সোমবার, ০৪ আগস্ট ২০২৫ ।। ২০ শ্রাবণ ১৪৩২ ।। ১০ সফর ১৪৪৭

শিরোনাম :
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহসচিবের সাথে ইরানি প্রতিনিধি দলের সাক্ষাৎ  ‘ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে আলেম-ওলামার সক্রিয় ভূমিকা ছিল’ ‘বসিলা আন্দোলন জমানোর পিছনে আমাদের মাদ্রাসার বড় ভূমিকা ছিল’ ১১ মাসে রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত ১২১, আহত ৫ হাজারের বেশি: টিআইবি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি নিয়ে সরকারের নতুন পরিকল্পনা চাকরি পাওয়া মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের তথ্য যাচাই করছে সরকার : ফারুক-ই-আজম সাদিক কায়েম প্রসঙ্গে কাদেরের স্ট্যাটাসের জবাবে মুখ খুললেন এনসিপি নেতা  দেহের জন্য রক্ত যেমন, দেশের জন্য প্রবাসীরা তেমন: শায়খে চরমোনাই ইসরায়েলি অবরোধের কারণে গাজায় দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে: জার্মানি চট্টগ্রাম ক্লাবের গেস্ট হাউজ থেকে সাবেক সেনাপ্রধানের মরদেহ উদ্ধার

ইদারাতুল মাআরিফ ও আলেমদের সাংবাদিকতা চর্চার ছয় দশক

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার
ছবি: সংগৃহীত

আতাউর রহমান খসরু

ইসলাম কোনো প্রথাসর্বস্ব ধর্ম নয়, বরং তা একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। তাই সূচনালগ্ন থেকে ইসলামের চর্চা সামগ্রিক। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুধু ইসলামের বিধি-বিধান শিক্ষা দিয়ে নিজের দায়িত্ব শেষ করেননি, তিনি ইসলাম ও মুসলমানের অনুকূল একটি সমাজ ও সাংস্কৃতিক আবহ তৈরির প্রয়াসও পেয়েছিলেন। তিনি মুসলিম জাতির সামনে ইসলামি সমাজ ও সংস্কৃতির রূপরেখা পেশ করেছেন, প্রচলিত সমাজ-সংস্কৃতিকে জাহেলিয়্যাতমুক্ত করে মুসলমানের উপযোগী করেছেন। যুগে যুগে উলামায়ে কেরাম মুসলিম জাতিকে ‘নব্য জাহেলিয়্যাত’ থেকে মুক্ত রাখতে বহুমুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। সময়ের দাবি অনুসারে তাদের উদ্যোগে এসেছে নানা বৈচিত্র্য ও পরিবর্তন।

দুই.
বিংশ শতাব্দীর শুরুভাগ থেকে গণমাধ্যম ও মিডিয়া জাহেলিয়্যাতের নতুন বাহক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এর প্রধান লক্ষ্য হলো পশ্চিমা শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রসার ঘটিয়ে সাম্রাজ্যবাদের শিকড় মজবুত করা। দেশে দেশে আলেমরা নব্য জাহেলিয়্যাতের এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন এবং বিকল্প ব্যবস্থা গড়ে তুলেছেন। যদিও মিডিয়ায় ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর সম্মিলিত বিনিয়োগ, তথ্য-প্রযুক্তির ওপর পশ্চিমা আধিপত্য এবং মুসলিম দেশগুলোর ওপর দীর্ঘ ঔপনিবেশিক শাসনের কুপ্রভাবে আলেমদের অনেক উদ্যোগই আলোর মুখ দেখেনি অথবা তার কাক্সিক্ষত বিকাশ ঘটেনি। বাংলাদেশে এমন একটি সোনালি উদ্যোগের নাম ‘ইদারাতুল মাআরিফ’। যা বাংলা ভাষায় ইসলামি জ্ঞানচর্চার অন্যতম পথিকৃৎ মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী রহ.-এর প্রচেষ্টায় ১৯৬৭ সালে ঢাকার ফরিদাবাদে প্রতিষ্ঠিত হয়। 

