দেশের মুরব্বি আলেমদের অন্যতম আল্লামা আবদুল হামিদ পীর সাহেব মধুপুরী। দীনের বহুমুখী খেদমতের পাশাপাশি তিনি দীর্ঘদিন ধরে খতমে নবুওয়তের ইজ্জত রক্ষার আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে জড়িত। এই আন্দোলনের বেশ কিছু প্লাটফর্মকে ঐক্যবদ্ধ করে তিনি গড়ে তুলেছেন সম্মিলিত খতমে নবুওয়ত পরিষদ। এই সংগঠনের আয়োজনে আগামী ১৫ নভেম্বর রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক খতমে নবুওয়ত সম্মেলন। সেই সম্মেলনের প্রস্তুতি এবং খতমে নবুওয়ত আন্দোলনের নানা দিক নিয়ে প্রবীণ এই আলেমে দীনের মুখোমুখি হয়েছেন আওয়ার ইসলাম সম্পাদক হুমায়ুন আইয়ুব। অনুলিখন করেছেন লাজ্জাস আল হাবীব।
আওয়ার ইসলাম: ১৫ নভেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে খতমে নবুওতের যে মহাসম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে সেটার প্রস্তুতি কতদূর?
পীর সাহেব মধুপুর: আমরা তো মধুপুর থেকে এই সম্মেলনের ঘোষণা দিয়েছিলাম এক বছর আগেই। এখানে তখন ৬৪টি জেলার মধ্যে ৪২ জেলার লোক ছিল। বড় বড় উলামায়ে কেরাম ছিলেন। তাদের সামনেই ঘোষণা করা হয়েছিল। সম্মেলন বাস্তবায়নের জন্য এরপর থেকেই ধীরে ধীরে আমরা কাজ এগিয়ে নিয়েছি। এদিকে মাস ছয়েক আগে আমরা কাজ পুরোদমে শুরু করেছি আল্লামা মুহিবুল্লাহ বাবুনগরীর দোয়া নিয়ে। তাঁর কিছু পরামর্শ ও কথা নিয়ে কাজ শুরু হয়েছিল। এই সম্মেলন বাস্তবায়নের জন্য চট্টগ্রাম বিভাগের মাদরাসাগুলো সফর হয়েছে সংগঠনের পক্ষ থেকে। বরিশাল বিভাগে সফর হয়েছে। খুলনা বিভাগে সফর হয়েছে। রংপুর, দিনাজপুরে সফর হয়েছে। এদিকে সিলেটে সফর হয়েছে। নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, চাঁদপুরের দিকেও সফর হয়েছে। রাজশাহী, বগুড়াসহ আংশিক কিছু বাকি আছে—সেটা আমরা দুই-তিন দিনের ভেতরে শেষ করব।
আওয়ার ইসলাম: এই বয়সে দেশ-বিদেশে নানা প্রান্তে ক্লান্তিহীন সফর করছেন। নিঃসন্দেহে এটা ইশকে রাসুল ও খতমে নবুওয়াতের প্রতি দরদ না থাকলে হয় না। এ বিষয়ে আপনার অনুভূতি জানতে চাই।
পীর সাহেব মধুপুর: পাকিস্তান, আফগানিস্তানের উলামায়ে কেরামের সঙ্গে কথা হয়েছে। আফগানিস্তানের উলামায়ে কেরাম আসতেন। কিন্তু আমাদের দেশের সঙ্গে যেহেতু তাদের এখনো মুআদালা হয়নি—তাই আসতে পারছেন না। আগামীতে তাঁরা আসবেন। আফগানিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রধান বিচারপতি, ধর্মমন্ত্রী, বিদ্যুৎমন্ত্রীর সঙ্গে কথা হয়েছে। এমনকি খোশতের গভর্নরের সঙ্গেও কথা হয়েছে। তাঁরা খুব দোয়া দিয়েছেন আমাদের। আমাদের এই সফর ছিল আফগানিস্তানের সরকারের আমন্ত্রণেই। আফগানিস্তানের সফর শেষে আমাদের সাথীরা চলে আসে বাংলাদেশে। কিন্তু এরপর আমি এবং আফতাবনগরের মাওলানা মোহাম্মদ আলী সাহেব পাকিস্তান গিয়েছি। সেখানে বিভিন্ন শহর সফর করেছি। আল্লামা তাকী উসমানি সাহেবকে সরাসরি সম্মেলনের দাওয়াত দিয়েছি। তিনি দুই/তিন দিনের একটা সময় বের করে আসার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। আমরা আশা করছি তিনিও আসবেন।
মিসর থেকে মেহমান আসছেন। আরব জাহান থেকে মেহমান আসছেন। হিন্দুস্তান থেকে দারুল উলুম দেওবন্দের মুহতামিম মাওলানা আবুল কাসেম নোমানী সাহেব আসছেন। মাদানী পরিবারের সাইয়েদ মাহমুদ মাদানী, সাইয়েদ মওদুদ মাদানী আসছেন। দেশে-বিদেশে দাওয়াতের কাজ চলছে। এখনো যেগুলো বাকি আছে—সেগুলো চলছে।
আমরা আগামী সপ্তাহের ভেতরে সরকারের সঙ্গে বৈঠকে বসব। তারা যদি আমাদের দাবি, এমনকি সারা বিশ্বের মুসলমানদের দাবি মেনে নেন, তাহলে তো আলহামদুলিল্লাহ। এটা তাদেরও ভালো, দেশের জন্য ভালো, সবার জন্য ভালো। আর তারা যদি এই দাবি মানার ক্ষেত্রে গড়িমসি করে—তাহলে যেভাবে দাবি আদায় করতে হয়, আমরা ওইরকমভাবেই তাদের সঙ্গে মোকাবিলা করব। তারা তো কত আইনই পাস করছে।
আওয়ার ইসলাম: ১৫ নভেম্বর খতমে নবুওয়ত মহাসম্মেলনের মূল দাবিটা কী?
