শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫


অপরূপ বর্ষায় প্রকৃতির ঝাপাঝাপি

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

রাশেদুল ইসলাম।।

আজো দেখা নেই রূপসী বর্ষার- ছোটবেলায় যেভাবে বর্ষাকে কাছে পেতাম, উপভোগ করতাম, বৃষ্টিতে ভিজে একাকার হয়ে খাল, বিল, পুকুর বা নদীর পানিতে ঝাপাঝাপি, দাপাদাপি করতাম; এখন আর তেমনটা হয় না। বর্ষাও কেমন জানি আগের মতো নিয়ম করে আসে না! বইয়ের পাতায় পড়তাম - 'আষাঢ় শ্রাবণ দুই মাস বর্ষাকাল'। তখন এর ব্যতিক্রম খুব একটা দেখা যেত না। বৈশাখে ধান কাটার পর আবাদি জমিগুলো কিছুদিন ফসলশূন্য পতিত পড়ে থাকতো। ধানের অবশিষ্ট নাড়াতে তোড়া অঙ্কুরিত হত।

নিচে মাটিতে জন্মাতো সবুজ ঘাস। অল্প সময়ের ব্যবধানে আবার সবুজময় হয়ে উঠতো পুরো মাঠ। গ্রামের রাখালেরা মাঠে গরু চরাতো, ক্ষেতের আইলে বসে বাঁশি বাজাতো, নতুন নতুন গানের সুর ধরতো। বাঁশির সুরে সুরে গরু বাছুর নেচে নেচে ঘাস খেতো। কিছুদিনের মধ্যেই মাঠে প্রবেশ করতো বন্যার পানি। আকাশে অনিয়মিত দেখা যেতো মেঘের আনাগোনা, বিজলির চমক, কখনো বা মেঘের গুরুগুরু, বজ্রধ্বনি। ইচ্ছে হলেই আকাশ থেকে অবিরাম ধারায় ঝরে ঝরে পরতো বৃষ্টির ফোঁটা। কখনো রিমঝিম, কখনো মুষলধারে, কখনো বা টাপুর টুপুর আওয়াজ তোলে। নদী-নালা, মাঠ-ঘাট সব ভরে যেতো মেঘবৃষ্টি ও বন্যার পানিতে। তখন আর বুঝতে বাকি রইতোনা বর্ষা এসে গেছে। আষাঢ় শুরু হয়েছে।

তখন প্রকৃতি খুব নিয়ম করে চলতো। অথবা যেভাবে পরিচালিত হত প্রকৃতির সবকিছু ঠিক সেই নিয়মটা আমরা ধরতে পেরেছিলাম, জানতে পেরেছিলাম। যারা গ্রামের বাইরে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন প্রয়োজনে থাকতো তারাও আষাঢ়ের আগমনে বুঝতে পারতো বর্ষা শুরু হয়ছে, নদীতে নতুন পানি প্রবেশ করেছে, নদীর জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে খড়কুটো, ডোবে যাচ্ছে মাঠ ঘাট, গ্রামের আঁকাবাঁকা মেঠোপথ। তাইতো, অনেকেই ঘটা করে শহর থেকে ছুটে আসতো গ্রামে। নদীর পানি দেখতে। বর্ষার ঘোলাজলে নৌকা নিয়ে ভেসে চলার সাধ মেটাতে।

এখন আর প্রকৃতি আগের মত নিয়ম করে চলে না কিম্বা আমরা তার সঠিক নিয়মটা ধরতে পারি না। পুরো বৈশাখ চলে যায়; দেখা হয় না কাল বৈশাখী ঝড়ের তাণ্ডব। জৈষ্ঠ আম কাঁঠালের মৌসুম। জৈষ্ঠ পেরিয়ে এই আষাঢ়ে দেখা দিয়েছে আম, জাম, কাঁঠাল।মুখে পড়ছে পাকা পাকা আম, জাম, কাঁঠালের সুমিষ্ট রোয়া। এখন আষাঢ় চলে যাচ্ছে তবু আভাস নেই বর্ষার! আকাশে কালো মেঘের আনাগোনা, জমিনে বৃষ্টির রিমিঝিমি, টিনের চালে বৃষ্টির টাপুর টুপুর শব্দ থাকলেও সাগরের জলচ্ছাসে উছলে দিচ্ছে না তার ভিতরে লুকিয়ে রাখা পানি। ও যেন সব পানি নিজের বুকেই জমিয়ে রাখতে চাইছে। তাইতো, কেন ভাগ দিবে অন্যকে? কেন নদী বেয়ে পানি পাঠাবে আমাদের কাছে?

