শনিবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৫ ।। ১৩ বৈশাখ ১৪৩২ ।। ২৮ শাওয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :
জমিয়তের জাতীয় কাউন্সিলের ৭ নতুন প্রস্তাবনা ‘আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি ব্যতিত জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সংহতি বজায় রাখা সম্ভব নয়’ গুজরাটে ১ হাজারের বেশি বাংলাদেশি গ্রেপ্তার এবার যে ২০ ভাষায় অনুবাদ করা হবে হজের খুতবা সংসদ ও রাষ্ট্রপতির মেয়াদ ৫ বছরের পক্ষেই জামায়াত স্বামীর টাকায় হজ করলে ফরজ আদায় হবে? ধ্বংসস্তূপের নিচে নিখোঁজ ৩০ ফিলিস্তিনি, নেই উদ্ধারের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি পেহেলগামে হামলার স্বচ্ছ তদন্তের জন্য পাকিস্তান প্রস্তুত: শাহবাজ শরীফ জমিয়তের সভাপতি আল্লামা ওবায়দুল্লাহ ফারুক মহাসচিব মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দি খেলাফত আন্দোলনের নতুন মহাসচিব মাওলানা ইউসুফ সাদিক হক্কানী

'দুই ঘটনা, ভাবনার দুই দুয়ার'

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

আরিফুল ইসলাম


৯৩ বছর বয়সী এক বৃদ্ধ আসরের নামাজ শেষে বাগানের একটা চেয়ারে বসে আছেন। বিকেলের স্নিগ্ধ বাতাসে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিচ্ছেন। জীবনের তিরানব্বইটা বসন্ত পার করা লোকটি চিন্তায় মগ্ন। যে আদর্শকে বিজয়ী দেখতে তিনি সারাটা জীবন কাটিয়েছেন সেই আদর্শিক আন্দোলন কি তার জীবন প্রদীপ নিভে যাবার সাথে সাথে দপ করে নিভে যাবে?

বাঙ্গালি মুসলমানকে মুসলিম চেতনায় উজ্জীবিত করতে তিনি রাজনীতির মাঠে নেতৃত্ব দিয়েছেন, মুসলমানের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে তিনি কলম ধরেছেন, সাংবাদিকতা করেছেন, দ্বীনি মজলিশে মানুষকে ধর্মের বাণী শুনিয়েছেন।

কলম সৈনিকের ভূমিকা পালন করতে গিয়ে তাঁকে কারাবরণ করতে হয়েছে, তার পত্রিকাটি সরকার ব্যান করে দিয়েছে। তারপরও সব্যসাচী এই লোকটিকে কোনো শৃঙ্খল বেঁধে রাখতে পারেনি। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘মাসিক মোহাম্মদী’ পত্রিকা বাংলার প্রতিটি শিক্ষিত মুসলিম পরিবারের ঘরে ঘরে পৌঁছে। তাঁর স্বপ্ন, বাংলার মুসলমানরা বাংলা সাহিত্যের মশাল জ্বালাবে। এই স্বাপ্নিক লোকটিকে নিয়ে স্বপ্ন বুনে তাঁর পরিচিতেরা, তাঁর শুভাকাঙ্ক্ষীরা।

৯৩ বছর বয়সী আলেম মাওলানা আকরাম খাঁ’র সামনে দাঁড়িয়ে আছেন ২৬ বছর বয়সী এক যুবক। যেই যুবক তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে আছে সেই যুবক পাক্কা হানাফী, আর তিনি নিজে পাক্কা আহলে হাদীস। তিনি নিজে একটি প্রতিষ্ঠিত মাসিক পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা আর তাঁর নাতির বয়সী যেই যুবক তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে আছে তিনি নাকি একটা নতুন পত্রিকা বের করেছেন। সেই হিশেবে যুবকটি তাঁর একজন প্রতিযোগীও বটে!

