শনিবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৫ ।। ১৩ বৈশাখ ১৪৩২ ।। ২৮ শাওয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :
বিদেশি সংস্কৃতি চাপানোর চেষ্টা করবেন না: মুফতি ফয়জুল করিম জমিয়তের জাতীয় কাউন্সিলের ৭ নতুন প্রস্তাবনা ‘আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি ব্যতিত জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সংহতি বজায় রাখা সম্ভব নয়’ গুজরাটে ১ হাজারের বেশি বাংলাদেশি গ্রেপ্তার এবার যে ২০ ভাষায় অনুবাদ করা হবে হজের খুতবা সংসদ ও রাষ্ট্রপতির মেয়াদ ৫ বছরের পক্ষেই জামায়াত স্বামীর টাকায় হজ করলে ফরজ আদায় হবে? ধ্বংসস্তূপের নিচে নিখোঁজ ৩০ ফিলিস্তিনি, নেই উদ্ধারের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি পেহেলগামে হামলার স্বচ্ছ তদন্তের জন্য পাকিস্তান প্রস্তুত: শাহবাজ শরীফ জমিয়তের সভাপতি আল্লামা ওবায়দুল্লাহ ফারুক মহাসচিব মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দি

একজন মুখলিস মানুষের জীবনাবসান!

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুহাম্মদ আলী জাওহার আলহাজ মাস্টার আবদুস সাত্তার আমার পরম শ্রদ্ধেয় শ্বশুর। গেলো ১৭-৮-২১ ঈ. মঙ্গলবার বেলা বারোটা পঞ্চাশ মিনিটে নশ্বর পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে পরপারে পাড়ি জমান।

জন্ম আর মৃত্যু কুদরতের অমোঘ বিধান। একটি অপরটির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। জন্মেছে যে, মরণ তার আসবে—এটাই বাস্তব সত্য। মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের ভাষায়—
‘জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা কবে,
চিরস্থির কবে নীর, হায়রে জীবন নদে!’

তারপরও কিছু মানুষের চলে যাওয়া হৃদয়কে নাড়া দেয়। হারানো বেদনা ও শূন্যতাকে জাগিয়ে তোলে। নতুন করে ভাবতে শেখায় এ জগৎ-সংসার ও সমাজ নিয়ে। একজন মানুষের জীবনের সকল দিক ক্ষুদ্র কয়েক পৃষ্ঠায় লেখা সম্ভব নয়। আর তা যদি হয় বিভাময় আদর্শে গড়া, তবে তো কথাই নেই। তাই তাঁর বর্ণাঢ্যজীবনের কৃতিত্বপূর্ণ কয়েকটি দিক এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করছি।

জম্ম: ৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে শরিয়তপুর জেলার ডামুড্যা উপজেলার চর ধানকাঠি গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে মাস্টার আবদুস সাত্তার রহ. জন্ম গ্রহণ করেন। পিতা আলী আহমাদ মাদবর।

শিক্ষাদীক্ষা: ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে নিজ গ্রাম ‘চর ধানকাঠি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে’ তাঁর শিক্ষাজীবনের হাতে খড়ি। এবং ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে কনেশ্বর ‘এন এস ইনস্টিটিউট উচ্চ বিদ্যালয়’ থেকে ‘এস এস সি’ পাশ করেন। ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে ‘মাদারীপুর কলেজ’ থেকে ‘এইচ এস সি’ পাশ করেন।

কর্মজীবন: ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দের ১৫ ডিসেম্বরে তিনি গোসাইরহাট থানার ‘লাকাচুয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে’ সহকারী শিক্ষক পদে নিয়োগপ্রাপ্ত হন।

ধর্মীয় চেতনা: ধর্মের প্রতি তাঁর অনুরাগ ছিলো সীমাহীন। তাই তিনি আজীবন মসজিদ, মাদরাসা ও কবরস্থানসহ সকল ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে সবিশেষ খেদমত আঞ্জাম দিয়ে গেছেন। এমনকি মসজিদ, মাদরাসার জন্য নিজের অনেক সম্পত্তি ওয়াকফ করে গেছেন।

সুন্নতের অনুসরণ: একজন জেনারেল শিক্ষিত হয়েও নামাজ, রোজার পাশাপাশি সুন্নতের প্রতি তাঁর যে ভালোবাসা ও গুরুত্ব ছিলো, তা সত্যিই বিরল। দীনের সঠিক বুঝ আসার পর থেকে মাজুর হওয়ার আগ পর্যন্ত শরয়ি কারণ ছাড়া তাঁকে কখনো জামাত বর্জন করতে দেখা যায়নি। এমনকি নফল ও অজিফার প্রতিও ছিলেন বেশ যত্নশীল। তাই তো ফজর ও মাগরিবের পর ইশরাক, আওয়াবিন ও অন্যান্য আমল করা ব্যতীত কখনো বাসায় ফিরতে দেখা যায়নি।

