গাজায় গণহত্যার তৃতীয় বছরের শুরুতে হামাস ও ইসরাইলের মধ্যে পরোক্ষ আলোচনার মাধ্যমে এবং মিশর, তুরস্ক, কাতার ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি সই হয়েছে এবং আনুষ্ঠানিকভাবে গাজা যুদ্ধের সমাপ্তি এলান করা হয়েছে।
এই চুক্তি বিভিন্ন কারণে হামাসের জন্য একটি বড় বিজয় এবং দখলদার ইসরাইলের জন্য পরাজয় হিসেবে দেখা হচ্ছে। ইসরাইল গত দুই বছর ধরে হামাসকে ধ্বংস ও গাজা দখলের লক্ষ্য নিয়ে নজিরবিহীন গণহত্যা চালিয়েছে। কিন্তু দুই বছর পরও হামাস টিকে আছে এবং শেষ পর্যন্ত ইসরাইলকেই হামাসের সঙ্গে সমঝোতা করতে বাধ্য হতে হয়েছে।
অন্যদিকে, যুদ্ধ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গাজায় শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনের ঢেউও শুরু হয়েছে। এর ফলে গাজার জনগণকে জোরপূর্বক স্থানান্তর এবং পুরো গাজা অঞ্চল দখলের পরিকল্পনাও কার্যত ব্যর্থ হয়েছে।
চুক্তির কিছু ধারা হামাসের জন্য বিশেষ অর্জন হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। যেমন- ২০ জন ইসরাইলি বন্দির বিনিময়ে প্রায় দুই হাজার ফিলিস্তিনি বন্দি মুক্তি পাবেন, যাদের মধ্যে ২৫০ জন যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত। দখলদার ইসরাইল এই শর্তটি মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে, কারণ নেতানিয়াহু দুই বছর যুদ্ধ চালিয়েও সামরিক উপায়ে বন্দিদের মুক্ত করতে পারে নি এবং শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক চুক্তির পথে হাঁটতে বাধ্য হয়েছে।
চুক্তি অনুযায়ী ইসরাইলি সেনারা গাজায় দখলকৃত অঞ্চলগুলো থেকে সরে যাবে। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন, কারণ নেতানিয়াহু ও তার মন্ত্রিসভা গাজার পূর্ণ দখলকেই তাদের প্রধান লক্ষ্য হিসেবে ঘোষণা করেছিল।
চুক্তির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা হলো — গাজার প্রশাসন ফিলিস্তিনিদের হাতে থাকবে। ইসরাইলের ভেতরে নেতানিয়াহুর সমালোচকরা মনে করেন, এই সিদ্ধান্তের অর্থ হলো যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল কার্যত একটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের অস্তিত্ব স্বীকার করেছে।
সমালোচকদের মতে, এটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের পক্ষে বৈশ্বিক প্রচেষ্টার একটি ঐতিহাসিক সাফল্য।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো হামাসকে নিরস্ত্র করা। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল এ দাবি তুললেও এ বিষয়ে কোনো চুক্তি হয়নি। হামাসের মুখপাত্র হাজেম কাসেম বলেছেন, ‘হামাস কখনো তার অস্ত্র ত্যাগ করবে না; এই অস্ত্র ফিলিস্তিনিদের আত্মরক্ষার জন্য।’
তবে অনেকেই আশঙ্কা করছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল বিশ্বাসযোগ্য কোনো পক্ষ নয়, তাদেরকে কোনোভাবেই বিশ্বাস করা যায় না। তারা ইসরাইলি বন্দিদের মুক্তির পর আবারও হামাস ধ্বংস ও গাজা দখলের উদ্দেশ্যে নতুন যুদ্ধ শুরু করতে পারে।
যদিও এই অবিশ্বাস ও অনাস্থা যৌক্তিক এবং অতীত অভিজ্ঞতায় প্রমাণিত। আর ইসরাইল যদি চুক্তি ভঙ্গ করে পুনরায় যুদ্ধ শুরু করে, তাহলে তা যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক ভাবমূর্তিতে বড় আঘাত হানবে।
অন্যদিকে, এর ফলে হামাসের সামরিক সক্ষমতায় কোনো প্রভাব পড়বে না, কারণ তারা এখনো নিরস্ত্র নয় এবং প্রয়োজনে প্রতিরোধ চালিয়ে যেতে পারবে।
সবশেষে বলা যায়, গাজা যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটল সেই অক্টোবর মাসেই— ঠিক যেমন ‘আল-আকসা তুফান’ অভিযানও ২০২৩ সালের অক্টোবরে শুরু হয়েছিল। তবে এই যুদ্ধের সমাপ্তিটা ইসরাইলের সামরিক বিজয়ের মধ্যদিয়ে ঘটেনি বরং গাজার জনগণের অদম্য প্রতিরোধ ও ঐক্যের ফলে এই যুদ্ধ বন্ধ হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে হামাসের প্রভাবশালী নেতা মাহমুদ মারদাওয়ি বলেছেন, ‘গাজা তার ঐক্য ও দৃঢ়তার মাধ্যমে বিজয় অর্জন করেছে এবং জবরদস্তি ও দখলদার শক্তির ওপর নিজের ইচ্ছা চাপিয়ে দিয়েছে। এই যুদ্ধবিরতি কারও দয়া নয়; এটি আমাদের জনগণের কিংবদন্তিতুল্য ধৈর্য বিশেষ করে গাজার মুজাহিদদের ত্যাগ ও বীরত্বের ফসল, যারা ৭ অক্টোবরের বীরত্বগাথা রচনা করেছে।’
এলএইস/