শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫


মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের কাছে নিবেদন (পর্ব-১১)

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

আওয়ার ইসলাম ডেস্ক: বুদ্ধিজীবীদের কাছে আর একটি কথা যা নিবেদন করতে চাই তা হল- উলামায়ে কেরামকে কাছ থেকে বোঝার চেষ্টা করুন বুদ্ধিজীবীগণ উলামায়ে কেরামকে কখনও জঙ্গী সন্ত্রাসী, কখনও সাম্প্রদায়িক, কখনও ধর্মান্ধ, কখনও ধর্মব্যবসায়ী, কখনওবা অন্য অনেক ধরনের বুলিবচন দ্বারা বিভূষিত করে থাকেন।

প্রকৃতপক্ষেই উলামায়ে কেরাম জঙ্গী সন্ত্রাসী বা সাম্প্রদায়িক বা ধর্মান্ধ কিংবা ধর্মব্যবসায়ী কি না- এ সম্বন্ধে পূর্বে তিন পর্বে (পর্ব ৮, ৯ ও ১০য়ে) কিছু কথা পেশ করা হয়েছে।

বস্তুত বুদ্ধিজীবীগণ উলামায়ে কেরাম সম্বন্ধে এসব অভিধা একে অন্য থেকে শুনে বা নিছক ধারণা থেকে বা ভিন্ন কোন উদ্দেশ্য সামনে রেখে প্রয়োগ করে থাকেন। যারা না জেনে এরূপ করেন তাদের কাছে নিবেদন করব উলামায়ে কেরামের কাছে এসে বিষয়গুলো যাচাই করে দেখুন। দূরে থেকেই কিছু কথা শুনে শুনে আর কিছু কথা বদ-গোমানী থেকে বলে যাবেন না।

অনুমান করি এবং লক্ষণাদি থেকেও অনেকটা স্পষ্ট যে, কেউ কেউ অসৎ অভিপ্রায়ে মিথ্যা রচনা করেই এগুলো বলে থাকেন। তাদের জন্য দুআ করি এবং তাদেরকে সত্যনিষ্ঠ হওয়ার আহ্বান জানাই। আমরা নিশ্চয়তা দিয়ে বলছি- হে বুদ্ধিজীবীগণ! আপনারা হক্কানী উলামায়ে কেরামকে কাছ থেকে দেখুন, কাছ থেকে তাদের কথা শুনুন, কাছ থেকে তাদেরকে বোঝার চেষ্টা করুন। ইনশা আল্লাহ উলামায়ে কেরাম সম্বন্ধে আপনাদের ধারণা বদলে যাবে। বিচিত্র নয় তাহলে ঘৃণাবোধ শ্রদ্ধাবোধে রূপান্তরিত হয়ে যাবে। হযরত ওমর রা. ও হযরত আমর ইবনুল আস রা.-এর ঘটনা তার প্রমাণ। ঘটনা সামনে উল্লেখ করছি।

বস্তুত ইসলামের আমলসমূহ যেমন দূরের থেকে খারাপ বোধ হয় কাছে এলে ভাল লাগে, তদ্রূপ ইসলামের নেতৃবৃন্দ উলামায়ে কেরামকেও দূরের থেকে খারাপ মনে হয় কাছে এলে ক্রমান্বয়ে ভাল লাগে।

ইসলামের আমল তথা জান্নাতী লাইনের আমল দূরের থেকে খারাপ বোধ হয় কাছে এলে ভাল লাগে। এর বিপরীত ইসলাম বিরোধী আমল তথা জাহান্নামী লাইনের আমল দূরের থেকে ভাল লাগে কাছে এলে তা কত খারাপ তা বোঝা যায়- এটা বর্ণিত হয়েছে নিম্নোক্ত হাদীছে। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, حُجِبتِ النَّارُ بالشَّهواتِ وحُجِبَتِ الجنَّةُ بالمكَارِهِ. متفق عليه. অর্থাৎ, জান্নাতকে পর্দাবৃত রাখা হয়েছে এমন সব আমল দিয়ে যা (প্রথমদিকে) খারাপ লাগে। আর জাহান্নামকে পর্দাবৃত রাখা হয়েছে এমন সব জিনিস দিয়ে যা (প্রথমদিকে) আকর্ষণীয় বোধ হয়। (বোখারী: হাদীছ নং ৬৪৮৭ ও মুসলিম: হাদীছ নং ২৮২৩)

