বুধবার, ১১ জুন ২০২৫ ।। ২৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ ।। ১৫ জিলহজ ১৪৪৬


এনসিটিবি অনুমোদিত ইসলামের ইতিহাস বইয়ে সাহাবা বিদ্বেষ!


নিউজ ডেস্ক

নিউজ ডেস্ক
শেয়ার
ফাইল ছবি

|| বিশেষ প্রতিনিধি ||

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) কর্তৃক অনুমোদিত ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি প্রথম পত্র বইয়ে সাহাবায়ে কেরামের কড়া সমালোচনা এবং বিদ্বেষপূর্ণ মন্তব্য করা হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইব্রাহীম খলিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে তথ্য-প্রমাণসহ তা উপস্থাপনা করেছেন। 

ড. ইব্রাহীম খলিল ফেসবুকে লিখেন- উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিতে মানবিক বিভাগে ইসলামের ইতিহাস ও সংষ্কৃতি একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় বিষয়। মানবিক বিভাগের অধিকাংশ শিক্ষার্থী ‘ক‘ গুচ্ছে নৈর্বাচনিক তিনটি বিষয়ের একটি হিসেবে ইসলামের ইতিহাস বিষয়টি নিয়ে থাকেন। এ বিষয়ে এনসিটিবি অনুমোদিত কয়েকটি বই রয়েছে।

ব্যক্তিগত প্রয়োজনে আমি কয়েকটি বই সংগ্রহ করে পড়েছি এবং পড়ে মনে হয়েছে হযরত মুআবিয়া রা. ও হযরত আমর ইবন আস রা. সম্পর্কে যে সকল শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে সেগুলো তাঁদের জন্য অসম্মানজনক। যেমন কুচক্রী, ধূর্ত, কপট, শঠ, ষড়যন্ত্রকারী, মিথ্যা রটনাকারী, ক্ষমতালোভী ইত্যাদি। উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণির একজন কিশোর এ সকল শব্দে উনাদের মত জলিলুল কদর সাহাবীদের সম্পর্কে পড়বে এবং লিখবে, এটা সঠিক নয়।

মুসলিম খিলাফতের পাশ্চাত্য বয়ানভিত্তিক এ জাতীয় সমালোচনার পরিবর্তে সম্মানজনক শব্দ প্রয়োগে কীভাবে ঘটনার সঠিক বিশ্লেষণ শিক্ষার্থীদের নিকট উপস্থাপন করা যায়, তা নিয়ে বরেণ্য আলিম ও ইসলামিক স্কলারদের মতামত নেয়া যেতে পারে। তাদের মতামতের ভিত্তিতে নতুন সংস্করণের আগে বিষয়গুলোর সংস্কার হওয়া দরকার। আশা করছি এনসিটিবি বিষয়টিতে গুরুত্ব দেবে।

নমুনা হিসেবে আমার কাছে থাকা ৪টি বইয়ের কিছু চুম্বক অংশ নিম্নে তুলে ধরছি। 

(১) ড. সৈয়দ মাহমুদুল হাসান, মোঃ আবু তাহের পাটওয়ারী ও ড. মোঃ আব্দুল মতিন, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি প্রথম পত্র (ঢাকা: গ্লোব লাইব্রেরী প্রাঃ লিমিটেড, সংশোধিত সংস্করণ: ২০২৪/২০২৫
(ক) মুআবিয়া রা. সম্পর্কে লেখা হয়েছে: 
“সিরিয়ার শাসনকর্তা মুয়াবিয়ার স্থলে সুহাইল ইবন হানিফকে নিযুক্ত করা হলে কুচক্রী মুয়াবিয়া খলিফার নির্দেশ অমান্য করেন।” পৃ. ১৭৮
“কিন্তু চক্রান্তকারী ও উচ্চাভিলাষী সিরিয়ার শাসনকর্তা” পৃ. ১৮০
“ক্ষমতালোভী ও উচ্চাভিলাষী মুয়াবিয়া হযরত ওসমানের হত্যাকে মূলধন হিসেবে ব্যবহার করে তাঁর স্বার্থসিদ্ধির জন্য তৎপর হয়ে উঠেন।” পৃ.১৮১
“মুয়াবিয়ার বিশ্বাসঘাতকতা, ধৃষ্টতা, উদ্ধত স্বভাব, কুচক্রী মনোভাব ও রাষ্ট্রদ্রোহিতায় হযরত আলী বিচলিত হয়ে পড়েন। পৃ. ১৮১
“হযরত আলী মুয়াবিয়ার শঠতা ও ধূর্ততা উপলব্ধি করে যুদ্ধ স্থগিত রাখার পক্ষপাতী ছিলেন না।” পৃ. ১৮২

