|| আফফান লাবীব ||
প্রথম সাময়িক পরীক্ষার ছুটিতে গিয়েছিলাম বাংলার দ্বীপ-রাজ্য ভোলায়। টেনেটুনে তিনদিনের এই সফরে ভোলার চরফ্যাশন থানার উল্লেখযোগ্য এবং দর্শনীয় প্রায় সকল স্থানই ঘুরে দেখার তৌফিক হয়েছে।
এরই ফাঁকে সুযোগ খুঁজে হাজির হলাম ভোলার প্রাচীন কওমী মাদরাসা কাসেমিয়া মদিনাতুল উলুম মুখার বান্দায়। স্বল্প সময়ের জন্য সান্নিধ্য লাভের সৌভাগ্য হয়েছে অত্র প্রতিষ্ঠানের মুহতামিম হযরত মাওলানা আনাস সাহেব হুজুরের। সম্পর্কে তিনি ঢাকার জামিয়া কাসেম নানুতবীর সিনিয়র মুহাদ্দিস মাওলানা আবুল ফাতাহ কাসেমীর শ্বশুর হন। শুভ্র দাড়ি, মাথাভর্তি পাকা চুল, সাদামাটা পোশাক এবং চোখে হালকা ফ্রেমের চশমা, ইলমের গভীরতা এবং ব্যক্তিত্বের ভারে ন্যুব্জ— সবমিলিয়ে সুন্নতী চরিত্রের এক জীবন্ত নমুনা।
সাক্ষাতের শুরুতে হুজুর সবার হালপুরসি করেন। বাবার পরিচয়-সূত্রে আমাকে আলাদাভাবে কিছু প্রশ্ন করেন। পরিচয়পর্ব শেষে সবার পড়াশোনার খোঁজখবর নেন। কোন কিতাবের সবক কদ্দূর হলো— প্রত্যেককে আলাদাভাবে জিজ্ঞেস করে জেনে নেন। অতঃপর হাদীসের দরসের প্রতি বিশেষ ইহতিমামের নসিহত করেন। এবং বলেন– দরসে সর্বদা ওজু করে বসার চেষ্টা করবে এবং হাদীস পাঠের সময় দরূদ শরীফের প্রতি বিশেষ মনযোগী হবে— তাহলে তাকমীলের বছরই রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যিয়ারত লাভের সম্ভাবনা তৈরি হবে।
এক্ষেত্রে হুজুর নিজের ছাত্রজীবনের একটি উদাহরণ তুলে করেন। হুজুর বলেন— ‘আমি তাকমীল সম্পন্ন করি ঢাকার ঐতিহ্যবাহী দীনি বিদ্যাপীঠ জামিয়া ইমদাদিয়া দারুল উলূম ফরিদাবাদ মাদরাসা থেকে। সেবছর কুরবানীর আগে কোনো একদিন আমার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যিয়ারত নসীব হয়। সঙ্গে ছিল সিদ্দীকে আ’জম এবং ফারুকে আ’জম রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহুম। সালাম মুসাফাহা শেষে আমি হুজুরকে কিছু হাদীসের ব্যাখ্যা জিজ্ঞেস করি। যেসব হাদীসের মন-প্রশান্তকারী ব্যাখা আমি আমার উস্তাদদের থেকে পাচ্ছিলাম না— কেবল হাদীস সম্পর্কেই আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করি।
প্রশ্ন করি উহুদের ময়দানে রাসূলের আদেশ অমান্য করে তীরন্দাজ বাহিনীর উপত্যকা থেকে নেমে আসার ব্যাপারে। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন– ‘‘আমার সাহাবারা সেদিন দুনিয়ার মোহে আমার আদেশ অমান্য করেনি। বরং এক্ষেত্রেও তাঁরা অপার্থিব দিক লক্ষ্য করে এই কাজ করেছিলেন। কেননা হিজরতের পর আনসার সাহাবায়ে কেরামের উদারনীতি সত্ত্বেও তাঁরা তাঁদের গায়রতের কারণে তাঁদের সম্পদে ভাগ বসাননি। বরং তাঁরা চেয়েছেন আপন কর্মে উপার্জিত সম্পদ ভোগ করতে। আর উপার্জনের অন্যতম কয়েকটি মাধ্যমের একটি ছিল জিহাদ থেকে অর্জিত মালে গনিমত। আর এই জন্যেই উহুদ প্রান্তরে গনীমত লাভের পর তাঁরা স্থান ত্যাগ করেন। সুতরাং তাঁদের এই কর্মে মূলত উদ্বুদ্ধকারী ছিল তাঁদের সেই ঈমানী গাইরত। যা তাঁদেরকে কোনো মাখলুকের সামনে মাথা নত করতে বাঁধা দিত”।
এভাবেই আমি হুজুরে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আরেকটি প্রশ্ন করি, তাহলো– আপনার জীবদ্দশায় আপনি যে আমলটি ছেড়ে দিয়েছিলেন, আপনি চলে যাওয়ার সেই আমলটি পুনরায় কেন জারি করা হলো? (যেমন: নামাযে রফয়ে ইয়াদাইন করা) নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তরে বললেন– “আল্লাহ তায়ালা এমনটি করে থাকেন যেন কেয়ামত পর্যন্ত আমার সমস্ত আমল উম্মতের মাঝে বিদ্যমান থাকে”।
এভাবে আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বারো তেরোটি হাদীসের ব্যাখা সম্পর্কে জানতে চাই এবং তিনি আমার সব প্রশ্নের মন-প্রশান্তকারী জবাব দেন’।
এরপর হুজুরের সঙ্গে একে একে আলাপ হয় সাহাবায়ে কেরামের ঈমানি শক্তি, ইসলামী সিয়াসত, তাবলীগে দীন সম্পর্কে। প্রত্যেক বিষয়ের গাম্ভীর্যপূর্ণ আলোচনাই হুজুরের ইলমী গভীরতার প্রতি ইঙ্গিত বহন করে। অতঃপর সময় সঙ্কীর্ণতার কারণে হুজুরের কাছে বিদায়ের অনুমতি চাই, হুজুর আমাদেরকে মদীনার খেজুর এবং মক্কার যমযম খাইয়ে সহাস্যে বিদায় দেন।
আল্লাহ হুজুরের ছায়া উম্মতের উপর দীর্ঘ করুন। আমীন।
০৪/ ০৮/ ২০২৫..সোমবার— রাত ০৮:০২ মিনিট.
শিক্ষার্থী ও তরুণ লেখক
এমএম/