এই প্রতিষ্ঠানের এক সময়ের শিক্ষক, যিনি পরবর্তী সময়ে প্রতিষ্ঠানের পরিচালকও হন অধ্যক্ষ আব্দুর রাজ্জাক ইদারাতুল মাআরিফের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেন, ইসলামের শাশ্বত শিক্ষা, কুরআন-সুন্নাহভিত্তিক গবেষণা এবং মানবজাতির নিকট ইসলামকে একমাত্র মুক্তি সনদ হিসেবে উপস্থাপিত করার উদ্দেশ্যে লেখক ও সাংবাদিক সৃষ্টি করাই ছিল এর উদ্দেশ্য। 

ইদারাতুল মাআরিফের কারিকুলাম ও পাঠক্রম অত্যন্ত বাস্তবসম্মত ও আধুনিক। এখানে দুই বছর মেয়াদী প্রশিক্ষণ কোর্স বাধ্যতামূলকভাবে চালু করা হয়। প্রথম বছর রাজনীতি, অর্থনীতি, ইংরেজি, ভূগোল, ইতিহাস, দর্শন, বিজ্ঞান প্রভৃতির মৌলিক জ্ঞানের সাথে ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্য’ এবং সাংবাদিকতার মৌলিক বিষয়গুলো শিক্ষা দেওয়া হতো। পরবর্তী বছরে উপযুক্ত গবেষণা-নির্দেশকের অধীনে নির্দিষ্ট বিষয়ে গবেষণাপত্র; পুস্তিকা রচনার ব্যবস্থা করা হতো।

তিন.
ইদারাতুল মাআরিফের সৌভাগ্য হলো, তা শুরু থেকে যুগশ্রেষ্ঠ আলেমদের নেতৃত্ব লাভ করেছে। এই প্রতিষ্ঠানের প্রথম সভাপতি ছিলেন কিংবদন্তি আলেম মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী রহ.। তাঁর পর দ্বিতীয় সভাপতি হন জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়ার মহাপরিচালক ও বিখ্যাত আলেমে দীন মাওলানা হাজী মুহাম্মদ ইউনূস রহ.। বহু গ্রন্থ প্রণেতা ও শিক্ষা-সংস্কার আন্দোলনের উজ্জ্বল নক্ষত্র মাওলানা নূর মুহাম্মদ আযমী রহ. ছিলেন এর তত্ত্বাবধায়ক। প্রতিষ্ঠাকালে প্রতিষ্ঠানের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন পটিয়া মাদরাসার অপর মহাপরিচালক মাওলানা হারুন ইসলামাবাদী রহ.। পরবর্তী সময়ে তাঁর স্থানে নিযুক্ত হন মাওলানা মুহিউদ্দীন খান রহ.। শেষের দিকে এর পরিচালক নিযুক্ত হন অধ্যক্ষ আব্দুর রাজ্জাক রহ.।

চার.
এতো মহৎ উদ্দেশ্য ও বরেণ্য ব্যক্তির ছায়া পেয়েও ইদারাতুল মাআরিফ টিকে ছিল মাত্র এক দশক। এই প্রতিষ্ঠানটির পৃষ্ঠপোষকতা করতো বিখ্যাত জামিল গ্রুপ। ব্যবসায়িকভাবে তারা লোকসানের মুখে পড়লে অর্থের সংস্থান বন্ধ করে দেন। এতে ১৯৭৬ সালে আর্থিক সংকটে ইদারা বন্ধ হয়ে যায়। তবে এক দশকের যাত্রায় ইদারাতুল মাআরিফ ফলশূন্য ছিল না। সে সময়ের শিক্ষার্থীদের ভেতর অনেকেই পরবর্তী সময়ে কৃতী লেখক হন এবং ইদারার অধীনে একাধিক বইও প্রকাশিত হয়। পাশাপাশি তৈরি হয়েছিল একদল চিন্তার উত্তরসূরি। প্রথম যাত্রায় ইদারার একজন কৃতী সন্তান হলেন লেখক ও সম্পাদক মনযুর আহমদ। আর এ সময়ে প্রকাশিত কয়েকটি বই হলো-ইসলাম ও কমিউনিজম, ইসলাম ও পুঁজিবাদ, খ্রীষ্টান ধর্মের ঐতিহাসিক সমীক্ষা, ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। প্রতিষ্ঠানের অর্থে বা সহযোগিতায় প্রকাশিত কয়েকটি বই হলো, ইসলামের অর্থনৈতিক সংস্কার, ইসলামী অর্থব্যবস্থার মূলনীতি ও রাশিয়ার করাল গ্রাসে তুর্কিস্তান ইত্যাদি।