(খ) মুআবিয়া ও আমর ইবন আস রা. সম্পর্কে লেখা হয়েছে:
“উচ্চাভিলাষী মুয়াবিয়ার যে খিলাফতের প্রতি দুর্বলতা ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় তার সাথে মিসর বিজয়ী আমর ইবন আল আসের গোপন চুক্তিতে। প্রথম দিকে শত্রুতা থাকলেও আমরের সাথে মুয়াবিয়া গোপন চুক্তি সম্পাদন করেন এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় যে, আমর যদি মুয়াবিয়ার সাথে যোগ দেন তবে মুয়াবিয়া হযরত আলীকে পরাজিত করতে পারলে তাকে পুনরায় মিসরের শাসনকর্তা নিযুক্ত করা হবে। এই দুই ধূর্ত ও চতুর ষড়যন্ত্রকারীর মধ্যে যোগাযোগ নিঃসন্দেহে হযরত আলীর শক্তিকে ক্ষীণ করে। পৃ. ১৮১

(গ) আমর ইবন আস রা. সম্পর্কে লেখা হয়েছে:
“আমরের ধূর্ততা ও শঠতার ফলে সহসা যুদ্ধ স্থগিত হয়।” পৃ. ১৮২
“সভার কাজ শুরু হবার পূর্বে ধূর্ত ও কপট আমর সরলমতি আবু মুসাকে বুঝালেন” পৃ. ১৮২
“আমরের শঠতা ও কপটতা” পৃ. ১৮৩
.
(২) মোঃ মাহমুদুল হাছান, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি প্রথম পত্র (ঢাকা: লেকচার পাবলিকেশন্স লি. সম্পুর্ণ নতুন সংস্করণ: জানুয়ারি ২০২৩)

(ক) উসমান রা. সম্পর্কে লেখা হয়েছে:
“হযরত উসমান রা.-এর দুর্বল প্রকৃতি তার দুর্ভাগ্যের অন্যতম কারণ ছিল। ...... তিনি অনেক ক্ষেত্রে গুরুতর অপরাধীকেও ক্ষমা করতেন।” পৃ. ১৯১

(খ) সাহাবী রা.-গণ সম্পর্কে  লেখা হয়েছে:
“মহানবি (স.)-এর বিশ্বস্ত সাহাবিদের অনেকেই এ সময় জীবিত ছিলেন না, যাঁরা জীবিত ছিলেন তাঁরা হযরত উসমান (রা.)-কে বিপদের দিনে সৎ পরামর্শ ও সাহায্যদানে এগিয়ে আসেননি। ইসলামের মৌলিক লক্ষ্যের প্রতি ও জীবিত সাহাবিদের নিষ্ক্রিয়তা হযরত ‍উসমান (রা)-এর শত্রুদের হাতকে শক্তিশালী করেছিল। পৃ. ১৯১

(গ) মুআবিয়া রা. সম্পর্কে লেখা হয়েছে:
“মুয়াবিয়া (রা.) এক পর্যায়ে নিজেকে খলিফা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার ঘোষণা দেন এবং রক্তপাত নীতি গ্রহণ করেন। কূটকৌশলে বিজয়ী হয়ে ৬৬১ সালে মুয়াবিয়া খলিফা (শাসক) নির্বাচিত হন। পৃ. ১৯৩
“মুয়াবিয়া ছিলেন অত্যন্ত উচ্চাভিলাষী ও ক্ষমতালিপ্সু। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকতে তিনি এ হত্যাকাণ্ডের সাথে হযরত আলী (রা.) জড়িত ছিলেন বলে মিথ্যা প্রচারণা শুরু করেন।” পৃ. ১৯৯
“হযরত আলী (রা.) মুয়াবিয়ার ধৃষ্টতা, অবাধ্যতা ও খিলাফত লাভের উচ্চাকাঙ্ক্ষা দমনের জন্য .. “ পৃ. ১৯৯
“কিন্তু মুয়াবিয়ার ঔদ্ধত্যের কারণে কোনো পরিবর্তন হলো না।” পৃ. ১৯৯
“হযরত আলী (রা) মুয়াবিয়ার চতুরতা ও ধূর্তামি বুঝতে পারলেন” পৃ. ১৯৯

