ইয়াকুব আলী
যতদিন কওমিতে পড়েছি ততোদিন কমবেশি শিক্ষকের জুতা বহন করা, তাদের ওযুর পানি এনে দেয়া খুব কমন বিষয় ছিলো। শিক্ষক জুতা হাতে ফ্লোরে হেঁটে যাচ্ছেন আর আমরা তাঁর কাছাকাছি থেকেও জুতা নিজের হাতে তুলে নেইনি এমন হতো না। ছাত্রের উপস্থিতিতে শিক্ষক নিজের জুতা বহন করবেন আর ছাত্র খালি হাতে হেঁটে চলে যাবে এটা ছাত্রের জন্য বেমানান, অপমানজনক।
একটা কথা আছে, 'জ্ঞান অর্জন করতে হয় শিক্ষকের পায়ের কাছে বসে।' ছাত্র বসে আর শিক্ষক দাঁড়িয়ে বই-পুস্তক পাঠ হলেও আদব-কায়দা শেখানো যায় না। মাদ্রাসায় ক্লাসে শিক্ষক ছোট্ট তোষকের উপর কিছুটা আরাম করে বসতেন আর তাঁর তিনদিক ঘিরে ছাত্ররা বসে পড়তো। গরমে ফ্যান না থাকলে পর্যায়ক্রমে ছাত্ররা শিক্ষককে হাতপাখা দিয়ে বাতাস করতো।
এক.
একবছর আমি একজন শিক্ষকের খেদমত করেছিলাম। তাঁর কাপড় ধুয়ে পরিষ্কার করা, জুতা-সাইকেল মুছে দেয়া, বোর্ডিং থেকে খাবার তুলে এনে দস্তরখানে পরিবেশন, খাবারের পর সেগুলো আবার ধুয়ে পরিষ্কার করা, ওযুর পানি-মেসওয়াক রেডি রাখা, দোকান থেকে চা এনে দেয়া, গরমের দিনে প্রয়োজনে হাতপাখা দিয়ে বাতাস করা ইত্যাদি কাজগুলো ছিলো আমার দৈনন্দিন রুটিনের অন্তর্ভুক্ত।
আমি ও আমার শিক্ষক একসাথে বসে খেতাম। আমার খাবারের চেয়ে তাঁর খাবারের মান কিছুটা উন্নত ছিলো। তিনি ভালো খাবারের প্রায় অর্ধেকটা আমাকে দিয়ে খেতেন। আমি বাড়ি থেকে বিভিন্ন সময় ফল নিয়ে আসতাম বা আমার ভাই দিয়ে যেতেন সেগুলো উসতাদকে হাদিয়া দিতাম।
দুই.
সেই বছর আমার বোর্ডপরীক্ষা ছিলো। পরীক্ষার আগে পড়াশোনায় বেশ মনোযোগী হলাম। হারিকেন জ্বালিয়ে রাত জেগে পড়তাম। পাশের রুমের ছাত্ররা শিক্ষকের কাছে তাদের ঘুমে ডিস্টার্বের অভিযোগ দিলে তিনি আমাকে বললেন, তুমি আমার রুমের সামনে বারান্দায় পড়ো। ঘুমে ডিস্টার্ব হলে আমার হোক- কোনো সমস্যা নেই। তিনি আমার জন্য দুআ করতেন।
পরীক্ষায় আমি বোর্ডস্ট্যান্ড করি। মেধা তালিকায় ১৪তম। সম্ভবত আমার গড় মার্ক ছিলো ৯৩.৮৮। পুরো মাদ্রাসার সকল বিভাগের সকল ছাত্রের ভেতর সর্বোচ্চ নম্বরধারী হবার তাওফিক আল্লাহ তাআলা আমাকে দিয়েছিলেন।
তিনি বাংলার শিক্ষক ছিলেন। আমলী মানুষ। এটা বলা মোটেও অত্যুক্তি হবে না যে, একজন জেনারেল শিক্ষক ছাত্রদের এতটা সম্মান ও সেবা পেয়েছেন তা কেবল কওমি মাদ্রাসার সাথে সম্পৃক্ততার কারণে।
তিন.
শিক্ষকের কাছে মাথা নিচু করাতে কারো যদি ইগোতে লাগে তবে সে আর যাই হোক ছাত্র হবার অযোগ্য। কোনো বাবা-মা যদি সন্তানকে শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনে কার্পণ্য করতে শেখান কিংবা সন্তানের কাছে শিক্ষকের স্ট্যাটাসের তুলনায় নিজেদের স্ট্যাটাস উপরে থাকার বিষয়টি প্রমাণের চেষ্টা করেন, তবে তারা আদর্শ বাবা-মা হতে ব্যর্থ এবং এর পরিণতিও খুব ভালো হয় না।
আমাদের জানা থাকার কথা, বাদশাহ আলমগীরের ছেলে ও তার শিক্ষকের গল্প। আমাদের কারো স্ট্যাটাস বাদশাহ আলমগীরের থেকে উপরে নয়। তবে হ্যাঁ, শিক্ষক শিক্ষকের মতো হতে হয়। শিক্ষকতার পেশায় থাকলেই শিক্ষক হওয়া যায় না। পরিমলরা শিক্ষকতার পেশায় আসতে পারে, শিক্ষক হতে পারে না।
চার.
কওমি মাদরাসার একটা ঐতিহ্য হলো, অনেকসময় দিনে-রাতে ছাত্ররা পড়া বোঝার জন্য হুজুরের কাছে যান। অনেক হুজুর অত্যন্ত যত্নের সাথে বুঝিয়ে দেন, বিরক্ত হন না। এজন্য অতিরিক্ত কোনো মাইনেও নেন না তারা।
এই যে আপনারা দেখেন, বাংলাদেশে অনেক আলেমের জানাজায় লক্ষ লক্ষ লোক হয় কিন্তু আপনারা এর কোনো কারণ খুঁজে পান না। কারণ, আপনারা বুঝতেই পারেন না, শিক্ষক-ছাত্রের সম্পর্কের গুরুত্ব কতটুকু। আপনাদের দৃষ্টি আটকে থাকে দুনিয়াবি স্বার্থের জন্য শিক্ষকের পেছনে দৌঁড়ানোতে। স্বার্থ না থাকলে বা ফুরিয়ে গেলে সম্পর্ক ফিকে হয়ে যায়। অথচ শিক্ষক-ছাত্রের সম্পর্ক দুনিয়াবী স্বার্থের বহু ঊর্ধ্বে। সেই সম্পর্কের ভিত্তিতেই সামান্য বেতন পাওয়া ছাত্ররাও মৃত্যুর খবরে ছুটে আসে, শিক্ষকের জন্য আল্লাহর কাছে মাগফিরাত কামনা করে রোনাজারি করে।
শিক্ষার ক্ষেত্রে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেই সম্পর্কটা ছাত্রকে শিক্ষকের প্রতি এই ভীতিটুকু জন্মাবে যে, শিক্ষকের অপছন্দের কোনো কাজ আমি করতে পারি না। তাতে আমার শিক্ষক মনঃকষ্ট পাবেন। শিক্ষকের প্রতি ছাত্রের অজস্র সম্মান থাকবে, ছাত্রের প্রতি শিক্ষকের মায়া থাকবে। ছাত্রের কাছে শিক্ষকের ইশারা হবে আদেশতুল্য।
লেখক: প্রভাষক, ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজ
এমএইচ/