শুক্রবার, ২৮ নভেম্বর ২০২৫ ।। ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ ।। ৭ জমাদিউস সানি ১৪৪৭

শিরোনাম :
শিশুর বারবার ঠান্ডা লাগা: কারণ ও প্রতিকার জানুন ধর্মের অপব্যাখ্যা করে বিশৃঙ্খলা তৈরির সুযোগ কাউকে দেয়া হবে না: ধর্ম উপদেষ্টা বাংলাদেশে কেন একজন মাওলানা ফজলুর রহমান নেই, কেন হয় না! বড় হচ্ছে দুদকের পরিধি, কর্মকর্তাদের সম্পদ যাচাই বাধ্যতামূলক আগামী সপ্তাহে প্রবাসীদের ঠিকানায় যাচ্ছে পোস্টাল ব্যালট অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে যুক্ত অনেকেই নির্বাচন করবেন: উপদেষ্টা আসিফ খোদাদ্রোহী বাউল আবুল সরকারের মৃত্যুদণ্ডের দাবিতে জাতীয় ইমাম পরিষদের মানববন্ধন বাউলদের ওপর হামলায় জড়িতদের গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে : প্রেস সচিব শ্রীলঙ্কায় বন্যা-ভূমিধসে অন্তত ৩২ জনের মৃত্যু, নিখোঁজ ১৪ দুটি ট্রলারসহ টেকনাফের ১২ জেলেকে ধরে নিয়ে গেছে আরাকান আর্মি

বাংলাদেশে কেন একজন মাওলানা ফজলুর রহমান নেই, কেন হয় না!

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

||মুফতি এনায়েতুল্লাহ||

সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর করেছেন মাওলানা ফজলুর রহমান। তিনি বিশ্বের প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, পাকিস্তান জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সভাপতি। খুব নিবিড়ভাবে তাকে দেখার, কাছে থেকে কথা শোনার ও আলাপ করার সুযোগ হয়েছে। তার সাক্ষাৎ, বাংলাদেশের প্রতি তার পিতা মুফতি মাহমুদের সমর্থনসহ বর্তমান বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে চিন্তার প্রেক্ষিতে এ লেখা।

এক. স্বভাব, নেতৃত্ব ও ঐক্যের বিশ্লেষণ

প্রথমে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান- এই দুই দেশের উলামায়ে কেরামের স্বভাবগত পার্থক্য বোঝার জন্য একটি মূল বিষয় মাথায় রাখা দরকার। একজনের নেতৃত্বকে সামনে রেখে নিজেদের পেছনে রাখার যোগ্যতা।

পাকিস্তানের বড় আলেমদের মাঝে এই গুণটা রক্তে মিশে আছে। তারা বড় হলেও ছোট একজনের পেছনে দাঁড়াতে পারেন, তাকে মানতে লজ্জা করেন না, তাকে সামনে রাখতে নিজের অবস্থান সংকুচিত করতে দ্বিধা করেন না।

বাংলাদেশে এই জায়গাটি দুর্বল এবং আমাদের প্রায় সব অস্থিরতার মূল এখানেই।

দুই. ফজলুর রহমান একজন ব্যক্তি নন, একটি চরিত্র- একটি পদের নাম

হ্যাঁ, ব্যক্তি মাওলানা ফজলুর রহমানের রাজনৈতিক কৌশলে ত্রুটি থাকতে পারে। ব্যক্তিগত যোগ্যতা-অযোগ্যতা, বক্তব্য-বিবৃতি নিয়ে আলোচনা হতে পারে। কিন্তু মাওলানা ফজলুর রহমান নামটি একটি পদ, একটি ভূমিকা, একটি চরিত্র। যেখানে ব্যক্তির দুর্বলতার চেয়ে ‘পদটি ধরে রাখা’ অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

পাকিস্তানের বড় বড় আলেম- যারা নিজেরাও বিশাল ব্যক্তিত্ব, তারাই তাকে সামনে রেখেছেন; তার সঙ্গে বিদ্রোহ করার সুযোগ তারা নিজেরাই বন্ধ রেখেছেন। এ কারণেই পাকিস্তানের নেতৃত্ব রক্ষার স্বর্ণনীতি চলছে।

কিন্তু আমাদের দেশের চিত্র সম্পূর্ণ উল্টো।

যোগ্য ব্যক্তির পাশে আরেকজন কাছাকাছি যোগ্যতাসম্পন্ন কেউ তৈরি হলে তাকে সামনে আনার নামে বিদ্রোহের ফর্মূলা তৈরি হয়। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