এক সপ্তাহ ধরে লাগাতর বৃষ্টি! ছোট ছোট পুকুর ডোবা সব ভরে গেছে বৃষ্টির পানিতে। বিলের তালাতেও জামেছে প্রচুর পানি। কিন্তু শুধু বৃষ্টির কি সাধ্য আছে নদী নালা সব ভরিয়ে দিতে? মাঠ ঘাট সব ডুবিয়ে দিতে - যদি সাগর সাহায্য না করে? তার বুকের মানিক 'দুগ্ধ স্রোতরূপী' পানিকে না ছাড়ে?

এইতো আষাঢ়ের সমাপ্তি হতে চলেছে। বর্ষা বিষয়ক আগেকার প্রবন্ধ রচনাগুলো পড়ে এখন অবিশ্বাস্য লাগে, বিশ্বাস হতে চায় না। মনে হয় লেখক এখানে বড় মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছেন। অথবা মাসের হিসাবে চরম ভুল করেছেন তারা। আবার একেবারে অবিশ্বাসও করতে পারিনা। লোক মুখেও তো প্রচলিত একই কথা একই বুলি। এছাড়া নিজেরাও তো দেখেছি শৈশবে এর বাস্তব নমুনা! বর্ষার এ নিয়ম মেনে চলা।

প্রখ্যাত ভাষাবিদ ড. হায়াত মাহমুদ লিখেছেন, 'আষাঢ় শ্রাবণ দুই মাস বর্ষাকাল। কিন্তু আমাদের দেশে বর্ষার আগমন অনেক আগেই ঘটে।কোন কোন সময় বর্ষা জৈষ্ঠ্যমাসে আরম্ভ হয়ে আশ্বিনমাস পর্যন্ত স্থায়ী হয়।'

রবীন্দ্রনাথও একই গীত গেয়েছেন কবিতার ভাষায় - 'আষাঢ়ে বাদল নামে নদী ভর ভর।' কিন্তু কই?! আষাঢ়ের বিদায় ঘন্টায় শ্রাবণ উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে দোরগোড়ায়। আষাঢ় চলে যাওয়া মাত্রই প্রবেশ করবে শ্রাবণ। কিন্তু এখনো দেখা নেই বর্ষার! ধানকাটা ফসলি জমিগুলো এখনো পতিত পড়ে আছে। নতুন কোন ফসল ফলানো যাচ্ছেনা! কৃষকেরা সবাই জানে বর্ষা চলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত ফসল ফলানো যাবেনা। নদীর চরায় কিছু কিছু জায়গায় পাট চাষ করা হয়েছে। কিন্তু সব জমি তো আর পাটচাষের উপযোগী নয়!

এই পতিত ভূমিগুলো যেন বর্ষার ভাসা পানির অপেক্ষায় তৃষ্ণার্ত হয়ে আছে। প্রতিক্ষায় প্রহর গুনছে কখন আসে বর্ষা,,!

কখনো সীমাহীন বারিবর্ষণে ভিজে কাদাযুক্ত হয়ে যাচ্ছে মাঠ ঘাট। ভরে যাচ্ছে পুকুর ডোবা। আবার প্রচন্ড রৌদ্রের প্রতাপে মাটি শুষে নিচ্ছে সব পানি।এভাবে রোদ বৃষ্টির মাঝেই শেষ হয়ে যাচ্ছে আষাঢ়ের দিনগুলি। বর্ষা আসছে না। নদী-নালা, খাল-বিল ভরছে না। আমাদেরও অপেক্ষার পালা শেষ হচ্ছে না! কৃষকের মনেও চিন্তার অবসান ঘটছে না- বর্ষার নতুন জলে ভূমি স্নান না করলে যে ফসলের সুবিধা করা যাবে না! ভূমি তার যথাযথ উর্বরতা পাবে না! কিন্তু কী আর করার আছে মানুষের - শুধু অপেক্ষা ছাড়া! আশায় বুক বেঁধে বসে থাকা ছাড়া! প্রকৃতির নিয়ন্তা যেভাবে পরিচালিত করেন সেভাবেই তো চলতে হয় তাকে। তাঁর কাছে যে মানুষের ধরাবাঁধা নিয়মের কোন মূল্য নেই! বর্ষা প্রেরণে আষাঢ়-শ্রাবণ, ভাদ্রের কোন বিধিবদ্ধতা যেই নেই! তিনি যখন যেভাবে চান তাই হয়। যা ইচ্ছা তাই করেন!

-এএ


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