শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫


প্রাণীর ভাস্কর্য: আরব স্কলারদের অভিমত

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুহাম্মদ আল আমিন।।

ভাস্কর্য। সম্প্রতি বাংলাদেশের সর্বালোচিত শব্দ। হালের টক অব দ্য কান্ট্রি। ভাস্কর্য নির্মাণ। মাঠ-মঞ্চ কাঁপিয়ে ‘ভাস্কর্য’ এখন মুখে মুখে। ইসলামে মূর্তি নিষিদ্ধ, একথা সবাই মানে, কিন্তু প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে— ভাস্কর্য মূর্তির আওতায় পড়বে কি না।

দেশের সর্বমহলের বিশেষজ্ঞ আলেমগণ বলছেন, ‘প্রাণীর ভাস্কর্য আর মূর্তির মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। উপাসনার উদ্দেশ্যে নির্মাণ করা হোক বা অন্য কোনো উদ্দেশ্যে; ইসলাম উভয়টাকেই হারাম সাব্যস্ত করেছে। তবে, নিষ্প্রাণ বস্তুর ভাস্কর্য নির্মাণ করা ইসলামে বৈধ।’

অন্য দিকে ধর্মের নামেই এক শ্রেণী বলছে, ‘ইসলামে মূর্তি নির্মাণ করা অবৈধ; ভাস্কর্য প্রাণীর হোক বা নিষ্প্রাণ, তা নির্মাণ করা ইসলামে অবৈধ নয়। যারা ভাস্কর্যকে অবৈধ বলছে, তারা ভাস্কর্য আর মূর্তির পার্থক্য না জেনেই বলছে।’ বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের সমর্থক লোকজন জোড়েশোড়ে এ মতের প্রচার করছে। পাশাপাশি যারা প্রাণীর ভাস্কর্য আর মূর্তিকে অভিন্ন সাব্যস্ত করে উভয়টাকে নিষিদ্ধ বলে আসছেন তাদেরকে মূর্খ, ধর্ম-ব্যবসায়ী, ধর্মের অপব্যাখ্যাকারী ও ভাস্কর্য-মূর্তির পার্থক্য জ্ঞানহীন বলে যাচ্ছেন। বৈধ-অবৈধের এ দ্বিবিধ বক্তব্যের কারণে জনসাধারণ এখন দ্বিধান্বিত। তাই চলুন দেখে আসি বর্হিবিশ্বের খ্যাতনামা ইসলামি স্কলারগণ প্রাণীর ভাস্কর্য আর মূর্তির ব্যাপারে কী বলছেন।

১. আরব বিশ্বের বিদগ্ধ ফকিহ ও ধর্মবেত্তা শায়খ ওয়াহবাহ আয যুহাইলি রহ. এর অভিমত

শায়খ ওয়াহবাহ আয যুহাইলি রহ. বলেন, ভাস্কর্যের ন্যায় মানুষ বা অন্য কোনো প্রাণীর দেহবিশিষ্ট প্রতিকৃতি নির্মাণ করা সর্বসম্মতিক্রমে হারাম। যাতে সেগুলোর সামনে সম্মান প্রদর্শনের পথ রুদ্ধ হয়, যা মানুষকে দিনান্তরে সেগুলোর উপাসনার দিকে নিয়ে যায়। আর এ সমস্ত প্রাণীর প্রতিকৃতি ক্রামান্বয়ে মূর্তি পূজার পথ সুগম করে, তাই তা বানানো নাজায়েয। (আল ফাতাওয়াল আমিদিয়্যাহ, পৃ: ১৬০)

২. সৌদি আরবের বরিত আলেম শায়খ বিন বায রহ. এর অভিমত

শায়খ বিন বায রহ. বলেন, প্রাণীর ভাস্কর্য যে উদ্দেশ্যেই হোক তা নির্মাণ করা হারাম, চাই তা রাজা-বাদশাহ, সেনাপতি, সভ্রান্ত বা কীর্তিমান ব্যক্তিবর্গদের চিরস্মণীয় করে রাখার জন্য হোক অথবা বুদ্ধিমত্তা বা বিরত্বের প্রতীকরূপে হোক। কেননা এগুলো নিষিদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে বর্ণিত হাদিসগুলো ব্যাপকার্থবোধক। তাছাড়া প্রাণীর ভাস্কর্য শিরকে লিপ্ত হওয়ার মাধ্যম, যেমনটা নুহ আ. এর সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে হয়েছিলো। (binbaz.org)