২৬ বছর বয়সী যুবক ৯৩ বছর বয়সী বৃদ্ধের কাছে দাঁড়িয়ে থেকে অনুভব করলেন তাঁর পা কাঁপছে। এতো বড় মাপের কোনো মানুষের সামনে দাঁড়ানোর পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই বলে তাঁর হার্টবিট খানিকটা বেড়ে গেলো। তাঁর হাতে থাকা পত্রিকাটি দেখে অভিজ্ঞ লোকটি কী বলবেন সেটা ভেবে তিনি আরো অস্থির হয়ে যাচ্ছেন। আকরাম খাঁ সালামের জবাব দিয়ে তাঁর দিকে তাকালেন। হাতির লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়ানোর সাথে সাথে যুবকের বুকের ধুকধুকানি আরো বেড়ে গেলো।

২৬ বছরের যুবক লক্ষ করলো বৃদ্ধের চেহারা রাতের আকাশের তারার মতো জ্বলজ্বল করছে। বৃদ্ধের নির্বাক চাহনি তাঁর হৃদপিণ্ডের স্পন্দন কিছুটা কমিয়ে দিলো। যুবক কিছু বুঝে উঠার আগেই আকরাম খাঁ তাঁকে জড়িয়ে ধরলেন। তাঁর কপালে স্নেহের চুম্বন আঁকলেন।

যে সাহিত্য আন্দোলনের পেছনে নিজের ষাট বছর ব্যয় করেছেন, সেই আন্দোলনে তাঁর আরেক সাথীকে পেয়ে তিনি বললেন, তোমার পত্রিকার কথা শুনে আমার মন আনন্দে নেচে উঠেছে। আজ থেকে ষাট বছর আগে আমি যখন লেখালেখি শুরু করি তখন মুসলমানদের সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তি ছিলেন মুন্সী মেহেরুল্লাহ। তিনি আমাকে ঠিক এভাবে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, ‘ইসলামি শিক্ষায় শিক্ষিত তোমাদের মতো যুবকদের লেখালেখি করতে দেখে আমি আনন্দে আত্মহারা’।

২৬ বছর বয়সী যুবক চিন্তাও করেনি আকরাম খাঁর মতো বর্তমান সময়ের একজন জীবন্ত কিংবদন্তী তাঁকে এভাবে স্বাগতম জানাবেন। তাঁর চোখে পানি আসার উপক্রম! লেখালেখির লাইনে ৬০ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে আকরাম খাঁ যুবককে কিছু উপদেশ দিলেন- “শুরু তো করেছো প্রাণের টানে, ঈমানের উত্তাপে তাড়িত হয়ে, কিন্তু কাজটা খুব কঠিন। তবে যখনই কোনো সংকট অনুভব করবে, আমার নিকট চলে এসো। আমার আন্তরিক সহযোগিতা পাবে।”

অভিজ্ঞ লোকটির কাছ থেকে সহযোগিতার আশ্বাস পেয়ে যুবকের চোখমুখে আশার প্রদীপ জ্বলে উঠলো। যুবকের হাস্যোজ্জ্বল মুখ বৃদ্ধের কিছুক্ষণ আগের উদ্বিগ্নতা দূর করে দিলো। এই যুবক যেন মেঘ কেটে উঠা সূর্য।

ছাব্বিশ বছর বয়সী যুবকের নাম মাওলানা মুহিউদ্দীন খান। বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ইসলামি পত্রিকা ‘মাসিক মদীনা’র সম্পাদক।

পত্রিকা প্রকাশের আগে বাংলাদেশের একজন অভিজ্ঞ ম্যাগাজিন বিক্রেতার সাথে মাওলানা মুহিউদ্দীন খানের কথোপকথন হয়। সেই কথোপকথনটি তিনি তাঁর আত্মজীবনী ‘জীবনের খেলাঘরে’ বইতে লিখেন।

‘ঢাকার নিউ মার্কেটে অবস্থিত কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটির দোকানটিতে প্রচুর উর্দু গল্প উপন্যাস এবং ম্যাগাজিনও রাখা হতো। ফলে উর্দু, বাংলা উভয় ভাষাভাষী কবি সাহিত্যিক ও গ্রন্থপ্রেমিক উৎসাহী পাঠকদের এক অপূর্ব মিলন কেন্দ্র ছিল নিউমার্কেটের এই কোণটা।

