||ডা.মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ||
বাংলাদেশের আবহাওয়ায় বাচ্চাদের বারবার ঠান্ডা লাগা একটি পরিচিত সমস্যা। অনেক অভিভাবক উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন—“এত নিয়ম মানানোর পরও কেন এত ঘন ঘন ঠান্ডা হয়?” আসলে শিশুর শরীরের স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ধীরে ধীরে শক্তিশালী হয়, ফলে তারা সংক্রমণের প্রতি বেশি সংবেদনশীল থাকে। তবে ঘন ঘন ঠান্ডা লাগা সবসময় বিপদের সংকেত নয়; আবার অবহেলা করলে জটিলতাও তৈরি হতে পারে। তাই এর কারণ, ঝুঁকি ও প্রতিকার সম্পর্কে জানা জরুরি।
কেন বাচ্চাদের বারবার ঠান্ডা লাগে?
১. অসম্পূর্ণ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা
জন্মের পর শিশুদের ইমিউন সিস্টেম ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে। তাই প্রথম কয়েক বছরে তারা সহজেই ভাইরাসজনিত ঠান্ডায় আক্রান্ত হয়। বছরে ৬–৮ বার সর্দি হওয়াও অস্বাভাবিক নয়।
২. ভাইরাস ছড়ানোর পরিবেশ
স্কুল, প্লে-গ্রাউন্ড বা ডে-কেয়ার—বাচ্চাদের এসব জায়গায় অন্যদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মেশার কারণে ভাইরাস দ্রুত ছড়ায়। একজন শিশু অসুস্থ হলে একই ঘরে থাকা বেশিরভাগ শিশু আক্রান্ত হয়।
৩. আবহাওয়ার পরিবর্তন
শীতকালে তাপমাত্রা কমে যাওয়া, শুষ্ক বাতাস এবং ধুলার মাত্রা বেড়ে যাওয়া শিশুর শ্বাসতন্ত্রকে সংবেদনশীল করে তোলে। বিশেষ করে হঠাৎ ঠান্ডা–গরম পরিবর্তন ঠান্ডার ঝুঁকি বাড়ায়।
৪. পুষ্টির ঘাটতি
ভিটামিন–সি, জিঙ্ক, প্রোটিন, আয়রনসহ প্রয়োজনীয় পুষ্টি কম পেলে বাচ্চাদের ইমিউন সিস্টেম দুর্বল হয়। দুর্বল শরীর সহজেই ভাইরাসে আক্রান্ত হয় এবং সেরে উঠতে সময়ও বেশি লাগে।
৫. ধুলাবালি ও দূষণ
বায়ুদূষণ শিশুর শ্বাসনালীতে জ্বালা সৃষ্টি করে। এ অবস্থায় ভাইরাসের সংক্রমণ আরও সহজ হয়। শহরাঞ্চলে এই সমস্যা বেশি দেখা যায়।
৬. অ্যালার্জির প্রবণতা
অনেক শিশুর ধুলাবালি, ঠান্ডা বাতাস বা পোষা প্রাণীর লোমে অ্যালার্জি থাকে। অ্যালার্জি থাকলে নাক বন্ধ, হাঁচি, চোখ চুলকানো এবং ঘন ঘন সর্দি দেখা দেয়।
ঠান্ডা লাগা শিশুর জন্য সতর্ক হওয়া প্রয়োজন এমন জটিলতা
১. কানের ইনফেকশন
লক্ষণ: কান দিয়ে পানি পড়া, কান ব্যথা, জ্বর, শিশুর বেশি রুদ্রমুখি বা অস্বাভাবিক কন্ঠ।
সতর্কতা: ব্যথা বা জ্বর ২-৩ দিনের বেশি থাকলে ডাক্তার দেখান।
২. নিউমোনিয়া
লক্ষণ: দীর্ঘস্থায়ী কাশি, জ্বর, শ্বাস নিতে কষ্ট, বুক ফোলা, দ্রুত শ্বাস নেওয়া।
সতর্কতা: শ্বাসকষ্ট বা জ্বর বেড়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা দরকার।
৩. সাইনোসাইটিস
লক্ষণ: নাক বন্ধ, ঘন সর্দি, মাথাব্যথা, মুখে চাপ অনুভূতি।
সতর্কতা: ১০ দিনের বেশি সর্দি বা দুর্বলতা থাকলে চিকিৎসা প্রয়োজন।
৪. ব্রংকাইটিস
লক্ষণ: দীর্ঘমেয়াদি কাশি, কফ, ঘন ঘন জ্বর, দুর্বলতা।
সতর্কতা: কাশি বেশি হলে বা শ্বাসকষ্ট শুরু হলে ডাক্তার দেখান।
৫. হাঁপানির উপসর্গ বেড়ে যাওয়া
লক্ষণ: হুইসিং শব্দ, শ্বাসকষ্ট, রাতে ঘুমে সমস্যা, বেশি কাশি।