তিন. আমাদের ভেতরের বড় সমস্যা, নিজ ব্যক্তিত্বকে ওপরে তুলতে চাওয়া

বাংলাদেশে আলেমদের মধ্যে এমন একটি স্বভাব তৈরি হয়েছে, যা অনেক ধ্বংসের কারণ। এর কয়েকটি হলো- নিজেকে ফুটিয়ে তোলা, নিজের অবস্থান প্রকাশ করা, নিজের চিন্তাকে সামনে আনা। এটি জাতিকে ছোট করে দেয়, নেতৃত্ব ভেঙে দেয় এবং ইসলামি হুকমতের পথকে দূরে ঠেলে দেয়, আনুগত্যের স্বভাব নষ্ট করে দেয়। অথচ বিনয় ও আনুগত্যের মধ্যে থেকেও নিজেকে ফুটিয়ে তোলা, অবস্থান তৈরি করার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো- এই প্র্যাকটিসটা আমাদের দেশে নাই।

এমনকি খেলাফত প্রতিষ্ঠা, কোরআনের শাসন ব্যবস্থা- এসব স্লোগান যতই সুন্দর হোক, যখন ব্যক্তিগত স্বভাব গণতান্ত্রিক স্বাধীনতায় ভরপুর থাকে, তখন রাষ্ট্রের ক্ষমতায় যেতে পারলেও ফলাফল কখনোই আনুগত্যপূর্ণ হয় না। কাজেই খেলাফতের কাজ করতে হলে আনুগত্যের প্রশিক্ষণ অপরিহার্য।

চার. এখানে একটি বাস্তব সত্য আছে

আমরা মুখে মুখে গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে, কিন্তু নিজেদের আচার-আচরণ ও কথাবার্তায় পুরোপুরি গণতন্ত্রের সব রঙ লেগে আছে। আমরা গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করি, অথচ নিজের মধ্যে থাকা গণতান্ত্রিক স্বাধীন চেতনার দুর্গন্ধ টেরই পাই না। এটা নিয়ে আমরা বড়ই উদাসীন। এই স্বভাবই আলেমসমাজের, ইসলামি রাজনীতিবিদদের ঐক্য নষ্টকারী মূল ভাইরাস।

বিষয়টি গভীরভাবে বুঝাতে একটি উপমা অত্যন্ত কার্যকর। সিংহ সব প্রাণীর সামনে গর্জন দিতে পারে, তার একক নেতৃত্বের কারণে। কিন্তু সবাই যখন গণতান্ত্রিক অধিকার চর্চা করতে চায়, তখন কেউ সিংহ হতে পারে না। এখন তো সবাই সিংহের মতো গর্জন দিতে চায়, ফলাফল হলো- হাজার হাজার বিড়ালের মিউ মিউ শব্দ একসঙ্গে শোনা যায়। ফলে সিংহের গর্জন তার স্বাতন্ত্র হারায়। সিংহের একটি গর্জন বনে থাকা অন্যান্য পশু-পাখিকে নিরাপদ করে, হাজারো বিড়ালের মিউ মিউ আওয়াজ কোনো কম্পন তৈরি করে না। প্রতিপক্ষের মনে প্রভাব ফেলে না। এ কারণেই নিজেরা শক্তিশালী হওয়া নয়, আমিরকে শক্তিশালী করার মানসিকতা সবচেয়ে বেশি জরুরি। এটা ইসলামের নির্দেশও বটে।

পাঁচ. ইসলামি নেতৃত্বের মেজাজ আমিরের আনুগত্য

ইসলামি রাজনৈতিক দর্শন গণতন্ত্রের সম্পূর্ণ বিপরীত। আমিরের প্রতি আনুগত্য এবং অবিচল শৃঙ্খলা ইসলামের অন্যতম শিক্ষা। আমির ব্যক্তিগতভাবে ভুল করতে পারে। কিন্তু আনুগত্যের কাঠামো ভেঙে না পড়লে জাতি বিভ্রান্ত হয় না, জাতি ভুল পথে যায় না।

কিন্তু গণতান্ত্রিক মানসিকতায় প্রত্যেকে নিজের অধিকার, নিজের অবস্থান, নিজের সিদ্ধান্ত এসব দাবি করতে করতে নেতৃত্বকে শূন্য করে ফেলে।

ইসলাম এই প্রবণতাকে ‘স্বাধীনতা’ নয়, ‘অরাজকতার বীজ’ ফেতনা, অবাধ্যতা বলে। ইসলাম বিষয়গুলোকে অত্যন্ত কঠিনভাবে দেখে।

ছয়. ভারত-পাকিস্তানে উত্তরসূরি তৈরির সংস্কৃতি

দারুল উলুম দেওবন্দ ও পাকিস্তানের উলামারা নেতৃত্বের ধারাবাহিকতা নিয়ে অত্যন্ত সচেতন। তাদের মাঝে একটি নীতি প্রবল, এটা তারা কঠিনভাবে অনুসরণ করেন। যেমন- যে মানুষটি জীবনভর একটি কাঠামো (প্রতিষ্ঠান, সংস্থা, দল ইত্যাদি) তৈরি করেছে, তার মৃত্যুর পর সেটা যেন ভেঙে না পড়ে এ জন্য তাদের বিশেষ কর্মপন্থা রয়েছে। যেমন-

১. বড়দের সন্তানদের আগেভাগেই যোগ্য করে প্রস্তুত করা হয়।

২. সন্তান যোগ্য না হলে বড়দের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ছাত্রদের প্রস্তুত করা হয়।

৩. বড়রা নিজেরাই অন্য বড়দের সন্তানদের অগ্রগতিতে সাহায্য করেন।

এটা কোনো পারিবারিক রাজনীতি নয়, বরং ‘মেহনতকে নষ্ট হতে না দেওয়া’র সংস্কৃতি।

আমাদের দেশে কী হয়?

