শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫


মাদরাসার জন্য আমার রাষ্ট্রীয় কোষাগার উন্মুক্ত: সেলজুক সুলতান মেলিক শাহ

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

কাউসার লাবীব: একাদশ শতাব্দীর সেলজুক সম্রাজ্যের মহান উজির নিযামুল মুলক। ইতিহাসে তাকে মানুষ মাদরাসা প্রেমিক হিসেবেই বেশি চেনে। মাদরাসা ও মাদরাসা ছাত্রদের প্রতি তার ভালবাসার নিদর্শন এখনো মধ্যপ্রাচ্যে প্রতীয়মান। তাইতো কেউ কেউ বলে থাকেন ‘বর্তমান প্রচলিত দরসে নেযামিকে তার নামোনুসারেই নাম করণ করা হয়েছে’। যদিও ইতিহাস বলে অন্যকথা।

নিযামুল মুলক সেলজুক সম্রাজ্যে পাঁচ’শ থেকে বেশি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। যেগুলো ছিল তৎকালীন সময়ের অত্যাধুনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। পৃথিবীর সব উন্নত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নমুনা সামনে রেখে তিনি এগুলো প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মাদরাসার আবাসিক ভবন ও শিক্ষা ভবন ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। ছাত্রদের মনোরঞ্জনের জন্য মাদরাসার পাশে ছিল মনোরম উদ্যান। মাদরাসা চত্বরে ছিল দৃষ্টিনন্দন ফোয়ারা। ছিল কোলাহল মুক্ত পরিবেশ। সব মিলিয়ে যেন এক স্বপ্নের জগৎ। মোহনীয় পরিবেশ।

তার প্রতিষ্ঠিত মাদরাসায় ছাত্রদের থেকে কোন খরচ নেওয়া হতো না। পাশাপাশি মেধাবীদের জন্য ছিল বৃত্তির ব্যবস্থা। ছিল হতদরিদ্র মেধাবীদের জন্য পরিবার চালানোর খরচ প্রদান, দূরের ছাত্রদের জন্য আবাসন ব্যবস্থা ও ছাত্র-উস্তাদদের গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় সব কিতাব প্রদানসহ অনেক সুযোগ-সুবিধা। এছাড়া প্রতিটি মাদরাসাতেই ছিল বিশাল এক গ্রন্থাগার। যাতে ছিল লক্ষাধিক কিতাব। প্রায় সবশাস্ত্রেরই কিতাব ছিল প্রতিটি লাইব্রেরিতে। মহান উজিরের এসব মাদরাসাকে ইতিহাস ‘নেযামিয়া মাদরাসা’ নামেই চেনে। নেযামিয়া মাদরাসার বার্ষিক বাজেট ছিল ছয় লাখ দিনারেরও বেশি।

তিনি মাদরাসার শিক্ষামান নিয়ে কখনো আপোষ করেন নি। বিপুল অর্থ ব্যয়ে তিনি বিশ্বের প্রথিতযশা আলেমদেরকে তার মাদরাসায় শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। যাদের মধ্যে ছিলেন ইমাম গাজালি রহিমাহুল্লাহর মতো পুরোধা। সবমিলিয়ে নিযামুল মুলকের টার্গেট ছিল নেযামিয়া মাদরাসাগুলোকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ মাদরাসা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। এতে তিনি সফলও হয়েছিলেন। কেননা শিক্ষাদীক্ষা, পরিবেশ ও কিতাবের সম্ভারের দিক থেকে তার মাদরাসা মিশরের আযহার ইউনিভার্সিটিকেও পেছনে ফেলে দিয়েছিল।

মাদরাসা ও মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকদের পেছনে তার এ বিপুল অর্থ ব্যয়ের খবর তার বিরোধী উজির তাজুল মুলক ও অন্যান্যদের কাছে পৌঁছলে তারা তাকে সুলতানের কাছে ফাঁসিয়ে দিতে চাইল। তারা সুলতান মেলিক শাহকে বললো, ‘জাহাপনা! নিযামুল মুলক সুফিসাধক, ফুকাহায়ে কেরাম ও ক্বারীদের পেছনে প্রতি বছর প্রায় ছয় লাখ দিনার ব্যয় করে থাকেন। যদি বিপুল এ অর্থ দেশের সেনাবাহিনীদের দক্ষতা বাড়ানোর জন্য ব্যয় করা হতো। তাহলে সেলজুক সম্রাজ্যের ঝান্ডা এতোদিনে কনস্টান্টিনোপলের দূর্গে পতপত করে উড়তো’।

