মুফতি এনায়েতুল্লাহ
আজ প্রথম আলো রাজনৈতিক দলগুলো নিয়ে একটি জরিপ প্রকাশ করেছে। জরিপ নিয়ে নানা চুলচেরা বিশ্লেষণ হচ্ছে। অবাক করার মতো বিষয় হলো, জরিপে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী (দাঁড়িপাল্লা) বাদে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ (হাতপাখা)-এর পক্ষে মত এসেছে শূন্য দশমিক ১ শতাংশ উত্তরদাতার।
অন্য কোনো ধর্মভিত্তিক দলের কথা বা প্রসঙ্গ আসেনি। তার মানে, অন্য ইসলামি দলগুলো এখনও সাধারণ মানুষের মনে দাগ কাটতে পারেনি? না জরিপকারী কর্তৃপক্ষ তাদের প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেছেন? আমার মতে, এই জরিপ ধর্মভিত্তিক দলগুলোর জন্য এক অশনি সংকেত। তবে এই জরিপ থেকে শেখার আছে অনেক কিছু।
ইসলামি দলগুলোর মধ্যে- বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন (বটগাছ), জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ (খেজুরগাছ), ইসলামী ঐক্যজোট (মিনার), বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস (রিক্সা) ও খেলাফত মজলিস (দেওয়াল ঘড়ি) রাজনীতির মাঠে ভালোভাবেই তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
এর বাইরে জাকের পার্টি (গোলাপ ফুল), বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন (ফুলের মালা), ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ (চেয়ার), বাংলাদেশ মুসলিম লীগ (হারিকেন), বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট (মোমবাতি), বাংলাদেশ মুসলিম লীগ-বিএমএল (হাত- পাঞ্জা), ইনসানিয়াত বিপ্লব বাংলাদেশ (আপেল) ও বাংলাদেশ সুপ্রীম পার্টি বি.এস.পি (একতারা) নামে আরও কয়েকটি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল রয়েছে। যদিও তাদের কাজ সেভাবে চোখে পড়ে না।
কিন্তু মাঠে রয়েছেন, সরকারের সঙ্গে নিয়মতি রাজনৈতিক বৈঠকে যাচ্ছেন, তারা কেন জরিপ থেকে বাদ যাবেন, মানুষ তাদের কথা বলবে না- তা বোধগম্য নয়। এই ব্যর্থতা আসলে কার রাজনৈতিক দলগুলোর না জরিপকারী প্রতিষ্ঠানের। আমি মনে করি, এখান থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর শিক্ষা নেওয়ার মতো বিষয় রয়েছে।
এটা ঠিক যে, দেশের সাধারণ মানুষের মাঝে ধর্মভিত্তিক দল নিয়ে এক ধরনের বীতশ্রদ্ধ মনোভাব রয়েছে। আর মিডিয়াও সেভাবে তাদের প্রমোট করে না। এই অচলাবস্থা কাটিয়ে ওঠতে হবে।
ভোটের মাঠের বৈরীভাবাপন্নদের কাছে টানার উদ্যোগ নিতে হবে। পারস্পরিক অসহনশীল আচরণ ও অবিশ্বাসপূর্ণ সম্পর্ক যেভাবে বাড়ছে, তা কমানোর জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করতে হবে।
কর্মসংস্থান, শ্রমিক ইস্যু, ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও বঞ্চনার মতো সামাজিক বিষয়গুলো রাজনৈতিক কর্মসূচিতে আনতে হবে। শুধু ধর্মীয় ইস্যু নিয়ে মাঠে থাকলে চলবে না। দেশের সামগ্রিক বিষয় নিয়ে মতামত জানানোর পাশাপাশি আলাদা প্রস্তাবনা, প্রয়োজনে কর্মসূচি ও নীতি প্রণয়ন করতে হবে।
প্রায়ই দেখা যায়, ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো ধর্মীয় ইস্যুর বাইরে তারা খুব একটা কথা বলেন না। এছাড়া নেতৃত্বে যারা আছেন- তাদের কারও কারও বক্তব্য অনেক সময় সাধারণ ভব্যতার সীমা ছাড়িয়ে যায়। কে, কাকে, কত বেশি নিম্নমানের ভাষা ব্যবহার করে রাজনৈতিকভাবে ঘায়েল করতে পারবেন, তা নিয়ে এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক প্রতিযোগিতা চলতে থাকে। এগুলো থেকে বের হয়ে আসতে হবে।
গণমানুষের আকাঙ্খা বুঝে কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হবে। কোন পথে ভোটারের আনুকূল্য পাওয়া সম্ভব- সেটা নিয়ে ভাবতে হবে। এক কথায়, শুধু নির্বাচন করার জন্য নির্বাচন নয় বরং নির্বাচন নিয়ে নানা ধরনের হিসাব-নিকাশ, আলোচনা-পর্যালোচনা, পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করে মাঠে নামতে হবে।
রাজনৈতিক দলগুলো যতদিন পর্যন্ত পরস্পর পরস্পরকে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী না ভেবে শত্রু ভাববে, ততদিন পর্যন্ত দেশে গণতন্ত্র সুসংহত হবে না। দেশে সত্যিকারভাবে গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে এবং গণতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক অসহিষ্ণু আচরণের পরিবর্তন করতে হবে। জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহির বিষয়টি সুনিশ্চিত করতে হবে। দেশের জনগণের প্রতি আস্থা রাখতে হবে সব সময়।
এমনিতে এখন রাজনীতিতে মেধা নেই ফলে মনন তৈরি হয় না। এ জন্য রাজনীতির এই দশা। রাজনীতি মেধাহীনতায় ছেয়ে গেছে। মেধাহীনরা বিভিন্ন জায়গায় বসে আছেন। তাই রাজনৈতিক মানুষ তৈরি হচ্ছে না। এমন অভিযোগের মাঝে ধর্মভিত্তিক দলগুলোও যদি আলাদা কোনো কিছু করতে না পারে, জনমানসে ছাপ ফেলতে না পারে। তাহলে অন্য দলগুলোর সঙ্গে তাদের আর কী পার্থক্য রইল? বিষয়টি নিয়ে ভাবার মতো সময় কী আছে নেতাদের?
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
আরএইচ/