শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫


আসামের এক মুসলিমের করুণ কাহিনী

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

আওয়ার ইসলাম: কথা বলার সময় গলা ধরে আসছিল ৫৯ বছরের প্রৌঢ়ের। একটি খেতের পাশে দাঁড়িয়ে আঙুল দেখিয়ে আব্দুল মোতলেবের প্রশ্ন, ‘ওই জায়গাটি দেখতে পাচ্ছেন?’ খানিক থেমে শুরু করলেন, ‘এখানেই আমার ছোট ভাই আব্দুল হাসিম চাষের কাজ করছিল। সঙ্গে ছিল আরো পাঁচজন। কাউকে ছাড় দেয়া হয়নি।

আমার সামনেই ভাইকে প্রথমে পরপর গুলি করা হলো। খেতের পানিতে লুটিয়ে পড়ল ও। তারপর এলোপাথারি চপারের কোপ মেরে টুকরো টুকরো করে ফেলা হয়েছিল।

ভাইয়ের সঙ্গে বাকিদেরও একই হাল হয়েছিল। প্রাণ বাঁচাতে আমি তখন দৌড়চ্ছি। তখন আমার বয়স মাত্র ২৫। ভাইয়ের ১৮। সেদিন রক্ষা করতে পারিনি ভাইকে।’

এরপরই চোখের দু’কোণ মুছে বললেন, ‘সেই আতঙ্কের দিন কি আবার ফিরে আসছে?’ ১৯৮৩ সালে আসাম আন্দোলনের নামে যেভাবে গণহত্যা চলেছিল, আজও তা মুছে যায়নি ভারতের আসাম রাজ্যের নেলি এলাকার সংখ্যালঘু প্রৌঢ়-বৃদ্ধদের মন থেকে।

তাই আব্দুল মতলেবের এখন একটাই ভাবনা, ‘জানি না কী হবে! আদৌ কবে এই ঝঞ্ঝাটের অবসান হবে।’ শুধু আব্দুল মোতলেব নন, জাকির হোসেন, রহমত আলি, আব্দুল হাকিমদের মতো অনেকেরই প্রশ্ন, ‘কেন এভাবে আমাদের নামই বাদ পড়ছে? নাগরিকপঞ্জিতে কেন আমাদের বা বাড়ির সদস্যদের প্রত্যেকের নাম ঠাঁই পাচ্ছে না? আর কতভাবে প্রমাণ করতে হবে আমরা এদেশের নাগরিক?’

আব্দুল মোতলেবের বড় ছেলে হায়দর আলির নাম ঠাঁই পায়নি তালিকায়। বললেন, ‘ছেলের নাম যখন পঞ্জি যারা করছেন, তারা প্রথমে লিখেছিলেন, হায়দর আলি।

আমি গিয়ে সংশোধন করে আসি। তারপর দেখলাম, তালিকায় নামই নেই। চিন্তা তো থাকবেই। যদি ছেলের নাগরিকত্ব প্রমাণ না পেয়ে ডিটেনশন কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেয়!’

মোতলেব সাহেবের এক আত্মীয় আয়ূব আলির পরিবার গত তিন বছর ধরে এধরনের কেন্দ্রে রয়েছে। তার কথায়, ‘আমি জানি কী কষ্টে তাঁরা জীবনযাপন করছেন সেখানে।’ তাই ভয় ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়েও।

গৌহাটি শহর থেকে প্রায় ৭৩ কিলোমিটার দূরে উজান অসমের প্রত্যন্ত এলাকা নেলি। ডিব্রুগড়, জোড়হাটগামী ন্যাশনাল হাইওয়ে থেকে একটি রাস্তা নেলির দিকে চলে গেছে। সেই নেলি থানার মোড় থেকেই দু’-আড়াই কিমি রাস্তা পেরলেই ভোগডুবা হাবি গ্রাম।

রাস্তার কিছুটা যাওয়ার পর গাড়ি থেকে নেমে পড়তে হলো। কারণ, বৃষ্টিতে রাস্তা বলে কিছু আর নেই। কাদা পেরিয়ে ঢুকতে হলো ওই গ্রামে। বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, উন্নয়ন এই গ্রামে ঢোকার দু’কিমি আগেই থমকে গিয়েছে।

