তৈরি হয়, সেজন্য কোন কোন মাদরাসায় রয়েছে রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার স্বেচ্ছাধিকার।

ইদানিং কোন কোন মহল থেকে আওয়াজ তোলা হচ্ছে, আইনী প্রক্রিয়ায় যেন কওমি মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়। তাতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় কওমি মহলে।

চট্টগ্রামের বিখ্যাত কওমি মাদরাসা জামিয়া ইসলামিয়া জিরির সিনিয়র মুহাদ্দিস মাওলানা আ ফ ম খালেদ হোসেন এ বিষয়ে আওয়ার ইসলামকে বলেন, ছাত্র রাজনীতি পড়াশুনার জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। বাংলাদেশ ও পাকিস্তান ছাড়া বিশ্বের কোথাও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র রাজনীতির নজির নেই। তবে ছাত্রদের দলবদ্ধ কোন কর্মকান্ড যে নেই, ব্যাপারটি তেমনও নয়। তারা নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে।

নিজেদের অধিকার আদায় করে নেয়। আমাদের দেশে ছাত্র রাজনীতি বলতে যা বুঝায় -মারামারি-হানাহানি, অন্যায়ভাবে হল দখল- সে অর্থে বিশ্বের কোথাও ছাত্র রাজনীতি দেখা যায় না। তাই বিশ্বের অন্যান্য উন্নত রাষ্ট্রের ন্যায় আমাদেরও শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানকে ছাত্র রাজনীতি মুক্ত রাখতে হবে।

ছাত্রদের মাঝে রাজনৈতিক সচেতনতা কাম্য কিনা, জানতে চাইলে বিজ্ঞ এ আলিম বলেন, ‘ছাত্রদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনা কাম্য। যেন পরবর্তি সময়ে তারা রাজনৈতিক অঙ্গনেও ভূমিকা রাখতে পারে। দেওবন্দ আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা আল্লামা কাসেম নাতুতবী রহ. এর যুগে ছাত্ররা রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলো না।

তবে তাদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনা ছিলো। সেজন্য পরবর্তী সময়ে তারা রাজনীতিতে ভূমিকা রাখতে পেরেছেন। কিন্তু রাজনৈতিক সচেতনার জন্য উচ্ছৃঙ্খল কর্মকান্ডে জড়িত হওয়ার প্রয়োজন নেই।’

‘কোন প্রতিষ্ঠান চাইলে ছাত্রদের রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে পারবে। ছাত্ররাও প্রতিষ্ঠানের নিয়ম মানতে থাকবে বাধ্য। তবে এটাকে আইনী প্রক্রিয়ায় নিষিদ্ধ করা সমীচিন নয়।’

ছাত্র রাজনীতি যেহেতু ক্ষতিকর, তাই আইনী কাঠামোতে গিয়ে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করা যায় কিনা জানতে চাইলে জামিয়া ইসলামিয়া জিরির সিনিয়র এ মুহাদ্দিস উক্ত মন্তব্য করেন।

কওমি শিক্ষকদের রাজনীতি মূল্যায়ন করতে গিয়ে মাওলানা আ ফ ম খালেদ হোসেন আরো বলেন, ‘কওমি শিক্ষকদের রাজনীতি থেকে দূরে থাকতে পারা ভালো। এতে ছাত্ররা রাজনীতির প্রভাব বলয় থেকে মুক্ত থাকতে পারবে। তবে কোন শিক্ষক যদি রাজনীতি করতে চান, তাকে বাধা দেওয়া উচিৎ নয়। এটা তার নাগরিক অধিকার। কলেজ-ভার্সিটির শিক্ষকবৃন্দ রাজনীতিতে যুক্ত হতে পারলে কওমি শিক্ষকগণ কেন যুক্ত হতে পারবেন না?’

এর স্বপক্ষে উদাহরণ টেনে জিরির এ সিনিয়র মুহাদ্দিস বলেন, ‘কওমি শিক্ষকদের রাজনীতিতে যুক্ত থাকার নজির আমাদের নিকট অতীতেই রয়েছে। আমাদের নিকট অতীতের আকাবির শাইখুল ইসলাম হুসাইন আহমাদ মাদানী রহ. রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। তিনি যখন দারুল উলুম দেওবন্দের শাইখুল হাদিস ও সদরুল মুদাররিসিন হিসেবে নিয়োগ প্রাপ্ত হন, শর্ত দিয়েছিলেন, আমি পাঠদানের পাশাপাশি রাজনীতিতেও সক্রিয় থাকবো। দারুল উলুম দেওবন্দের মজলিসে শুরা তাঁর শর্তটি মেনে নিয়েছিলেন।’