এজন্যই দেখা যায় আমল শুরু করার আগে নামায পর্দা ইত্যাদি বিধান ও আদর্শসমূহ কত কষ্টকর ও অপছন্দনীয় বোধ হয়, কিন্তু আমল শুরু করলে ধীরে ধীরে কষ্ট লাগা কমে যায় এমনকি এক পর্যায়ে ভাল লাগতে শুরু করে। সত্যিকারের ধর্মপ্রাণ লোকদের কাছে জিজ্ঞেস করলেই জানা যাবে ধর্মকর্মে তারা কতটা স্বাচ্ছন্দ্য ও আনন্দ বোধ করেন। এর বিপরীত ইসলাম বিরোধী আদর্শ সাময়িক চাকচিক্যময় ও আকর্ষণীয় বোধ হলেও তার ভিতরে ঢুকলে ক্রমান্বয়ে তার কদর্য রূপ সামনে এসে যায় এবং সুস্থ বিবেকের কাছে তা অসহ্যময় হয়ে ওঠে। এই তো কত আকর্ষণীয় ভেবে পৃথিবীর কত দেশ সমাজতন্ত্র গ্রহণ করেছিল, কিন্তু ভিতরে ঢোকার পর বুঝেছে এটা আদৌ জীবনের উপযোগী ও চলনসই মতাদর্শ নয়। তখন সেটাকে থুতু মেরে ডাস্টবিনে নিক্ষেপ করেছে। ফ্রি মিক্সিং ও ফ্রি সেক্সের লাইফে ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে, বিতৃষ্ণ হয়ে তা থেকে ফিরে আসার অসংখ্য ঘটনা তো নিত্যই আমাদের সামনে ঘটে চলেছে।

আর ইসলামের নেতৃবৃন্দ উলামায়ে কেরামকে দূরের থেকে খারাপ মনে হয় কাছে গেলে ভাল লাগে তার প্রমাণ হযরত ওমর রা. ও হযরত আমর ইবনুল আস রা.-এর ঘটনা। হযরত ওমর রা.-এর ঘটনা প্রসিদ্ধ। তিনি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হত্যা করার জন্য গিয়েছিলেন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি ছিল তার প্রচণ্ড ক্ষোভ। কিন্তু ইসলাম গ্রহণ ও রাসূলের কাছে আসার ফলে এক সময় এমন হয়েছে যে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামই হয়েছেন তার কাছে সবচেয়ে প্রিয় মানুষ। বোখারী শরীফের এক হাদীছের বর্ণনামতে তখন হযরত ওমর রা. বলেছেন, واللَّهِ، لَأَنْتَ أحَبُّ إلَيَّ مِن نَفْسِي. অর্থাৎ, আল্লাহর কসম! আপনি আমার কাছে আমার জীবনের চেয়েও প্রিয়। (বোখারী: হাদীছ নং ৬৬৩২)

হযরত আমর ইবনুল আস রা.-এর ঘটনাও প্রসিদ্ধ। মুসলিম শরীফের ১২১ নং হাদীছের বর্ণনায় এসেছে- মৃত্যুর পূর্বে এক প্রসঙ্গ এলে হযরত আমর ইবনুল আস রা. তার পুত্র আব্দুল্লাহ-এর কাছে বলেছিলেন, আমার জীবনের একটা সময় এমন ছিল যখন রসূলের প্রতি আমার চেয়ে বেশি বিদ্বেষ কেউ রাখত না। সুযোগ পেলেই তাকে হত্যা দেয়া ছিল আমার কাছে সবচেয়ে বেশি প্রিয়। তারপর যখন আমি ইসলাম গ্রহণ করলাম, রসূলের কাছে এলাম, তখন আমার অবস্থা এমন হয়েছে যে, রসূলের চেয়ে বেশি প্রিয় আমার কাছে আর কেউ ছিল না। আমার নজরে তার চেয়ে বেশি সম্মানিত আর কেউ ছিল না।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এলে যেমন সকলে তার প্রতি মুগ্ধ হত, নবীর প্রতিনিধি হক্কানী উলামায়ে কেরামের কাছে এলেও একই অবস্থা হবে। তাদের কাছে এলে দেখবেন- যে উলামায়ে কেরামকে আপনারা দেশছাড়া করতে চান, যাদের ধ্বংস কামনা করেন, তারাই গভীর রাতে তাহাজ্জুদ পড়ে আপনাদের হেদায়েত ও মাগফেরাতের জন্য দুআ করছেন।