যে যত বড় আলেম, মৃত্যুর পর তার কাজ, চিহ্ন, উত্তরসূরি সবকিছু ধ্বংস হয়ে যায়। আমরা কোনো বড় ব্যক্তির সন্তান বা ঘনিষ্ঠ ছাত্রকে এগিয়ে দিতে, সামনে রাখতে রাজি নই। এমনকি তাদের কেউ সামনে এলে, ‘পরিবারতন্ত্র’ বলে তিরস্কার করি, তার সমালোচনা করি। কিন্তু এটা ভাবি না, খানদানি মানুষ, খানদানের গুরুত্ব বোঝে। অন্যরা বুঝবে না এটাই তো স্বাভাবিক। এই বোঝাটা জাতীয়ভাবে ক্ষতিকর।

ফলাফল! প্রতিটি প্রজন্মকে নতুন করে শুরু করতে হয়, ধারাবাহিকতা ভেঙে পড়ে, আর কোনো নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় না।

সাত. আমাদের করণীয়

১. ব্যক্তিকে নয় চরিত্র, পদ ও কাঠামোকে মূল্যায়ন করা।

২. আমিরকে শক্তিশালী করা নিজেকে নয়।

৩. বাস্তব জীবনে নিজের নফসের (গণতান্ত্রিক) স্বাধীনচেতনা চিহ্নিত করে পরিত্রাণের চেষ্টা করা।

৪. অযথা সমালোচনা কমানো, নীরবতার আদব শেখা।

৫. উত্তরসূরি তৈরির সংস্কৃতি পুনরুজ্জীবিত করা।

৬. বিদ্রোহ নয়, দলীয় স্থিরতাকে মূল্য দেওয়া।

৭. আত্মপ্রদর্শন পরিত্যাগ করে সমাজ, প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনকে শক্তিশালী করা।

মনে রাখতে হবে, মাওলানা ফজলুর রহমান একজন ব্যক্তি হতে পারেন, কিন্তু বাস্তবতা হলো- ফজলুর রহমান নামের চরিত্র প্রত্যেক জাতি ও দেশের জন্য অপরিহার্য।

আমাদের জাতিগত দুর্বলতা হলো, আমিরকে শক্তিশালী করার বদলে  প্রত্যেকে স্বতন্ত্রভাবে শক্তিশালী হওয়ার স্বপ্ন দেখি। এ স্বভাব না বদলালে, আমরা যতই খেলাফত প্রতিষ্ঠার স্লোগান তুলব, ইসলামি শাসন ব্যবস্থার কথা বলব- তা কাজে আসবে না। আমাদের কথা, দিন দিন বাস্তবতা থেকে দূরে সরে যাবে।

আট. এই লেখায় যারা বিরক্ত হবেন

যারা নিজের পরিচয়, প্রভাব, অবস্থান ইত্যাদি দেখানো ছাড়া বাঁচতে পারেন না। যারা ভয় পান কোনো একজন শক্ত নেতা সামনে এলে পিছিয়ে যাবেন। যারা বছরের পর বছর বিশৃঙ্খল নেতৃত্ব, স্বতন্ত্র মতবাদ, দল দল খেলায় অভ্যস্ত। যারা অন্যের নেতৃত্ব মানতে অভ্যস্ত নযন, যারা ছোটবেলা থেকে নেতৃত্ব মানতে কষ্ট পান। এমনকি শিক্ষক ও বড়দের কথা শুনতে যাদের ভীষণ অপছন্দ, যাদের মস্তিষ্ক স্বয়ংক্রিয়ভাবে নেতৃত্বকেন্দ্রিক নীতি প্রত্যাখ্যান করে চলে- তারাও এই লেখায় কষ্ট পাবেন, সমালোচনা করবেন। এমনকি এই লেখায় ভয়ঙ্করভাবে বিরক্ত হবেন- নেতৃত্বের লোভে লালায়িত অহংকারে ভরপুর ব্যক্তি। যিনি ভাবেন আমি ও আমার কথাই সব। আমিই নেতা, অন্যরা আমার অনুসারী।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

এলএইস/


সম্পর্কিত খবর

সর্বশেষ সংবাদ