পীর সাহেব মধুপুর: আসলে আমাদের মূল দাবি তো আল্লাহর রাসুলের ইজ্জত ও শান রক্ষা। মুসলিম বিশ্বে যতগুলো দেশ আছে সব দেশই তো কাদিয়ানিদের কাফের ঘোষণা দিয়ে দিয়েছে। আমাদের ভাগ্যের নির্মম পরিহাস—আমরা এখনো এ দাবি আদায় করে নিতে পারিনি। এবার আমরা এই সম্মেলন থেকে সরকারের কাছ থেকে এই ঘোষণাটা নেব। এটাই আসল দাবি।
আওয়ার ইসলাম: যদি সরকার এই দাবি না মানে তখন কী করবেন?
পীর সাহেব মধুপুর: এ দাবি না মানলে আমরা বিকল্প ব্যবস্থা নেব—মানানোর জন্য, যেভাবে মানাতে পারি।
আওয়ার ইসলাম: এই সম্মেলনে খতমে নবুওয়ত নিয়ে কাজ করা ছোট-বড় সব সংগঠন আপনার নেতৃত্বে একীভূত হয়েছে। এটা কীভাবে সম্ভব হয়েছে?
পীর সাহেব মধুপুর: খতমে নবুওয়ত নিয়ে বড় দল, ছোট দল—অনেক দল আছে। বড়দের মধ্যে তাহাফফুজে খতমে নবুওয়ত আছে, আরও আরও অনেক দল আছে। তাদের সবার সঙ্গে বারবার বসেছি। তারাও বসেছেন, আমরাও বসেছি। খতমে নবুওয়ত সংরক্ষণ কমিটি কাজ করে যাচ্ছে। অন্য সংগঠনগুলো বলেছে, আমাদের সঙ্গে নেন। আর আমরাও ভেবেছি সবাই মিলে যদি আমরা কাজটা করি তাহলে এ দাবি আদায় আরও সহজ হবে। এরপর সব সংগঠন একসঙ্গে হয়ে আমরা কাজ শুরু করেছি। এখন আমাদের সংগঠনের নাম হলো সম্মিলিত খতমে নবুওয়ত পরিষদ। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে এভাবেই থাকার তাওফিক দিক। আমরা যেন এক ও নেক হয়ে কাজ করতে পারি।
আওয়ার ইসলাম: এই আন্দোলনটা তো অনেক দিন যাবত চলে আসছে, এটার ফলাফলটা আমরা পাচ্ছি না কেন?
পীর সাহেব মধুপুর: খতমে নবুওয়তের আন্দোলন হচ্ছে—এটা আমরা ছাত্রকাল থেকে দেখে এসেছি। খতিব ওবায়দুল হক রাহিমাহুল্লাহ, আল্লামা আজিজুল হক রাহিমাহুল্লাহসহ আমাদের মুরব্বিগণ ঢাকার মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে সম্মেলন করেছিলেন। তখন আমাদের একটা আশা ছিল—খতমে নবুওয়তের এই দাবি পূরণ হয়ে যাবে। কিন্তু তখন তা পূরণ হয়নি। পেছনে যা চলে গেছে—গেছেই। ওই সব বিষয়ে আলোচনা এখন আর সামনে আনতে চাই না। এরপর খতমে নবুওয়তের এই দাবির কাজটা তো একেবারেই মৃত হয়ে গিয়েছিল। আমরা খতমে নবুওয়তের দাবি আদায়ের জন্য চেষ্টা করছি ১৯৯৭ সালের বাহাসের পর থেকে।
আমাদের এই অঞ্চলে নবী দাবি করেছিল এক লোক, তার নাম ছিল বরকতুল্লাহ। আমি তার নাম দিয়েছিলাম—বড় কুত্তা। চরমোনাইর মরহুম পীর ফজলুল করীম সাহেব নাম দিয়েছিলেন লানাতুল্লাহ। সেই সময় থেকে বাংলাদেশের যত বড় বড় উলামায়ে কেরাম ছিলেন—মাওলানা খতিব ওবায়দুল হক সাহেব, মাওলানা আজিজুল হক সাহেব, মুফতি আমিনী সাহেব, মাওলানা মহিউদ্দীন খান সাহেব, পটিয়ার মুহতামিম মাওলানা হারুন ইসলামাবাদী সাহেব, চরমোনাইয়ের পীর সাহেব, ফুরফুরার পীর সাহেব, ছারছিনার পীর সাহেব, মাওলানা আহমদ উল্লাহ আশরাফ সাহেবসহ আরও যত বড় বড় আলেমগণ ছিলেন তাদের উপস্থিতিতে আমরা এই ফেতনাটাকে খতম করার সুযোগ আল্লাহ তাআলা দিয়েছিলেন।
আমরা তো কিছু কাজের পর ঘুমিয়ে পড়ি। কিন্তু কাদিয়ানিরা তো কাজ করতেই থাকে। তারা তো ঘুমায় না। ইদানীং তারা আবার সারাদেশে মাথাচাড়া দিয়েছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন বড় বড় শহরে গ্রামে-গঞ্জে তারা কাজ করছে। মুসলমানদের কাফের বানাচ্ছে। সে জন্য আমরা আমাদের খতমে নবুওয়ত সংরক্ষণ কমিটির পক্ষ থেকে আল্লাহ রাসুলের শান ইজ্জতের জন্য বড় কোনো কাজ করতে পারিনি। তবে ছোটখাটো কিছু কাজ করছি। এই মহাসম্মেলনও সেই কাজেরই ধারাবাহিকতা।
এনএইচ/