নামাজের প্রতি ছিলেন বেশ সচেতন। মৃত্যুর প্রায় দশ মাস পূর্বে ফুসফুস ক্যান্সার জনিত কারণে যখন হাসপাতালে ভর্তি, তখন শরীরে পুশ করা স্যালাইনের ব্যাগ হাতে করে অজু করতে চলে যান। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের নিয়ম ছিলো—নামাজ আদায়ের জন্য কোনো রোগী মসজিদে যেতে পারবে না। কিন্তু তিনি তা উপেক্ষা করে প্রায়ই মসজিদে চলে যেতেন। জামাতের প্রতি কতটা গুরুত্ব থাকলে এমন হয়!

জীবনের শেষবেলায় যখন পুরো শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন, বসে নামাজ পড়ার শক্তিটুকুও অবশিষ্ট ছিলো না, তখনও জামাতে উপস্থিত হওয়ার জন্য ছটফট করতেন। আমরা অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে তাকে শান্ত করার চেষ্টা করতাম।

দাওয়াতের মেহনত: দাওয়াত ও তাবলিগের মেহনতে তিনি ছিলেন সরব। দীনের বুঝ আসার পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তিনি গোটা জীবনই এ কাজে ব্যয় করেছেন।

একনিষ্ঠতা, সত্যবাদিতা, শিষ্টাচার, নম্রতা-ভদ্রতা, কোমলতা, ধৈর্য, সহনশীলতা, সহাস্যবদন, হিকমতপূর্ণ বাকনিপুণতা ও দাওয়াতের কলাকৌশলসহ যেসব মহৎগুণ একজন দাঈ ও মুবাল্লিগের থাকা জরুরি, সেগুলোর সবই ছিলো তার মধ্যে সমানভাবে। এক কথায় তিনি ছিলেন কুরআনের নির্মল বাণী— ادْعُ إِلَى سَبِيلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ وَجَادِلْهُمْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ [তুমি মানুষকে তোমার প্রতিপালকের দিকে আহবান করো হিকমত ও সদুপদেশ দ্বারা এবং তাদের সাথে তর্ক করো উত্তম পন্থায়।—সুরা নাহল, আয়াত : ১২৫]—এর বাস্তব নমুনা।

শরিয়তপুর জেলার যেসব বলিষ্ঠ দাঈ রয়েছেন, তিনি ছিলেন তাদের প্রথম সারির। উম্মতের ফিকিরে তিনি ছিলেন সদা ব্যাকুল। এই ব্যাকুলতা তাকে নিয়ে ছুটে চলেছে দেশ থেকে দেশান্তরে।

স্কুল পড়ুয়া ছাত্রদেরকে অবসরে ব্যক্তিভেদে তিনদিন, সাতদিন ও এক চিল্লায় আল্লাহর রাস্তায় বের হবার জন্য বেশ অনুপ্রাণিত করতেন। সম্ভব হলে তিনি নিজেই জিম্মাদার হয়ে তাদের সাথে যেতেন। সাথীদের সাথে তাঁর আচরণ ছিলো অমায়িক। বিশেষ করে নতুন সাথীদের সাথে তাঁর সখ্যতা ছিলো অবাক করা।

সন্তান সন্ততি: মৃত্যুকালে তিনি পাঁচ ছেলে ও এক মেয়ে রেখে যান। একজন ছাড়া তাদের সকলেই আলেম। সন্তানদের উদ্দেশে তিনি প্রায়ই বলতেন—তোমাদেরকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার না বানিয়ে দীন শিখিয়েছি। তোমাদের কাজই হলো সদা ইলম-আমল নিয়ে পড়ে থাকা, অন্য কিছু নয়। দুনিয়ার ফিকির তোমাদের অন্তরে কোনোভাবেই যেনো প্রবেশ করতে না পারে—সেদিকে সজাগ থাকবে।

নাতি-নাতনীর প্রতি ভালোবাসা: নাতি-নাতনীর প্রতি তাঁর যে টান ও ভালোবাসা ছিলো তা সত্যিই অতুলনীয়। বিশেষ করে আমার সন্তানদের প্রতি তাঁর ভালোবাসা ছিলো ঈর্ষণীয়। ঘরে ফিরেছেন। হঠাৎ মনে হলো মেয়েকে! সঙ্গে সঙ্গে ফোন করে বলতেন—আবদুল্লাহ, লুবাবা, সফওয়ানকে ক’দিন ধরে দেখি না। ওদের জন্য মনটা বেশ ছটফট করছে। তোরা চলে আয়। মেয়ে কোনো কারণে অপারগতা প্রকাশ করলে নিজেই ছুটে আসতেন।

