বাংলাদেশি পাসপোর্টে ‘একসেপ্ট ইসরাইল বা ইসরাইল ব্যতীত’ শব্দগুলো যোগ করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার আট মাসেও তা কার্যকর হয়নি। বিষয়টি নিয়ে অসন্তোষ বিরাজ করছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এ জন্য পাসপোর্ট অধিদপ্তরকে দায়ী করছেন। তবে ‘টেকনিক্যাল’ সমস্যার কথা বলছে অধিদপ্তরের কর্তারা। এ তথ্য জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশের নাগরিকদের সব সময় ইহুদিবাদী ইসরাইল ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আছে। এছাড়া ভূখণ্ডটির সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কসহ বাংলাদেশের কোনো ধরনের কূটনৈতিক সম্পর্কও নেই। এসব কারণে বাংলাদেশি নাগরিকদের সব পাসপোর্টে ‘দিস পাসপোর্ট ইজ ভেলিড ফর অল কান্ট্রিজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড একসেপ্ট ইসরাইল’ লিখে দেওয়া হতো। ২০২০ সালে শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন সরকার পাসপোর্টের এ পাতার লেখাটিতে সংশোধন এনে ‘একসেপ্ট ইসরাইল’ শব্দ দুটি বাদ দেয়। এতে লেখা হয় ‘দিস পাসপোর্ট ইজ ভেলিড ফর অল কান্ট্রিজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড।’
ইসরাইলের ’ইসরাইল’ হয়ে উঠতে পারার পেছনে প্রধান ভূমিকা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের’’ইসরাইলের ’ইসরাইল’ হয়ে উঠতে পারার পেছনে প্রধান ভূমিকা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের’ ইসরাইলের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের অংশ হিসেবে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার এ উদ্যোগ নিয়েছিল বলে মনে করছেন কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, এ উদ্যোগের পেছনে ভারত সরকারের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ ছিল। ভারত ও ইসরাইলের মধ্যকার কূটনৈতিক সম্পর্ক অত্যন্ত দৃঢ়। তাদের মধ্যে বিশাল অঙ্কের বাণিজ্যিক সম্পর্কও আছে।
বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে গণমাধ্যমে বক্তব্য দেওয়ার অনুমতি না থাকায় নাম প্রকাশ না করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, পাসপোর্টে ইসরাইল ভ্রমণ সংক্রান্ত বিধিনিষেধ প্রত্যাহারের পর থেকেই ভারতের মাধ্যমে ইহুদিবাদী ভূখণ্ডটি থেকে বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি কেনার দিকে ঝুঁকে পড়েছিল বাংলাদেশ। এমন কিছু তথ্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নথিতেও আছে।
২০২৩ সালের ইসরাইলি সংবাদমাধ্যম হারেৎজের একটি প্রতিবেদনের তথ্য তুলে ধরে ওই কর্মকর্তা বলেন, ইসরাইলভিত্তিক সরবরাহকারীর কাছ থেকে বাংলাদেশের জাতীয় টেলিযোগাযোগ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে সংযুক্ত করার জন্য নজরদারি সরঞ্জাম কেনা হয়েছে। হারেৎজের প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, ওই সিস্টেমের সঙ্গে নজরদারির সরঞ্জাম ও ট্র্যাকিং সফটওয়্যার যুক্ত একটি ভ্যান সরবরাহ করা হয়। এটি মোবাইল অথবা ওয়াইফাই নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ব্যবহারকারীদের ফোনে অনুপ্রবেশ করে এবং সেখান থেকে ‘এনক্রিপ্ট করা হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ, ফেসবুক চ্যাট, কন্টাক্ট লিস্ট, কল ও এসএমএসসহ বিভিন্ন ধরনের তথ্য সংগ্রহ করতে পারে। এটি আধা কিলোমিটার আওতার মধ্যে কাজ করতে পারে। এই সিস্টেমের মাধ্যমে রেঞ্জের মধ্যে থাকা কম্পিউটার ও মোবাইল ফোনে স্পাইওয়্যারের অনুপ্রবেশ ঘটানো সম্ভব।’