ভোগডুবার হাবির একদিকে বসন্ধুরি, অন্যদিকে, মোলাদারি, বুটুনিমারার মতো প্রায় সাত-আটটি গ্রাম। মাঝখান দিয়ে গিয়েছে ডিলমা নদী। যদিও সেটির বেশিরভাগই অংশই কচুরিপানার গ্রাসে।

ব্যবসার হিসাব এখন খুব সহজে, রেজিস্ট্রেশন করুন  বিসফটিতে

আসাম আন্দোলনের সময় ১৯৮৩ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি মরিগাঁও (আগে নগাঁও) জেলার অন্তর্গত নেলির এই গ্রামগুলিতেই চলেছিল নরহত্যা। মাত্র ছ’ঘণ্টার মধ্যে বাংলাদেশি সন্দেহে প্রায় আড়াই থেকে তিন হাজার মানুষকে খুন করা হয়েছিল।

আব্দুল মোতলেবের কথায়, ‘সকাল ছ’টার সময়ে হামলা হয়েছিল। দুপুর তিনটে অবধি অবাধে হত্যা চলেছিল। আমরা প্রত্যেকেই সিআরপিএফ ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছিলাম। পরে ভাই বা অনেকের দেহ যাতে কেউ না নিয়ে যেতে পারে, আমি কচুরিপানা দিয়ে ঢেকি দিয়েছিলাম।

তবে গত ৩৪ বছরে দামোদর নদ বা বরাক নদী দিয়ে অনেক পানি বয়ে গিয়েছে। এখন আমরা ভালোই ছিলাম। আগের মতো কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু সমস্যা তৈরি হয়েছে ফের এই নাগরিকপঞ্জি নিয়েই। কেন নাম উঠল না বা কীসের ত্রুটি থেকে গেল, সেটাই আতঙ্কের।’

আশি ছুঁইছুঁই রহমত আলি বললেন, তার নাম উঠলেও মেয়ের নাম নেই। আবার মোহাম্মদ সৌরজ আলি বা আব্দুল হাকিম বললেন, ‘আমাদের পরিবারের বেশ কয়েকজনের নাম বাদ গেছে।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেল, প্রায় ছ’হাজারের কাছাকাছি মানুষের বাস এই গ্রামগুলোতে। কিন্তু নাম নেই প্রায় ৭০ শতাংশের উপরে বসবাসকারীর। ফলে ‘অনুপ্রবেশকারী’ সন্দেহের আতঙ্ক ফের ফিরে আসছে তাদের মনে।

রহমত আলির কথায়, ‘আমাদের এই গ্রামগুলোর অসংখ্য মানুষের নাম তালিকায় নেই। আতঙ্ক তো আবারো তৈরি হয়েছে। এবার কি আমাদের বের করে দেবে দেশ থেকে?’ আবার তাদের মধ্যেই আব্দুল রউফ বললেন, ‘শুনেছি, সরকার কাউকেই বের করবে না।

তালিকা তো সংশোধন হবে। এটা তো চূড়ান্ত তালিকা নয়।’ ‘কিন্তু চূড়ান্ত তালিকাতেও যদি না থাকে?’ প্রশ্ন তালিকায় নাম না থাকা বসন্ধুরির জাকির হোসেনের। তবে নাম না থাকলেও আপাতত সরকারের উপরে আস্থা রাখছেন গ্রামের এই প্রবীণরা।

বলছেন, ‘রাজ্য তো সবারই নাম রাখবে বলছে, তাহলে চিন্তা এখন করছি কেন?’ যদিও তাদেরই মধ্যে একজনের কথায়, ‘জানেন তো, চাষবাস বা কারবার করে দিন কাটাই।

তাছাড়া আমরা হচ্ছি ঘরপোড়া গোরু। সিঁদুরে মেঘ দেখতে ভয় পাই।’ বোঝা গেল, নাগরিকপঞ্জিতে নাম না থাকার আতঙ্ক এই প্রত্যন্ত এলাকার মানুষজনকে গ্রাস করলেও, পানিতে থেকে কুমিরের সঙ্গে লড়াইয়ের সাহস দেখাতে পারছেন না তারা।

সূত্র: অ্যারাবিয়ান জার্নাল

-আরআর


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