সতর্কতা: শ্বাস আটকে গেলে বা নীল চেহারা হলে জরুরি।
৬. গলা ব্যথা বা টনসিলাইটিস
লক্ষণ: গলায় ব্যথা, লাল বা ফুলে থাকা টনসিল, জ্বর।
সতর্কতা: খাবার বা পানি খেতে সমস্যা হলে ডাক্তার দেখান।
৭. ফ্লু বা ইনফ্লুয়েঞ্জার জটিলতা
লক্ষণ: উচ্চ জ্বর, ক্লান্তি, পেশী ব্যথা, হঠাৎ অসুস্থ বোধ।
সতর্কতা: দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়া জ্বর বা শ্বাসকষ্ট হলে চিকিৎসা প্রয়োজন।
৮. ডিহাইড্রেশন
লক্ষণ: কম প্রস্রাব, শুকনো ঠোঁট, অল্প পানি পান করা, ক্লান্তি।
সতর্কতা: শিশু পর্যাপ্ত পানি না নিলে ডাক্তার দেখান।
৯. শক্তিশালী দুর্বলতা ও ক্লান্তি
লক্ষণ: খেলাধুলা বা খাওয়াপানে আগ্রহ কমা, অতিরিক্ত ঘুমানো।
সতর্কতা: দীর্ঘস্থায়ী দুর্বলতা থাকলে চিকিৎসা জরুরি।
১০. চর্ম সংক্রমণ
লক্ষণ: ত্বকে লালচে দাগ, ফুসকুড়ি, চুলকানি।
সতর্কতা: দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে ডাক্তার দেখান।
১১. হৃদয় সংক্রান্ত চাপ
লক্ষণ: শ্বাসকষ্ট, ক্লান্তি, দ্রুত হৃৎস্পন্দন।
সতর্কতা: নিউমোনিয়া বা গুরুতর ঠান্ডা থাকলে হঠাৎ সমস্যা হলে চিকিৎসা জরুরি।
১২. চোখের সংক্রমণ
লক্ষণ: চোখ লাল হওয়া, পানি পড়া, চোখ খুসখুস করা।
সতর্কতা: চোখের প্রদাহ বা চাপ বেড়ে গেলে চিকিৎসক দেখানো দরকার।
মা-বাবাদের জন্য সাধারণ নির্দেশনা:
সাধারণ ঠান্ডা ৫–৭ দিনের মধ্যে ভালো হয়ে যায়।
যদি উপরের যেকোনো লক্ষণ দেখা দেয়, দ্রুত চিকিৎসক দেখানো জরুরি।
শিশুকে পর্যাপ্ত পানি, বিশ্রাম এবং হালকা খাবার দিন।
কীভাবে ঠান্ডা কমানো ও প্রতিরোধ করা যায়?
১. পর্যাপ্ত পানি ও উষ্ণ তরল খাবার:- ঠান্ডা লাগলে শরীর দ্রুত পানিশূন্য হয়ে পড়ে। তাই বাচ্চাকে পর্যাপ্ত পানি, স্যুপ, খিচুড়ির ঝোল বা মধু–লেবুর হালকা গরম পানি দেওয়া উপকারি। এতে গলা আরাম পায় এবং সংক্রমণ দ্রুত কমে।
২. পুষ্টিকর ও সুষম খাদ্য :- শাকসবজি, ডিম, মাছ, দুধ, ফলমূল—এসব খাবার শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। ভিটামিন–সি সমৃদ্ধ খাবার যেমন কমলা, পেয়ারা, টমেটো খুব কার্যকর।
৩. নাক পরিষ্কার রাখা :- স্যালাইন ন্যাসাল ড্রপ নাকের ভেতর আর্দ্রতা বাড়ায় এবং শ্বাস নিতে সুবিধা করে। ছোটদের ক্ষেত্রে এটি খুব কার্যকর ও নিরাপদ।
৪. উষ্ণ রাখার অভ্যাস :- শীতকালে মাথা, গলা ও পা ভালোভাবে ঢেকে রাখতে হবে। রাতের বেলায় হালকা গরম পানি দিয়ে হাত–মুখ ধোয়ালে শিশুর ঠান্ডা বাড়ে না।
৫. পরিবেশ পরিষ্কার রাখা :- বাড়িতে ধুলাবালি জমতে না দেওয়া, ব্যবহৃত খেলনা ও কাপড় নিয়মিত পরিষ্কার করা, ঘরে বাতাস চলাচল বজায় রাখা প্রয়োজন। কার্পেট বা ভারী পর্দা ধুলা জমায়—এগুলো যতটা সম্ভব কম ব্যবহার করা ভালো।
৬. ভিড় এড়িয়ে চলা :- ঠান্ডার মৌসুমে বাচ্চাকে অতিরিক্ত ভিড় বা অসুস্থ মানুষের কাছ থেকে দূরে রাখলে সংক্রমণের সুযোগ কমে।
৭. পর্যাপ্ত ঘুম :- ঘুম কম হলে শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে। বাচ্চাদের বয়স অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ঘুম নিশ্চিত করতে হবে।
কখন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হবেন?