সেলজুক সুলতান মেলিক শাহ নিযামুল মুলকে নিজ পিতার মতো শ্রদ্ধা করতেন। কেননা নিযামুল মুলক তার বাবা মহান সুলতান আল্প আরসালানেরও উজির ছিলেন। কিন্তু মেলিক শাহ ছিলেন ন্যায়পরায়ণ। যেকোনো অভিযোগ পেলেই তা তিনি আমলে নিতেন। এর প্রেক্ষিতে তিনি নিযামুল মুলককে ডেকে পাঠালেন। অভিযোগের বিষয়ে সত্য জানতে চাইলেন তার কাছে।

নিযামুল মুলক মুচকি হেসে সুলতান মেলিক শাহকে বললেন, ‘ছেলে আমার! (মেলিক শাহ তার ছেলের বয়সী ছিল। আর মেলিক শাহও তাকে চাচা ডাকতো।) আমি একজন আজমি বয়োবৃদ্ধ। যদি গোলাম হিসেবে আমার দাম হাঁকা হয় তাহলে তা সর্বোচ্চ তিন দিনারে পৌঁছবে। আর আপনি একজন তুর্কি যুবক হওয়ায় তা সর্বোচ্চ একশো দিনারে গিয়ে ঠেকতে পারে। কিন্তু আপনি কি লক্ষ করছেন যে, আমাদের মতো নগন্য এ বান্দাদের আল্লাহ তাআলা কত নিয়ামতরাজিতে ডুবিয়ে রেখেছেন? আপনি কি সেই মহান স্রষ্টার দীন প্রচার ও তার মহাগ্রন্থের হেফাজতে মাত্র ছয় লাখ দিনার খরচ করে কৃতজ্ঞতার পরিচয় দিবেন না?

তাছাড়া আপনি তো সৈনিকদের দক্ষতা বাড়াতে এরচেয়ে অনেক বেশি অর্থ খরচ করে থাকেন। অথচ  এ সেনাদের তীর এক মাইলও অতিক্রম করতে পারে না। তাদের তলোয়ারও শুধু তাদের চারপাশেই আঘাত করতে পারে। সুদূরে পৌঁছতে অক্ষম। কিন্তু আমি সামান্য এ অর্থ খরচ করে রাজ্যের জন্য এমন কিছু নৈশ বাহিনী গঠন করছি। আপনার সেনারা ঘুমানোর পর যারা সঙ্গোপনে প্রভুকে ডাকে। দুটি রিক্ত হস্ত বাড়িয়ে দেয় মহান প্রতিপালকের দরবারে। অঝোর ধারায় অশ্রু ঝরায়। আর তাদের এ দোয়ার তীর সেই সুদূর আরশুল মুআল্লায় প্রভুর দরবারে পৌঁছে যায়। এ তীরের গতিপথ কেউ রুখতে পারে না। আপনি ও আপনার সৈন্যরা তাদের পাহারাতেই বেঁচে আছেন। দৃঢ় চিত্তে লড়ে যাচ্ছেন তাদের দোয়ায়। আর যা কিছু খেয়েপরে টিকে আছেন তা তাদের বরকতেই।’

প্রিয় উজিরের চমৎকার এ কথাগুলো মেলিক শাহের হৃদয় ছুঁয়ে গেল। অশ্রু সজল চোখে তিনি বললেন, ‘চির কল্যাণ আপনার জন্য। সাবাশ আপনাকে। আপনি আপনার এ নৈশ বাহিনীর সংখ্যা আরো বাড়াতে থাকুন। রাষ্ট্রীয় কোষাগার আপনার এ বাহিনীর জন্য উন্মুক্ত। আপনার মাদরাসা আলো ছড়াক দিকদিগন্তে।মানুষের সঠিক পথের দিশারী হোক’।

ইতিহাস বলে, তৎকালীন সময়ে মিসরে ফাতেমি শাসকরা আল আযহারের মাধ্যমে শিয়া আকিদার যে বিষবাষ্প ছড়াচ্ছিল। তার মোকাবিলায় নেযামিয়া মাদরাসাগুলো আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের আকিদা প্রচারে অবিস্মরনীয় অবদান রাখে।

আল্লাহ মহান সেলজুক উজির নিযামুল মুলক ও মহান সুলতান মেলিক শাহের কবরকে জান্নাতের টুকরো বানিয়ে দিক। আমিন।

-কেএল


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