এটাই প্রকৃত মূলধারার উলামায়ে কেরামের চরিত্র। হতে পারে দু'একজনকে আপনারা এর ব্যতিক্রম পেয়েছেন। সেটা ব্যতিক্রম। আর ব্যতিক্রম তো ব্যতিক্রমই। ব্যতিক্রমমূলক উদাহরণ কখনই সর্বসামগ্রিক অবস্থার বিরুদ্ধে দলীল হয় না। "Exception is never an example". উলামায়ে কেরাম উম্মতের জন্য এমনটা দরদী হবেন সেটাই স্বাভাবিক। কারণ তারা তো ঐই নবীর উত্তরসূরী, তারা তো ঐই নবীর প্রতিনিধিত্ব করেন যে নবীকে কিছু লোক নির্যাতন করে প্রাণে নিঃশেষ করে দিতে চাইত, তাকে দেশ থেকে বহিষ্কার করে দিতে চাইত, তাকে রক্তাক্ত করে দিত আর তিনি তাদের জন্য দুআ করতেন এই বলে, اللهم اغفر قومي فإنهم لا يعلمون. (متفق عليه) অর্থাৎ, হে আল্লাহ! আমার কওমকে তুমি ক্ষমা করো, ওরা যে বোঝে না। (বোখারী: হাদীছ নং ৬১১৪ ও মুসলিম: হাদীছ নং ২৬০৯)

আপনারা চান আলেম সমাজ ধ্বংস হোক, কিন্তু আলেম সমাজের কাছে এলে বুঝবেন দরদী আলেম সমাজ চান আপনারা যেন ধ্বংস না হন, আপনারা যেন জাহান্নামী না হন। দরদী আলেম সমাজ দেখছেন আপনারা জাহান্নামের গর্তের কিনারায় উপনীত, তারা আপনাদের কমর ধরে ধরে জাহান্নাম থেকে উদ্ধার করার চেষ্টা করছেন। যেমনটা বলেছেন উম্মতের দরদী নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তিনি বলেছেন, فأنا آخُذُ بحُجَزِكُمْ عَنِ النَّارِ. অর্থাৎ, বস্তুত আমি তোমাদের কোমর ধরে ধরে জাহান্নাম থেকে উদ্ধার করছি! (বোখারী: হাদীছ নং ৬৪৮৩)

আলেম সমাজ আপনাদের জন্য দরদী। তারা আপনাদের অমঙ্গলকামী নন বরং মঙ্গলকামী। তারা চান আপনারা যেন চির মঙ্গলময় জান্নাতের অধিকারী হতে পারেন। আলেম সমাজের পরিণাম খারাপ হোক ভাবলে হয়তো আপনাদের আনন্দ বোধ হয়, কিন্তু আপনাদের পরিণাম খারাপ হওয়ার চিন্তা মাথায় এলে আলেম সমাজ দুশ্চিন্তায় পড়ে যান এই ভেবে যে, আল্লাহ যদি প্রশ্ন করেন তাদের হেদায়েতের জন্য তোমরা যথাযথ চেষ্টা করেছিলে কি না তখন তার উত্তর দিতে পারব কি না।

আলেমদের এসব অনুভূতি দূরের থেকে বুঝা যায় না। কাছে এলে বুঝা যায়। দূরে থেকে আলেমদের সঙ্গে বাহাছ ডিবেট করার সময় কিংবা ইমোশনাল হয়ে ইটাইটি করার সময় এসব অনুভূতি সম্বন্ধে অবগত হওয়া যায় না। কারণ এসব মুহূর্তে শুধু প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার মত চিন্তাই প্রবল থাকে। তখন মনের দরদ ব্যাথা ব্যক্ত করার চিন্তাও থাকে না, পরিবেশও থাকে না। তখন অন্যরাও তাদের দরদ ব্যাথা বুঝতে সক্ষম হয় না। এসব মুহূর্তে অন্য পক্ষের দরদ ব্যাথা বুঝার চেষ্টা করাও হয় না।
وما عليناإلا البلاغ.

-এটি


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