যদি শোনতেন—তাদের কেউ অসুস্থ হয়েছে। কী যে অস্থির হতেন! ডাক্তার দেখিয়েছি কি-না, যত্ন নিচ্ছি কি-না—বারবার জিজ্ঞেস করতেন। ওদের যেকোনো আবদার ও বায়না পূরণে ছিলেন বেশ তৎপর। কান্না থামাতে যেকোনো কিছু বিসর্জন দিতে প্রস্তুত ছিলেন। সোনার হরিণ চাইলে তাতেও রাজি ছিলেন। স্নেহ-মমতা, দরদ-ভালোবাসা ও অস্থিরতার সেইসব গল্প আজ না হয় থাক...।

স্বভাব চরিত্র: মাস্টার আবদুস সাত্তার রহ. সরলতা, সুজনতা, নম্রতা-ভদ্রতা, সততা, একনিষ্ঠতা, উন্নতমন, উদারতা, বদান্যতা, আন্তরিকতা, পরোপকারিতাসহ সকল মহৎগুণের আধার ছিলেন। আপ্যায়ন ও আতিথেয়তায় ছিলেন প্রবাদতুল্য। কেউ তাঁর নিকট আসলে আপ্যায়নের জন্য অস্থির হয়ে যেতেন। তাঁর বাড়ি এসে খালি মুখে বিদায় নিয়েছে—এমন কথা শুনা যায় নি কখনও। সরলতা ও ভদ্রতায় তাঁর জুড়ি মেলা ভার। এক্ষেত্রে তিনি ছিলেন হাদিসে নববি— ألمؤمن غر كريم.

[মুমিনগণ হয় অতি ভদ্র ও সাদাসিধে।]—এর বাস্তব চিত্র। তাঁর প্রতি মানুষের ভালোবাসা ছিলো অসামান্য। বৈরী আবহাওয়া ও রাতে জানাযা হওয়া সত্ত্বেও অসংখ্য মানুষের ঢলই তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ।

অন্তিম মুহূর্ত: মৃত্যুর কয়েকদিন পূর্বে আপন সন্তান-সন্ততি, ভাই-বোন ও আত্মীয় স্বজনকে ডেকে এনে নসিহত করেছেন। বলেছেন আমি আর বেশি দিন বাঁচবো না। মৃত্যুর ঠিক আগের দিন। জবান বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগ মুহূর্তে বেশ ভরাট কন্ঠে আউজু বিল্লাহ, বিসমিল্লাহসহ সুরা ফাতিহা ও কালেমা পাঠ করেন। এরপর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত কোনো কথা বলেননি। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে শুধু ফেলফেল করে তাকিয়েই থাকতেন। উত্তর দিতে পারতেন না। আহ! মৃত্যুর কাছে মানুষ কত অসহায়!

উপসংহার : তিনি শুধু আমার শ্বশুরই ছিলেন না; ছিলেন একজন আদর্শ রাহবার। আপন সন্তানদের চেয়েও বেশি ভালোবাসতেন আমাকে। তাঁকে পেয়ে ভুলে গিয়ে ছিলাম শৈশবে মা বাবা হারানোর বেদনা। তিনি আমার জন্য যে অবদান রেখেছেন, তা সত্যিই বিরল।

আহ! ভালোবাসার এ বটবৃক্ষকে এখন কোথায় পাই! হৃদয়ের ক্যানভাসে বারবার ভেসে ওঠছে শত আলোকিত স্মৃতি। স্নেহভরা সেই হাসিমাখা মুখ। আজ স্মৃতিকাতরতায় ন্যুব্জ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি প্রিয়জন হারানোর এক বুক ব্যথা নিয়ে। এমন দরদী মানুষটিকে যেদিন নিজ হাতে কবরে রেখেছি, সেদিন হতেই আমার মান-অভিমানের পালা শেষ। এখন শুধু বিষণ্নতা আর নীরবকান্নাই আমার জীবনসঙ্গী। আর তাঁর রেখে যাওয়া ঝলমলে স্মৃতিগুলো একমাত্র সান্ত¦না। কবির ভাষায়—
‘বুকের গভীরে কষ্ট জমে যেনো টুপটাপ বৃষ্টি ঝরে
আকাশের জমাট সাঁঝেও চেয়ে দেখি শুধু তোমার সেই মুখ...!’

মহান আল্লাহর দরবারে একটাই মিনতি, তিনি যেনো তাঁর দীনি মেহনতগুলো কবুল করেন। অসমাপ্ত কাজগুলো সম্পন্ন করে দেন। তাঁর শূন্যতা পূরণ করে দেন। তাঁকে আশ্রয় দেন জান্নাতের সুশীতল ছায়ায়। আমিন।

-এটি


সম্পর্কিত খবর



সর্বশেষ সংবাদ