পাঁচ.
আর্থিক অনটনে বন্ধ হয়ে যাওয়ার প্রায় এক দশক পর মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী ও মাওলানা নূর মুহাম্মদ আযমী রহ.-এর চিন্তার উত্তরসূরিরা পুনরায় ইদারাতুল মাআরিফের প্রাণসঞ্চার করেন। ১৯৮৬ সালে মিরপুরের মুসলিম বাজার মাদরাসায় শুরু হয় প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম। তবে অল্প কিছুদিন পর পুনরায় তা বন্ধ হয়ে। এ সময় ইদারাতুল মাআরিফের শিক্ষার্থী প্রবীণ সাংবাদিক ও মুহাদ্দিস মাওলানা লিয়াকত আলী, বিশিষ্ট লেখক মুফতি আবদুল হালিম ও মাওলানা কাসেম ফয়জুদ্দীন প্রমুখ। 

১৯৯৮ সালে মাওলানা মুহাম্মাদ সালমানের হাত ধরে মাদরাসা দারুর রাশাদে ইদারার নবযাত্রা শুরু হয়। তবে নাম রাখা হয় বায়তুল মাআরিফ। যদিও পরিচিতি পায় ইদারাতুল মাআরিফ নামেই। ২০০৪ সালে সেই নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী রহ. এডুকেশন সেন্টার। মাওলানা মুহাম্মাদ সালমান মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী রহ.-এর ভাবশিষ্য এবং সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী রহ.-এর খলিফা। আর তাঁরা উভয়ই ছিলেন সমাজমুখী ও বৈশ্বিক চিন্তার অধিকারী। যার প্রভাব মাওলানা মুহাম্মাদ সালমানের কাজে-কর্মে স্পষ্ট। তিনি প্রচলিত ধারার বাইরে ইসলামের এমন খেদমতের দিকে মনোযোগ দিয়েছেন যার মাধ্যমে সরাসরি সমাজের সাধারণ মানুষ উপকৃত হয় এবং সহজেই সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছা যায়।

ছয়.
প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রায় তিন দশক যাবত মাদরাসা দারুর রাশাদের সাংবাদিকতা বিভাগের কার্যক্রম অব্যাহত আছে। মাওলানা মুহাম্মাদ সালমান এখনো প্রতিষ্ঠানটির হাল ধরে রেখেছেন। পাশে থেকে তাঁকে সহযোগিতা করে যাচ্ছেন মাওলানা লিয়াকত আলী। এখানের অনেক শিক্ষার্থী এখন বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক ও সংবাদ মাধ্যমে কাজ করছেন। যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেন জহির উদ্দিন বাবর, মুহাম্মদ ফয়জুল্লাহ, আলী হাসান তৈয়ব, আতাউর রহমান খসরু, এমদাদুল হক তাসনিম, নুরুদ্দীন তাসলিম প্রমুখ। কোনো সন্দেহ নেই, তিন দশকের এই যাত্রাই সার্থকতার সমার্থক। তবু বলতে হবে মাওলানা মুহাম্মাদ সালমানের কর্ম-ক্ষমতার সঙ্গে সঙ্গে যেন প্রতিষ্ঠানটি তার জৌলুসও হারাচ্ছে। দুই বছরের কোর্স এক বছরে নেমে এসেছে। সাংবাদিকতা বিভাগে কমেছে পেশাদার সাংবাদিক ও খ্যাতিমান লেখকদের আনাগোনা। দারুর রাশাদের সাংবাদিকতা ও দাওয়াহ বিভাগের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেকের মতো আমিও শঙ্কিত।

