শাহ মমশাদ আহমদ
বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর কওমি ঘরানার ইসলামি রাজনৈতিক দলের কেউই নিজের দলীয় প্রতীকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হতে না পারলেও জোটের নিজস্ব প্রতীকে নির্বাচিত একমাত্র সংসদ সদস্য ছিলেন কওমি তারকা শায়খুল হাদিস মাওলানা ওবায়দুল হক উজীরপুরী রহ.। ইসলামী ঐক্যজোটের মিনার প্রতীকে ১৯৯১ সালে জকিগঞ্জ-কানাইঘাট এলাকা হতে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের নায়েবে আমির ছিলেন।
যুগশ্রেষ্ঠ হাদিস বিশারদ আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মীরির (রহ.) খাছ শাগরেদ আল্লামা রিয়াসাত আলী চৌধুরী (রহ)-এর স্নেহধন্য হজরত আল্লামা ওবায়দুল হক রহ. নিজ কর্মে প্রিয় শায়খের প্রতিচ্ছবি ছিলেন।
মূলত তিনি দরস তাদরিস ওয়াজ নাসিহাতের ময়দানে ব্যস্ত ছিলেন, রাজনৈতিক সচেতন থাকলেও কোনো রাজনৈতিক দলে সম্পৃক্ত ছিলেন না। ১৯৯১ সালে গঠিত হয় ইসলামী ঐক্যজোট। তিনি প্রিন্সিপাল আল্লামা হাবীবুর রহমানের (রহ.) প্রচেষ্টায় এবং শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ.-এর নির্দেশে ইসলামী ঐক্যজোটে সম্পৃক্ত হন। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসে যোগদান করেন।
ইসলামী ঐক্যজোটের অন্তর্ভুক্ত দলসমূহের মধ্যে ছিল-জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন, সিলেটের ফুলতলী সাহেবের আঞ্জুমানে আল ইসলাহ।
নির্বাচনে ইসলামী ঐক্যজোট পঞ্চাশের অধিক প্রার্থী দেয়। জোটের প্রতীক মিনার ও জমিয়তের প্রার্থীগণ নিজস্ব দলীয় প্রতীক খেজুর গাছ মার্কায় নির্বাচন করেন। কিন্তু সবাইকে তাক লাগিয়ে রাজনীতি থেকে দূরে থাকা আল্লামা ওবায়দুল হক (রহ.) বিপুল ভোটে বিজয়ী হন।
স্বাধীনতার পর কওমি অঙ্গনের আর কোনো আলেমই নিজ দল/জোটের প্রতীকে সংসদ সদস্য হতে পারেননি, কেউ কেউ ধানের শীষ বা লাঙ্গল মার্কায় নির্বাচিত হয়েছেন, একমাত্র উজীরপুরী রহ. এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম।
সাদামাটা চালচলনে অভ্যস্ত, সুন্নাহ পাগল এ মানুষটিই হয়ে যান জনগণের নেতা, এমপি হলেও ব্যক্তিগত চালচলনে ছিল না কোনো ব্যবধান, হাস্যোজ্বল চেহারার পাগড়ি পরিহিত মাটির মানুষটি সত্যিকার অর্থেই ছিলেন মাটি ও মানুষের নেতা।
তিনি সংসদ সদস্য থাকাকালীন বয়সে তরুণ হলেও আমি ছিলাম তাঁর প্রেস সচিব। উস্তাদে মুহতারাম প্রিন্সিপাল আল্লামা হাবীবুর রাহমান (রহ.) আমাকে এ কাজে সম্পৃক্ত করে দেন। এছাড়া হজরত এমপি সাহেব রহ. ছিলেন আমার আব্বাজান রহ.-এর সহপাঠী, আমাকে নিজের সন্তানের মতো মহব্বত করতেন। অনেকটা কাছ থেকে এই মহান মানুষটির কাজকর্ম, দ্বীনি খেদমত দেখার সুযোগ হয়েছে। সে প্রেরণাময় স্মৃতির যৎকিঞ্চিত তুলে ধরছি।
এক. তৎকালীন সংসদ সদস্য মকসুদ ইবনে আজীজ লামা অসুস্থ, হুজুর আমাকে সাথে নিয়ে ওসমানী মেডিক্যালের দিকে রওয়ানা দিলেন। রিকশায় বসেই ড্রাইভারের হালপুরসী করা ছিল তার অভ্যাস। ড্রাইভার ভাই তার বাড়ী জকিগঞ্জ বলে জানালেন। মেয়েটি এসএসসি পাস। একটি চাকরির সুযোগ থাকলেও স্থানীয় এমপির স্বাক্ষর লাগে। এমপি কীভাবে পাবেন? হতাশা ব্যক্ত করলেন।
এমপি সাহেব রহ. বললেন, দরখাস্ত কি লিখিয়েছ?