পরের রবিবারে নিউমার্কেট গিয়ে প্রথমেই ঢুকলাম নলেজ হোম নামক দোকানটিতে। মালিক আমাকে দেখেই হৈ হৈ করে উঠলেন। বললেন, কংগ্রাচুলেশন। শুনলাম মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করছেন। জিজ্ঞেস করলাম, এ খবর আপনাকে আবার কে দিল? তিনি কিছু না বলে শুধু মিটমিট করে হাসতে লাগলেন। বললাম, পঙ্গুরও তো পর্বত আরোহণের শখ হতে পারে। আকাঙ্কায় দোষ কি? দোকানের মালিক বললেন, দোষ হতে যাবে কেন? আর আপনিই বা পঙ্গু হতে যাবেন কেন? তবে দীর্ঘ অভিজ্ঞতার আলোকে একটা কথা বলি, অন্য কিছু মনে করবেন না।

‘আমি আগ্রহী হয়ে বললাম, অবশ্যই বলবেন। আপনি তো এদেশের সর্বাপেক্ষা দক্ষ ম্যাগাজিন বিক্রেতাগণের একজন। আপনার অভিজ্ঞতা আমার কাজে লাগবে।

‘তিনি বললেন- নামটা ঠিক হয়নি। দেশে এখন প্রবল বেগে প্রগতির বাতাস বইছে। ধর্মীয় পত্র-পত্রিকা এবং চকবাজারী মার্কা বই-পুস্তকের দিন শেষ হয়ে গেছে। মক্কা-মদীনা নামের কোন পত্রিকা তো আমার দোকানেই তুলতে পারবো না।

আমি কিছুক্ষণ চুপ থেকে শুধু এতটুকু বললাম, মদীনা নামের পত্রিকা এদেশের ঘুমন্ত মানুষের চেতনার জমিন পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়াই তো আমার সাধনা। সুতরাং এ নামেই ইনশাআল্লাহ্ পত্রিকা বের হবে। আর আপনার দোকানে নেংটা ছবিওয়ালা পত্র-পত্রিকার পাশাপাশি মদীনা রাখতে আমিই কোনকালে দেব না। আশা করি কিছু মনে করবেন না। শুধু দোয়া করবেন, মদীনার আযান বাংলার ইথারে পৌঁছে দেওয়ার সাধনায় যেন আমি সফলকাম হই।

--

দুই মাওলানার এই দুটো ঘটনা আমাদের ভাবনার দুয়ার খুলে দেয়। প্রথম ঘটনাটি আমাদেরকে শেখায়, মতপার্থক্য থাকা স্বত্বেও একজন মুসলিম ভাইকে কিভাবে বুকে টেনে নিতে হয়, একজন প্রতিষ্ঠিত লেখক/সম্পাদক কিভাবে উদীয়মানকে উৎসাহ দেবেন।

‘কোনো সংকট অনুভব করলে, আমার নিকট চলে এসো। আমার আন্তরিক সহযোগিতা পাবে’ এই ছোট্ট কথাটি বলতে অনেক বড় মন লাগে। মতানৈক্য ভুলে ইসলামের স্বার্থে দুই মনীষীর পরস্পরকে কাছে টেনে নেবার মানসিকতা আমাদেরকে শিখিয়ে দেয়, আমরা এক আত্মা, এক প্রাণ।

দ্বিতীয় ঘটনাটি আমাদেরকে পরিচয় করিয়ে দেয় একজন স্বপ্নবাজ তরুণের সাথে। রাস্তা অন্ধকার দেখে যিনি থমকে যাননি। হাতে টর্চলাইট না থাক, মোমবাতি জ্বালিয়ে অগ্রসর হচ্ছেন তাঁর লক্ষ্যের দিকে। এমন স্বপ্নবাজ তরুণ আমাদেরকে স্বপ্ন দেখান তিমির রাতে মশাল হাতে বেরিয়ে পড়ার। যেই মশালের আলোতে শুধু অন্ধকারই দূরীভূত হবে না, পেছনের মানুষগুলোও উৎসাহ পাবে সামনে আগানোর। একসময় ফিরে দেখবো পেছনে অনেক মশালধারীর মশাল জোনাকির মতো জ্বলছে।

লেখকের ফেসবুক টাইমলাইন থেকে নেয়া 

আরএম/


সম্পর্কিত খবর



সর্বশেষ সংবাদ