কর্তৃপক্ষ যদি শিক্ষককে রাজনীতি মুক্ত রাখতে চান, সে বিষয়ে কিভাবে দেখেন, জানতে চাইলে আ ফ ম খালেদ হোসেন বলেন, ‘কোন প্রতিষ্ঠান যদি শিক্ষকদের রাজনীতি মুক্ত রাখার নীতিগত সিদ্ধানত নিতে চায়, নিতে পারেন। রাজনীতিতে সক্রিয় শিক্ষকগণ সে মাদ্রাসায় পড়াবেন না।’

কওমি মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকদের জন্য রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড আইনী প্রক্রিয়ায় নিষিদ্ধ করা সঙ্গত কিনা, এ বিষয়ে কথা বলেন কওমি অঙ্গনের পরিচিত মুখ, লেখক গবেষক মাওলানা শরীফ মুহাম্মাদ

তিনি বলেন, ‘কওমি মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়া (রাজনৈতিক কর্মকান্ডে ব্যবহৃত হওয়া/মাঠে ময়দানে মিছিলে ভোটে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করা) সঙ্গত কিনা, এ নিয়ে অভ্যন্তরীণভাবে অনেক কথা, মত, নিয়ম-নীতি, নিয়ন্ত্রণ থাকতে পারে, থাকার দরকারও আছে।

কিন্তু এ বিষয়টিকে কেন্দ্র করে কোনো সরকারের সঙ্গে আইনি কাঠামোতে কিংবা নীতিগত চুক্তিতে যাওয়া একেবারেই ঠিক না। এটা মূলত সাংবিধানিক নাগরিক অধিকার থেকে নিজেদেরকে স্থায়ীভাবে বঞ্চিত করা এবং ভোট ও রাজনীতির অধিকার বঞ্চিত শ্রেণীতে পরিণত করার নামান্তর। বাংলাদেশে এর নিকট ও সুদূরপ্রসারী কুফল অত্যন্ত ভয়ংকর।’

কওমি মাদরাসার প্রাতিষ্ঠানিকভাবে রাজনীতিমুক্ত থাকাকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে প্রাজ্ঞ এ আলেম বলেন, ‘তবে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে রাজনীতিমুক্ত থাকা, মৌখিকভাবে রাজনীতি থেকে কিছু সময়ের জন্য নীরব থাকা, লেজুরবৃত্তির বা বিশৃঙ্খল রাজনীতিতে ছাত্রদের ব্যবহার বিষয়ে নিরুৎসাহী থাকা-এসব অবশ্যই হতে পারে। সেটা নিজস্ব পরিমণ্ডলে অভ্যন্তরীণভাবে হবে। বাইরের কারো প্রতি মুচলেকা দিয়ে, আইন কিংবা চুক্তি করে নয়।’

মাওলানা শরীফ মুহাম্মাদ আরো বলেন, কওমি ছাত্র-শিক্ষক মহলের রাজনীতির ব্যাপারে নিজের অভিমত ব্যক্ত করে বলেন, আমার ব্যক্তিগত মত হলো, কওমি মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকদের ঢালাওভাবে রাজনীতিতে যুক্ত হওয়া বা বিশৃঙ্খল রাজনীতিতে যুক্ত হওয়া সমর্থনমূলক নয়।’

কওমি আলেমগণ প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ছাত্রদের রাজনীতি বিমুক্ত থাকাকে পছন্দ করলেও আইনী প্রক্রিয়ায় তা থেকে বঞ্চিত হতে চান না। তাদের মধ্যে যেন রাজনৈতিক সচেতনতা তৈরি হয়, সে সুযোগ অবারিত রাখতে চান।

বিভিন্ন সময় কওমি আলেমদের লেখায় উঠে এসেছে, ‘ছাত্ররা আদর্শগতভাবে কোন দলকে সমর্থন দিতে পারে। তাদের পক্ষে-বিপক্ষে বিশ্লেষণ করতে পারে।

কিন্তু মাঠ পর্যায়ে কোন দলের সাথে যুক্ত হতে পারে না।’ এতে একদিকে ছাত্রদের মাঝে রাজনৈতিক সচেতনতা তৈরি হবে, অন্যদিকে জ্ঞানগত প্রজ্ঞাও তৈরি হবে।

কওমি ছাত্রদের রাজনীতির নিষিদ্ধ হওয়া অভ্যন্তরীণ ব্যাপার হোক। কোন আইনী প্রক্রিয়ায় নিষিদ্ধ না হোক।

-এটি


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