জ্বি হুজুর, আমার সাথেই আছে।
হুজুর বললেন, দরখাস্ত বের করো, এখনই স্বাক্ষর দিয়ে দিবো।
ড্রাইভার ভাইটি হতভম্ব, ফ্যালফ্যাল চোখে তাকাচ্ছিল। সকাল বেলা, ভিড় ছিল না, মদন মোহন কলেজের সামনে হুজুর আর আমি রিকশার পাশে দাঁড়ালাম, ড্রাইভার ভাই সিটের নিচ থেকে আবেদনপত্র বের করে দিলেন। হুজুর ব্যাগ থেকে সিল বের করে স্বাক্ষর করে সিল মেরে দিলেন। আনন্দে ড্রাইভার ভাইটির কান্না এখনও আমার চোখে ভাসছে।
দুই. নির্ধারিত সময়ে প্রোগ্রামে উপস্থিত হওয়া ছিল হুজুরের অভ্যাস। সোলেমান হলে একটি আলোচনা সভা। তিনি প্রধান অতিথি। যথাসময়ে আমাকে নিয়ে উপস্থিত হলেন। আয়োজকরাও অনুপস্থিত, আমাকে শান্ত করার জন্য হুজুর বললেন- চলো দরগাহের ইমাম সাহেবকে অনেক দিন যাবত দেখিনি, দেখে আসি।
ইমাম সাহেব হুজুরের হুজরায় অনেক মানুষের ভিড়, এমপি সাহেব বাহিরে দাঁড়িয়ে। ইমাম সাহেবের খাদেম ভেতরে নিয়ে গেলেন। ইমাম সাহেব হুজুর তো কত আল্লাহওয়ালা ছিলেন, আমাদের সকলের জানা। এমপি সাহেবকে বললেন, আপনি তো সিয়াসি সরদার। হুজুর বললেন, আমার জন্য দোয়া করুন। ইমাম সাহেব হাত উঠিয়ে দোয়া করলেন।
উপস্থিত সকলেই শরিক হলাম। বিদায় মুহূর্তে এমপি সাহেবকে নগদ কিছু টাকা হাদিয়া দিলেন, আমাকেও দিলেন। এটা ইমাম সাহেব হুজুরের (রহ.) নিত্য অভ্যাস ছিল।
এক ঘণ্টা পর এসে দেখলাম এখনও প্রস্তুতি চলছে। হুজুর সামান্য পরিমাণ রাগ না করে সাহিত্য সংসদের অফিসে বসলেন। কিছু লোক জমায়েত হওয়ার পর বক্তব্য দিলেন। হাস্যমুখে সময়ের গুরুত্বের ওপর সংক্ষিপ্ত আলোচনা করলেন।
ফেরার সময় আমাকে বললেন, আমাদের দেশের নিয়ম অনুযায়ী ওরা দেরি করেছে, আমি আমার নিয়ম অনুযায়ী সঠিক সময়ে এসেছি, এতে রাগ করার কী আছে?