(ঘ) আমর ইবন আস রা. সম্পর্কে  লেখা হয়েছে:
”ধূর্ত ও কপট আমর সভার কাজ শুরু হওয়ার আগে আবু মুসা আল আয়শারীকে ডেকে দুজনে আলোচনা করলেন।” পৃ. ২০০
“এরপর নীলনকশার রূপকার আমর দাঁড়িয়ে জনসমাবেশে বললেন . “ পৃ. ২০০
.
(৩) ড. মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান খান ও ড. এ টি এম সামছুজ্জোহা, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি প্রথম পত্র (ঢাকা: অক্ষরপত্র প্রকাশনী, একাদশ সংস্করণ আগস্ট ২০২৪)
(ক) উসমান রা. সম্পর্কে লেখা হয়েছে:
“খলিফার চারিত্রিক দুর্বলতা: বিভিন্ন গুণে বিভূষিত হলেও খলিফা ওসমান (রা-এর চরিত্রগত দুর্বলতাই ছিল তার হত্যার অন্যতম কারণ।” পৃ. ১৭১

(খ) উষ্ট্রের যুদ্ধের কারণ হিসেবে একটি পয়েন্ট লেখা হয়েছে ‘আয়েশা (রা)-এর বিদ্বেষ’ শিরোনামে। পৃ. ১৭৮

(গ) মুআবিয়া রা. সম্পর্কে লেখা হয়েছে:
“মুয়াবিয়া ছিলেন অত্যন্ত উচ্চাভিলাষী ও ক্ষমতালিপ্সু। খলিফা ওসমান (রা)-এর হত্যাকাণ্ডের বিচার তাৎক্ষণিকভাবে করা আলির পক্ষে সম্ভব নয় - মুয়াবিয়া এটা বুঝতে পেরে বিচারকাজে খলিফার বিলম্বকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করেন। তিন এ হত্যাকাণ্ডের সাথে হযরত আলি (রা) নিজেও জড়িত ছিলেন বলে মিথ্যা প্রচারণা চালাতে শুরু করেন।” পৃ. ১৮১
“খলিফা তার প্রতিপক্ষ মুয়াবিয়ার কূটকৌশলের মর্মার্থ উপলব্ধি করে বিজয় নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যেতে চান।” পৃ. ১৮২

(ঘ) আমর ইবন আস রা. সম্পর্কে লেখা হয়েছে-
“কিন্তু মুয়াবিয়ার প্রতিনিধি আমর ইবনুল আস ছিলেন একজন ধূর্ত কূটনীতিবিদ।” পৃ. ১৮২
.
(৪) হাসান আলী চৌধুরী, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি প্রথম পত্র (ঢাকা: আইডিয়াল বুকস ঢাকা, দ্বাদশ সংস্করণ: ২০২৪)
উসমান রা. সম্পর্কে লেখা হয়েছে: “প্রায়ই কঠিন অপরাধীকেও ক্ষমা করতেন।” পৃ.১৭২
মুআবিয়া রা. সম্পর্কে লেখা হয়েছে: “কিন্তু ধূর্ত মুয়াবিয়া বাঘের মোকাবিলা করতে রাজি ছিল, কিন্তু ‘আল্লাহর বাঘের’ (শের-ই-খোদা) সাথে লড়াই করে অনিবার্য মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে রাজি হলেন না।” পৃ. ১৭৯

এমএম/


সম্পর্কিত খবর

সর্বশেষ সংবাদ