রবিবার, ১৯ মে ২০২৪ ।। ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ ।। ১১ জিলকদ ১৪৪৫


দেওবন্দ ছাড়া বাকি সব কি ‘গোমরাহ'র দল?

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

।।ফারুক ফেরদৌস।।

ইখতেলাফ সাহাবায়ে কেরামের সুন্নাহ। সাহাবায়ে কেরামের যুগ থেকেই ইসলাম বিভিন্নভাবে পালিত হয়েছে। বিভিন্ন বিষয়ে বিভিন্ন রকম মতামত বা চিন্তাধারা মুসলমানদের মধ্যে জায়গা পেয়েছে। এই ইখতেলাফ বা মতবিরোধে এক পক্ষ অন্য পক্ষকে গোমরাহ বলেননি, ভ্রান্ত বলেননি।

বলেছেন আমার দৃষ্টিতে আমার মত সঠিক মনে হচ্ছে। তার মত ভুল মনে হচ্ছে। হতে পারে তার মতই ঠিক, হতে পারে আমার মত ভুল। কারণ বিষয়গুলো ছিলো মুজতাহাদ ফীহ, কাতঈ বা সুনিশ্চিত কিছু না। আল্লাহ বা রসুল সা.-এর পক্ষ থেকে নিশ্চিতভাবে স্পষ্ট কোনো নির্দেশনা ওইসব বিষয়ে ছিলো না।

তাদের পরে তাবেয়ী, তাবে-তাবেয়ী ও আইম্মায়ে মুজতাহিদীন ‘মুজতাহাদ ফীহ’ বিষয়ে ইখতেলাফ ও বিরোধীদের ব্যাপারে মন্তব্যের ক্ষেত্রে তাদের দেখানো পথই অনুসরণ করেছেন। এই ইখতেলাফ, ভুল শুদ্ধের সম্ভাব্যতা, বৈচিত্র্য ধারণ করার সামর্থ্য ইসলামের বড় একটা সৌন্দর্য। উম্মতের জন্য রহমত।

সালফে সালেহীন, হকপন্থী ওলামায়ে কেরাম এই ইখতেলাফ বা বৈচিত্র্যকে দেখেছেন রহমত এবং হকের পরিসরে প্রশস্ততা হিসেবে। ইবনে কুদামা আল মাকদিসী রহ. তার আল-মুগনী কিতাবে বলেছেন, আল্লাহ উম্মতের আলেম ও ইমামদের মাধ্যমে ইসলামে কাওয়ায়েদ বা মূলনীতিসমূহকে বিন্যস্ত করেছেন এবং জটিল আহকামগুলো স্পষ্ট করেছেন। তাদের ঐক্যমত্য যেমন নিশ্চিত দলিল, তাদের ইখতেলাফও রহমত ও প্রশস্ততা।

আবু বকর ইবনুল আরাবী তার কিতাব আহকামুল কুরআনে বলেছেন, যে সব ব্যাপারে আল্লাহর সুনির্দিষ্ট কোনো নির্দেশনা নেই, সেই সব ব্যাপারে রাসুল সা.-এর পরে ওলামায়ে কেরাম ইখতেলাফ করেছেন, কোনো আলেম হালাল বলেছেন কোনো আলেম হারাম বলেছেন, কোনো মুজতাহিদ ওয়াজিব বলেছেন, কোনো মুজতাহিদ ওয়াজিব বলেননি। ওলামায়ে কেরামের এই মতবিরোধ মানুষের জন্য রহমত, সত্যের পরিসরে প্রশস্ততা ও সহজতার কারণ।

সুতরাং মুজতাহাদ ফীহ বিষয়ে ইখতেলাফ সাহাবায়ে কেরাম ও সালফে সালেহীনের সুন্নাহ কিন্তু এই ইখতেলাফে প্রতিপক্ষকে গোমরাহ বা বিভ্রান্ত বলা বিদআত।

আমাদের অঞ্চলে বিভিন্ন মুজতাহাদ ফীহ বিষয়ে মতবিরোধ নিয়েও আমরা যে অসহিষ্ণুতার চর্চা দেখি, এটা ঘটছে এই বিদআতের প্রসারের কারণে। ওলামায়ে কেরাম সাধারণ মানুষকে শুধু নিজেদের মত বোঝান, ইখতেলাফের কারণ বা হক বোঝান না। ফলে সাধারণ মানুষ ওই মতের পক্ষ নিয়ে জীবন দিতে প্রস্তুত হয়ে যায়।

এই অঞ্চলে আলেমদের প্রায় সব পক্ষই এই ভুলের চর্চা করছেন। ফলশ্রুতিতে মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ, বিদ্বেষ বাড়ছে। দীন নিয়ে বিবাদ বাড়ছে। অথচ মুসলমানদের হওয়ার কথা ‘আশিদ্দাউ আলাল কুফফার রুহামা-উ বাইনাহুম’ কাফের বা ইসলামের শত্রুদের ব্যাপারে কঠোর, নিজেদের মধ্যে দয়ার্দ্র বা সহানুভূতিশীল। আমাদের মুসলমান সমাজ যে নিজেদের মধ্যে বিদ্বেষ ও শত্রুতায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠছে এর দায় কি ওলামায়ে কেরাম এড়াতে পারেন?

কোনো আলেম নিজের মানহাজকে অবশ্যই সঠিক মনে করবেন বা সঠিক বলবেন। সঠিক না মনে করলে তিনি সেটা অনুসরণ করছেন কেন? কিন্তু ‘নিজের মানহাজই একমাত্র ও চূড়ান্ত সত্যের মাপকাঠি, বাকি সব বিভ্রান্ত’ এইসব কথা বলে আসলে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে। তার মানহাজ ভ্রান্ত নয়, কিন্তু মানহাজের পক্ষে তার অবস্থান নেওয়ার তরিকা ভ্রান্ত।

সম্প্রতি একটি সুপরিচিত ও বৃহৎ ইসলামী রাজনৈতিক দলের ওলামা মাশায়েখ সম্মেলনে এক বক্তা বলেছেন, দেওবন্দী তরিকা ছাড়া বাকি সব নাকি ‘গোমরাহর দল’। এই রকম ‘গোমরাহ’ বক্তব্য কোনো ‘ওলামা মাশায়েখ সম্মেলন’ থেকে আসা খুবই দুঃখজনক। ব্যক্তি হিসেবে তার কথার গুরুত্ব কম থাকতে পারে, কিন্তু একটি বৃহৎ ইসলামী দলের ওলামা মাশায়েখ সম্মেলনের গুরুত্ব তো কম নয়।

ওই দল বা ওই সম্মেলনে উপস্থিত সব আলেম ওলামা কি এ রকমই মনে করেন? তারা তার বক্তব্য সঠিক মনে করছেন না এ রকম কোনো আলামত তো পাওয়া যাচ্ছে না। একটি বৃহৎ ইসলামী রাজনৈতিক দল হিসেবে দীনি বিষয়ে সঠিক অবস্থান নেওয়া, সমাজে বিভ্রান্তি না ছড়ানো, ওলামা মাশায়েখ হিসেবে কাউকে সামনে আনার ক্ষেত্রে আরও দায়িত্বশীল হওয়া উচিত। আশা করি ভবিষ্যতে তারা এইসব বিষয়ে সতর্ক থাকবেন।

-কেএল


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