তিন. নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর জনসমাবেশে বললেন, আমার প্রতিদ্বন্দ্বী ভাইয়েরাও বিজয়ী হয়েছেন। আমি সামান্য নম্বর পেয়ে প্রথম হয়েছি। উনারা দ্বিতীয়, তৃতীয় হয়েছেন। বিজয় মিছিল হলে সকলকে নিয়ে হবে। একথা বলে বিজয় মিছিল না করার নির্দেশ দিলেন।
চার. তিনি জাতীয় সংসদে সর্বপ্রথম সিলেট বিভাগের দাবি উত্থাপন করেন। স্পিকার তাকে বসার কথা বললে তিনি বজ্রকণ্ঠে বললেন, আমি এক কোটি সিলেটবাসীর পক্ষ হতে দাঁড়িয়েছি মাননীয় স্পিকার! আমাকে বসার কথা বলবেন না, স্পিকার সময় দিতে বাধ্য হলেন।
পাঁচ. জাতীয় সংসদের বিশেষ অধিবেশনে চলছে। দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদীয় সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হলো। সে দিন তিনি উলামায়ে দেওবন্দের এক সফল উত্তরসূরি হিসেবে সাহসী কণ্ঠে বললেন, মানবরচিত যে সংবিধান বার বার সংশোধন করতে হয়, এর মাধ্যমে জাতির ভাগ্যের পরিবর্তন হবে না। জাতির ভাগ্যের পরিবর্তন হতে পারে একমাত্র সে সংবিধানের মাধ্যমে যার শুরুতে বলা হয়েছে লা রাইবা ফিহি, কুরআন কারিমই এমন সংবিধান যার কোনো সংশোধন করতে হয় না। ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থার পক্ষে এমন তাৎপর্যপূর্ণ বক্তব্য আর শোনা যায়নি।
ছয়. একজন সংসদ সদস্য হওয়া সত্ত্বেও প্রচারবিমুখ ছিলেন। প্রয়োজন ছাড়া সামাজিক ও দীনি কর্মসূচির সংবাদ ও ছবি প্রচারে বিমুখ থাকলেন। অনেক সময় বলতেন- আমরা আলেমগণ ইসলামের খেদমত করছি না। ইসলামই আমাদের খেদমত করছে।
সাত. নাস্তিক মুরতাদবিরোধী আন্দোলনের সূচনায় এক মাসের অধিক সময় কারাগারে ছিলাম। মহাব্যস্ততা থাকার পরও হুজুর আমাদের তিন দিন দেখতে গেলেন। শেষ দিন বললাম- হুজুর, এত কষ্ট করে আমাদের বারবার দেখতে আসার কী দরকার? আপনাদের দোয়ায় আমরা ভালোই আছি। হুজুর মজা করে বললেন, আমি একজন আলেম, উস্তাদ আর সাধারণ মুসলমান হিসেবে ঈমানি দায়িত্ব পালনে তোমাদের তিন দিন দেখেছি। এমপি হিসাবে তোমাদের দেখতে এসে মুক্ত করে নিয়ে যাবো। আলহামদুলিল্লাহ, সপ্তাহখানেকের মধ্যেই আমরা কারাগার থেকে মুক্তি পাই।
আল্লামা ওবায়দুল হক রহ. আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু তার রাজনৈতিক, সামাজিক, দ্বীনি খেদমতের ধারা আদর্শ আমাদের যুগ যুগ প্রেরণা যোগাবে। হজরতের সুযোগ্য নাতি স্নেহভাজন মুফতি সালাতুর রাহমান মাহবুব তার স্মরণে বহুবিধ কর্মসূচি হাতে নিয়েছেন। মানবতার সেবায় ওবায়েদ ফাউন্ডেশন ব্যাপক কাজ করছে। আল্লামা ওবায়দুল হক রহ. মাদরাসাও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আল্লাহ তাঁকে জান্নাতের উঁচু মাকাম দান করুন। আমিন।
লেখক: সিনিয়র মুহাদ্দিস, জামিয়া মাদানিয়া কাজিরবাজার, সিলেট।
আরএইচ/