সাত.
আলেমদের পরিচালিত সাহিত্য ও সাংবাদিকতা বিষয়ক প্রতিষ্ঠানগুলো সবল ও সফল হয়ে উঠতে না পারলেও লেখালেখি ও সাংবাদিকতার প্রতি তরুণ আলেমদের আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে। এই আগ্রহের জায়গা থেকে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের নানা প্রান্তে সাহিত্য ও সাংবাদিকতা বিষয়ক বহু কর্মশালার নিয়মিত আয়োজন করা হচ্ছে। একদিন, এক সপ্তাহ, এক মাস ও তিন মাসব্যাপী এসব কর্মশালার সুফলও কম নয়।

এসব কর্মশালা থেকে শিক্ষার্থীরা শুধু অনুপ্রেরণাই পায় না, বরং গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনাও পেয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে আওয়ার ইসলাম ও তার সম্পাদক মাওলানা হুমায়ুন আইয়ুবের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তার উদ্যোগে বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড বেফাকের তত্ত্বাবধায়নে ভাষা শিক্ষা ও সাংবাদিকতার কোর্স হয়েছিল। যা সে সময় বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে। ২০১৮ সালে তিনি তাঁর মুগদার মাদরাসায় এক বছর মেয়াদি একটি সাংবাদিকতার কোর্সও চালু করেছিলেন। যে কোর্সের শিক্ষার্থী মাওলানা কাউসার লাবীব বর্তমানে জাতীয় দৈনিকে কর্মরত। অবশ্য কোর্সটির ধারাবাহিকতা রক্ষা করা যায়নি। 

কয়েক বছর যাবত আওয়ার ইসলামের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশ ইসলামি লেখক ফোরাম নিয়মিত ভাষা শিক্ষা ও সাংবাদিকতার কোর্স পরিচালনা করে আসছে। যা এরই মধ্যে তরুণদের ভেতর আশা সঞ্চার করেছে। এছাড়াও সংগঠনটি প্রতিষ্ঠার প্রায় এক যুগে যাবত সাহিত্য ও সাংবাদিকতার ওপর অসংখ্য কর্মশালা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। যা তরুণ লেখক ও সংবাদকর্মীদের পথচলাকে মসৃণ করেছে, তাদের এগিয়ে যেতে অনুপ্রাণিত করেছে।

আট.
বাংলাদেশে আলেমদের প্রাতিষ্ঠানিক সাংবাদিকতা চর্চার প্রায় ছয় দশক পূর্ণ হতে চলেছে। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো, ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সাংবাদিকতার ওপর শক্তিশালী কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। আলেম সমাজ সাহিত্য ও সাংবাদিকতায় কাক্সিক্ষত প্রতিনিধিত্ব তৈরি করতে পারেনি। এর পেছনে যেমন সমাজের সাধারণ মানুষ চিন্তা ও মানসিকতা, মিডিয়া জগতের নিয়ন্ত্রকদের ভ্রষ্টাচার ও রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি দায়ী, তেমনই দায় আছে আলেমদেরও। আমার মনে হয়, একবিংশ শতাব্দীতে এসেও এদেশের বেশির ভাগ আলেম মাদরাসা-মসজিদের সংখ্যা বৃদ্ধি করাকে যতটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন, ভাষা-সাহিত্যে নিজস্ব ভাষ্য তৈরি করা এবং গণমাধ্যম সৃষ্টিকে ততটাই গুরুত্বহীন মনে করেন। নতুবা এই দেশে ১০ বছরে একটি দাওরায়ে হাদিস মাদরাসা স্বাবলম্বী হয়ে উঠতে পারলে, ছয় দশকে কেন একটি ইদারাতুল মাআরিফ গড়ে ওঠে না! এই দুঃখ ও ব্যর্থতা জাতি হিসেবে আমাদের সবার।

লেখক: সহ-সম্পাদক, দৈনিক কালের কণ্ঠ

[লেখা ও লেখকের কথা নিয়ে প্রকাশিত ত্রৈমাসিক সাহিত্য সাময়িকী লেখকপত্রের ২৫তম সংখ্যার সৌজন্যে লেখাটি প্রকাশিত হলো]

এমএইচ/


সম্পর্কিত খবর

সর্বশেষ সংবাদ