|| আয়েশা আর রুমাইছি ||
প্রযুক্তিগত অগ্রগতি আমাদের এমন সব পথে টেনে নিচ্ছে, যা কয়েক বছর আগেও কল্পনার বাইরে ছিল। এর দ্রুত উন্নয়ন আমাদের নিয়ে যাচ্ছে বাস্তব কিছু বিপ্লবের দিকে—যেমন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-সম্বলিত রোবট, যারা নতুন যুগের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিচ্ছে এবং মানুষের সহায়তায় বিস্ময়কর ক্ষমতা প্রদর্শন করছে। ফলে, এগুলো এখন শিল্প, স্বাস্থ্যসেবা এবং সরবরাহ ব্যবস্থার মতো খাতে ব্যবহৃত হচ্ছে, যেখানে কিছু কিছু ক্ষেত্রে মানুষের চেয়েও ভালো কর্মক্ষমতা দেখাতে পারছে, এমনকি অচিরেই মানবসদৃশ আচরণও করতে পারবে—আবেগগত দিক থেকেও।
বুদ্ধিমান রোবটের এই দ্রুত বিকাশের পেছনে রয়েছে সেন্সর, প্রসেসর, এবং যান্ত্রিক উপাদানগুলোর প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ। এখন রোবটগুলো খুব সূক্ষ্মভাবে চলাফেরা করতে পারে, এমনকি সুরক্ষা বেষ্টনী ছাড়াও, কারণ তারা বাস্তব সময়ে আশপাশের পরিবেশ বুঝতে এবং সম্ভাব্য বিপদ শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছে।
মূলত, রোবট ডিজাইন করা হয়েছে নির্দিষ্ট দৈনন্দিন কাজের জন্য—যেমন হোটেল, হাসপাতাল, বা অনলাইন খুচরা বিক্রয়ে ব্যবহার। অনেক সময় এর পেছনে উদ্দেশ্য ছিল মানব শ্রমের ঘাটতি পূরণ বা দক্ষতার কোনো নির্দিষ্ট চাহিদা। জটিল বা ঝুঁকিপূর্ণ কাজগুলোতে বিশেষ করে রোবট ব্যবহৃত হয়। আধুনিক অ্যালগরিদম ও ডেটার মাধ্যমে রোবট আজ শিখছে—মেশিন লার্নিং, ডিপ লার্নিং ও জটিল নিউরাল নেটওয়ার্কের সাহায্যে।
এই অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে, যা জীবনে ও অর্থনীতিতে আমূল পরিবর্তন আনতে পারে, আমরা এমন এক যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছি যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-ভিত্তিক রোবট মানবজাতির অংশীদার হবে।
এখানে প্রশ্ন উঠছে—মানব ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মধ্যে সহযোগিতা কতটা কার্যকর হবে? এই রোবটগুলো হতে পারে অর্থনীতির জন্য এক বিশাল মোড় পরিবর্তনকারী প্রযুক্তি। যদিও এগুলোর আগমন কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ক্ষেত্রেও ঘটছে, ফলে এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে নৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যা।
অনেক প্রতিষ্ঠান ও দেশ এখন এই রোবটগুলোকে শিল্প ও গণপরিসেবা খাতে কাজে লাগাচ্ছে দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য। এতে করে মানবশ্রমের ঘাটতি পূরণ সম্ভব হচ্ছে। কিন্তু, এর ফলে যেসব কাজ আগে মানুষ করত, তা রোবটের হাতে চলে যাওয়ায় বেকারত্ব বাড়তে পারে।
যদিও রোবট প্রোগ্রামিং, মেরামত ও উন্নয়নমূলক কাজের মাধ্যমে নতুন চাকরি তৈরি হচ্ছে, তবু এই নতুন কাজের পরিমাণ অনেক কম। নিরাপত্তার দিক থেকেও চ্যালেঞ্জ তৈরি হচ্ছে—যদি রোবট প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সাইবার নিরাপত্তা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়, তবে এই প্রযুক্তির ওপর মানুষের আস্থা নষ্ট হতে পারে।
অন্যদিকে, দক্ষিণ কোরিয়ায় দীর্ঘ কর্মঘণ্টার চাপে একটি রোবট আত্মহত্যা করে—এই ঘটনা রোবটের মানব পরিবেশে মানিয়ে নেওয়ার সীমাবদ্ধতা স্পষ্ট করে তোলে। এতে বোঝা যায়, রোবটকে আরও উন্নত করতে হবে আবেগ চিনতে ও সামাজিক পরিবেশ বুঝতে।
আজ চীন বৈশ্বিক রোবট শিল্পের অর্ধেকেরও বেশি দখল করে নিয়েছে। তারা রোবট ব্যবহার করছে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও বিনোদনসহ বিভিন্ন খাতে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে—রোবট যদি মানুষের চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান ও দক্ষ হয়ে ওঠে, তবে মানুষ আদৌ কতটা নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারবে? "সিটি গ্রুপ" পূর্বাভাস দিয়েছে যে ২০৩৫ সালের মধ্যে বিশ্বে ১৩০ কোটি বুদ্ধিমান রোবট এবং ২০৫০ সালের মধ্যে ৪০০ কোটি রোবট উৎপাদিত হবে।
যদিও রোবটের সম্ভাব্য উপকারিতা রয়েছে—দক্ষতা বৃদ্ধি, ব্যয় হ্রাস ইত্যাদি, তবু এর উচ্চমূল্য সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে রাখে এবং ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো এই প্রযুক্তির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে হিমশিম খাচ্ছে।
সত্যি বলতে, রোবট এখন বাস্তবতা। ভবিষ্যতে এর ওপর নির্ভরতা আরও বাড়বে। আমাদের উচিত এখন থেকেই পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া—একটি কার্যকর কৌশলের মাধ্যমে যাতে এই প্রযুক্তি ন্যায়সঙ্গত ও দায়িত্বশীলভাবে ব্যবহৃত হয়। এজন্য জরুরি একটি সুশৃঙ্খল আইনগত কাঠামো, যা রোবট ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করবে এবং ব্যক্তিগত অধিকার সুরক্ষিত রাখবে।
সবশেষে, উন্নত প্রযুক্তির সুবিধা নেওয়ার পাশাপাশি এর সম্ভাব্য ঝুঁকি মোকাবেলার জন্য আমাদের প্রস্তুত হতে হবে—বিশেষ করে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও নৈতিক দিক থেকে।
অনুবাদ: মুহাম্মাদ শোয়াইব
এমএম/