* ৩–৪ দিনের বেশি জ্বর না কমা
* শ্বাস নিতে কষ্ট বা দ্রুত শ্বাস নেওয়া
* শিশুর ঠোঁট বা নখে নীলাভ রঙ
* খুব কম খাওয়া বা পানিশূন্যতার লক্ষণ
* কানে ব্যথা বা কান দিয়ে পানি পড়া
* শিশুর আচরণ পরিবর্তন, অতিরিক্ত ক্লান্তি। এসব লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। সময়মতো চিকিৎসা দিলে জটিলতা সহজেই নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
হোমিওপ্রতিকার
শিশুদের মধ্যে ঘন ঘন ঠান্ডা হওয়া একটি সাধারণ সমস্যা, যা প্রায়ই শিশুর দৈনন্দিন জীবনকে অস্বস্তিকর করে তোলে। সর্দি, কাশি, নাকবাহ বা গলা ব্যথা শিশুদের খেলাধুলো ও পড়াশোনায় ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে পারে। এই সমস্যার ক্ষেত্রে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা পদ্ধতি একটি নিরাপদ ও কার্যকর বিকল্প হিসেবে বিবেচিত হয়।হোমিওপ্রতিকার মূলত শিশুর দেহের প্রাকৃতিক প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী করার মাধ্যমে ঘন ঘন সর্দি প্রতিরোধে সাহায্য করে।
হোমিও চিকিৎসক সাধারণত শিশুর নির্দিষ্ট লক্ষণ, শারীরিক অবস্থা, বয়স ও প্রতিরোধ ক্ষমতার ভিত্তিতে ঔষধ নির্বাচন করেন। ঘন ঘন ঠান্ডার ক্ষেত্রে যে ঔষধগুলো প্রাথমিকভাবে ব্যবহৃত হয়, সেগুলো হলো:-অ্যাকোনাইটাম: হঠাৎ সর্দি-কাশির জন্য। বেলাডোনা: তীব্র জ্বর ও নাক দিয়ে পাতলা সাদা বা হলুদ স্রাব।
অ্যালিয়াম সেপা: নাক দিয়ে জলপাতা এবং চোখ জল ধারা।
আর্সেনিকাম অ্যালবাম: জ্বর ও দুর্বল শরীরের জন্য। পালসাটিলা: নাক দিয়ে ঘন সবুজ বা হলুদ স্রাব, বিশেষ করে সন্ধ্যা বা রাতের সময়।
ক্যামোমিলা: খিঁচুনি, অশান্তি বা রাগের সঙ্গে সর্দি। ফসফরাস: শক্তিশালী সর্দি এবং দুর্বল প্রতিরোধ ক্ষমতার জন্য। হিপার সালফার: ঘন সর্দি ও হালকা জ্বরে। নাক্স ভোমিকা: হঠাৎ ঠান্ডা এবং হজমজনিত সমস্যা।সাইলেসিয়া: দীর্ঘস্থায়ী সর্দি এবং দুর্বল দেহ।এই ঔষধগুলো শিশুর নির্দিষ্ট উপসর্গ অনুযায়ী ব্যবহৃত হলে সর্দি দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আসে এবং দেহের অভ্যন্তরীণ প্রতিরোধ শক্তি বৃদ্ধি পায়। তবে, প্রতিটি শিশুর শারীরিক অবস্থা আলাদা হওয়ায় ঔষধের প্রকার ও মাত্রা ভিন্ন হতে পারে। তাই নিজে নিজে ঔষধ ব্যবহার না করে অভিজ্ঞ হোমিওবিশেষজ্ঞ পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। সঠিক ঔষধ এবং মাত্রার মাধ্যমে শিশুর ঘন ঘন ঠান্ডার প্রবণতা কমে, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং শিশুর দৈনন্দিন জীবন স্বাচ্ছন্দ্যময় হয়।
শেষ কথা,বাচ্চাদের ঘন ঘন ঠান্ডা লাগা বেশ স্বাভাবিক বিষয় হলেও সচেতন জীবনযাপন, সঠিক পুষ্টি এবং পরিচ্ছন্নতার মাধ্যমে এ সমস্যাকে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা যায়। অভিভাবক হিসেবে আপনার ধৈর্য, নজরদারি ও দ্রুত সিদ্ধান্ত শিশুকে সুস্থ রাখতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে। নিয়মিত যত্নে বাচ্চারা শুধু ঠান্ডা থেকে রক্ষা পায় না—তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও ধীরে ধীরে শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
লেখক: লেখক ও শিশুস্বাস্থ্য–বিষয়ক স্বাস্থ্য সচেতনতা নিবন্ধকার
প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি
ইমেইল, drmazed96@gmail.com
এলএইস/