৩. আরব বিশ্বের খ্যাতিমান আলেম শায়খ মুহাম্মদ বিন সালেহ আলউসাইমীন রহ. এর অভিমত

শায়খ ইবনে উসাইমীন রহ. বলেন, প্রাণীর দেহ বিশিষ্ট আকৃতি তৈরী করা হারাম। কেননা নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রাণীর আকৃতি নির্মাণকারীদের অভিশসম্পাত করেছেন। তাছাড়া নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এও বলেছেন যে, মহান আল্লাহ বলেছেন, ঐ ব্যক্তির চেয়ে জালেম আর কে হতে পারে, যে আমার সৃষ্টির মতো সৃষ্টি করতে চায়? অতএব প্রাণীর আকৃতি নির্মাণ করা হারাম। আর যদি আকৃতিটি নিষ্প্রাণ কোনো জিনিসের হয়, তাহলে তাতে কোনো সমস্যা নেই, তা নির্মাণ করা বৈধ। কেননা তা বৈধ কাজের অন্তর্ভূক্ত। আল্লাহই তওফিকদাতা। (মাজমূউ ফাতাওয়া ও রাসায়িলিশ শায়েখ ইবনে উসাইমীন: খণ্ড: ১১/ ছবি নির্মাণ অধ্যায়।)

৪. প্রখ্যাত ইসলামি স্কলার শায়খ ইউসুফ আল কারযাবী-এর অভিমত

ড. ইউসুফ আল কারযাবী হাফি. বলেন, উপাসনার জন্য দেহ বিশিষ্ট আকৃতি নির্মাণ করা নিকৃষ্ট কুফূরি কাজ। আর উপাসনার উদ্দেশ্য ছাড়া, সম্মান প্রদর্শন ও চির অমর করে রাখার উদ্দেশ্যে প্রাণীর প্রতিকৃতি নির্মাণ করা, যেমন: রাজা-বাদশাহ, বড়ো নেতা, গুনীজনদের প্রতিকৃতি নির্মাণ, তা এর চেয়ে কিছুটা নিচের স্তরের অর্থাৎ হারাম, তবে কুফূরি নয়। (কারযাবীকৃত আল ইসলাম ওয়াল ফান, পৃ: ৫৩)

৫. নন্দিত আরব স্কলার শায়খ সালেহ আল মুনাজ্জিদ-এর অভিমত

শায়খ সালেহ আল মুনাজ্জিদ হাফি. ভাস্কর্য সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জাবাবে বলেন, প্রশ্ন থেকে বুঝা যায় যে, ভাস্কর্য অমুসলিম ব্যক্তির হলে তা হারাম, আর মুসলিম ব্যক্তির হলে তা বানানো জায়েয আছে। এটা সম্পূর্ণ ভুল। প্রাণীর ভাস্কর্য নির্মাণ করা হারাম। মুসলিম ব্যক্তির ভাস্কর্য হোক বা অুমসলিম ব্যক্তির, হারাম হওয়ার ক্ষেত্রে উভয়ের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। তবে, অমুসলিম ব্যক্তির ভাস্কর্য নির্মাণ করার নিষিদ্ধতা তুলনামূলক কঠোর। কেননা এতে নিষিদ্ধতার দিক দুটি, এক. প্রাণীর ভাস্কর্য নির্মাণ, দুই. অমুসলিম ব্যক্তির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন। (islamqa, question no: 7222)

৬. প্রতিভাধর ব্যক্তিত্ব ও আরবের বরিতজন শায়খ সালেহ আল ফাওযান-এর অভিমত

শায়খ সালেহ আল ফাওযান হাফি. (প্রাণীর ছবি অঙ্কনের নিষেধাজ্ঞাসংক্রান্ত হাদিস বর্ণনার পর) বলেন, এ নিষেধাজ্ঞার অন্তর্ভূক্ত সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ, যেমন: জ্ঞাণীজন, শাসক, সাধক, সভ্রান্ত ব্যক্তি বা নেতৃবর্গের ছবি অঙ্কন, আর এ অঙ্কনটা কোনো ফলক, কাগজ, দেয়াল বা কাপড়ের উপর হোক, আধুনিক ক্যামেরার মাধ্যমে হোক অথবা দেহবিশিষ্ট ভাস্কর্য বা প্রতিকৃতি নির্মাণের মাধ্যমে হোক। (alaqida.net)

লেখক: শিক্ষার্থী, ফতোয়া বিভাগ, জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া, মোহাম্মদপুর, ঢাকা।


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