২০১৯ সালে ইসরাইলি একটি প্রতিষ্ঠানকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কার্যালয় থেকে এ সংক্রান্ত কার্যাদেশ (অর্ডার) দেওয়ার তথ্যও ওই সংবাদমাধ্যমে উল্লেখ করা হয়।
পাসপোর্ট থেকে ‘একসেপ্ট ইসরাইল’ শব্দগুলো বাদ দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের কাছে, যিনি গত বছর ৫ আগস্ট জুলাই বিপ্লবে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পালিয়ে ভারতে গিয়ে দেশটির আশ্রয়ে আছেন, সাংবাদিকরা জানতে চেয়েছিলেন। জবাবে কামাল ওই সময় সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, ‘পাসপোর্ট থেকে ইসরাইলে ভ্রমণের নিষেধাজ্ঞা সংক্রান্ত কথাগুলো বাদ দেওয়ার বিষয়টি বড় কোনো ঘটনা নয়। পাসপোর্টকে বিশ্বজনীন করতেই সরকার এ উদ্যোগ নিয়েছে।’ ওই সময় তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন বিষয়টি পুরোপুরি এড়িয়ে গিয়ে বলেছিলেন, ‘এমন কোনো সিদ্ধান্তের বিষয়ে আমি অবগত নই।’
অকার্যকর অন্তর্বর্তী সরকারের সিদ্ধান্ত
গত ৭ এপ্রিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটির সভায় ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ইসরাইলের বিষয়ে নেওয়া নীতি পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেই সঙ্গে পাসপোর্টে ‘একসেপ্ট ইসরাইল’ শব্দগুলো প্রতিস্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়।
ওইদিন এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি প্রজ্ঞাপনও জারি করেছিল। এতে উল্লেখ করা হয়, ওই বিষয়ের পরিপ্রেক্ষিতে যথাযথ প্রক্রিয়া অবলম্বন করে আগের মতো বাংলাদেশি পাসপোর্টে ‘ইসরাইল ব্যতীত’ শর্ত পুনর্বহালের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এ প্রজ্ঞাপন জারির পর ৮ মাস পার হলেও সরকারের সিদ্ধান্ত কার্যকর না হওয়ার বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখার এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, গত সপ্তাহে আমি পাসপোর্ট করেছি। নতুন পাসপোর্টে ‘একসেপ্ট ইসরাইল বা ইসরাইল ব্যতীত’ শব্দগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের পাসপোর্টই আমি হাতে পেয়েছি। ৬৪ পৃষ্ঠার মধ্যে বিশাল অংশ জুড়ে শেখ পরিবার-সংশ্লিষ্ট ছবিগুলো হুবহু আছে।
এক প্রশ্নের জবাবে ওই কর্মকর্তা জানান, ‘আমরা সরকারের এ সিদ্ধান্ত তাৎক্ষণিকভাবে পাসপোর্ট অধিদপ্তরকে অবহিত করেছি। সরকার এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপনও জারি করেছে। সরকারের এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের দায়িত্ব পাসপোর্ট অধিদপ্তরের। তারা এখনো এটি করেনি। এ বিষয়ে কোনো তথ্যও মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়নি।’
এ বিষয়ে পাসপোর্ট অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল নুরুল আনোয়ারের বক্তব্য নেওয়ার চেষ্টা করছি। অফিসে যোগাযোগ করা হলে ব্যক্তিগত কর্মকর্তা রিপোর্টের বিষয় জানতে চান। বিষয় জানানো হলে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে আপনি স্যারের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করেন ও বিষয়টি লিখে ম্যাসেজ দিন। স্যার সময় করে জবাব দেবেন।’
ব্যক্তিগত কর্মকর্তার পরামর্শ অনুযায়ী মহাপরিচালকের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি। এমনকি ম্যাসেজ পাঠালেও কোনো জবাব মেলেনি। তবে গণমাধ্যমে বক্তব্য দেওয়ার অনুমতি না থাকায় নাম প্রকাশ না করে পাসপোর্ট অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা জানান, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত ও প্রজ্ঞাপন তারা পেয়েছেন। এ বিষয়ে আমাদের কার্যক্রম চলমান আছে। তবে ‘টেকনিক্যাল’ কিছু সমস্যার কারণে কাজটি হচ্ছে না।
এনএইচ/