বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে সাম্প্রতিক সময়ে এক বিতর্কিত সিদ্ধান্ত আলোচনার জন্ম দিয়েছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গানের শিক্ষক নিয়োগের সরকারি প্রজ্ঞাপন অনেকের কাছে সংস্কৃতি ও শিক্ষার নামে এক ধরনের কৌশলগত ষড়যন্ত্র হিসেবে প্রতীয়মান হয়েছে। ধর্মীয় মহল ও রাজনৈতিক অঙ্গনের নেতৃবৃন্দের অভিযোগ, এ উদ্যোগের মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের ধর্মীয় মূল্যবোধ, সংস্কৃতি ও আত্মপরিচয়কে ধীরে ধীরে ক্ষুণ্ণ করার প্রচেষ্টা চলছে। বিশেষত বিদেশি এনজিওপন্থী মহল দীর্ঘদিন ধরে যে ইসলামবিরোধী ধারা শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রবেশ করানোর চেষ্টা করে আসছে, এ সিদ্ধান্তকে তারই অংশ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
সমালোচকদের মতে, গান শেখানোর পরিবর্তে শিশুদের নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য প্রতিটি বিদ্যালয়ে ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগই এখন সময়ের দাবি। কারণ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মানসিক, আধ্যাত্মিক ও চারিত্রিক উন্নতির জন্য ধর্মীয় শিক্ষাই সবচেয়ে জরুরি ভিত্তি হতে পারে। তাই এই নিয়োগ প্রজ্ঞাপন দ্রুত বাতিলের আহ্বান উঠেছে সর্বমহল থেকে।
এ বিষয়ে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ সভাপতি মাওলানা মুহাম্মদ ইমতিয়াজ আলম বলেন, ৯২ ভাগ মুসলমানের দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে সংগীতবিষয়ক শিক্ষক নিয়োগকে জনআকাঙ্ক্ষা পরিপন্থি। অথচ বছরের পর বছর ধরে প্রাইমারি স্কুলগুলোতে একজন আরবী/নূরানি শিক্ষক নিয়োগের জন্য দেশের উলামায়ে কেরাম দাবি করে আসছেন।
তিনি আরও বলেন, এ বিষয়টি চরম উদ্বেগজনক। সরকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ইসলাম ধর্ম শিক্ষক নিয়োগে এদেশের অভিভাবকদের দীর্ঘদিনের দাবিকে উপেক্ষা করে, অযাচিতভাবে সঙ্গীত শিক্ষক নিয়োগের ঘোষণা প্রদান করেছে। আমরা এই অবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি।
জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের সভাপতি শাইখুল হাদিস মাওলানা উবায়দুল্লাহ ফারুক ও মহাসচিব মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী বলেছেন, শিক্ষা একটি আদর্শিক ও মূল্যবোধসম্পন্ন খাত। এখানে ইসলাম ও বাঙালির আত্মপরিচয়ের বিপরীতমুখী উপকরণ সংযোজন সংবিধান, দেশের সংস্কৃতি ও সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের অনুভূতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
নেতৃদ্বয় আরও বলেন, “ইসলামি সংস্কৃতিবিরোধী এই সিদ্ধান্ত ইসলামপ্রিয় জনতা কোনোভাবেই মেনে নেবে না। দেশের লক্ষ লক্ষ প্রাথমিক শিক্ষার্থীকে নৈতিকতা, ইসলামি মূল্যবোধ ও চরিত্র গঠনের শিক্ষার পরিবর্তে গান-বাজনার মাধ্যমে মন ও মানসিকতা ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।”
প্রখ্যাত ইসলামি স্কলার শায়খ আহমাদুল্লাহ সরকারের প্রতি প্রশ্ন রেখেছেন, কাদের খুশি করার জন্য গানের শিক্ষক নিয়োগে প্রজ্ঞাপন জারি করা হলো।
তিনি আরও বলেন, ‘প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বিশেষায়িত ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হোক, এটা বহুকাল ধরে গণমানুষের প্রাণের দাবি ছিল। সেই দাবি আজও বাস্তবায়িত হয়নি। অধিকাংশ অভিভাবক চায়, বিদ্যালয়ে যেন তাদের সন্তানকে গান শেখানো না হয়। এদেশের প্রায় সকল অভিভাবক সন্তানের জন্য প্রাইভেট ধর্মীয় শিক্ষক রাখেন কিংবা সন্তানকে মক্তবে পাঠান। সরকার যদি স্কুলে বিশেষায়িত ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগ দিত, তাহলে অভিভাবকদের এই বাড়তি খরচ ও ঝামেলা পোহাতে হতো না। শিক্ষার্থীদেরও সময় বেঁচে যেত।
জনপ্রিয় ইসলামিক স্কলার ড. মিজানুর রহমান আজহারী বলেন, ‘মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এই দেশে প্রাথমিক স্তরে ইসলাম শিক্ষার জন্য বিশেষায়িত ধর্মীয় শিক্ষক নেই। এটি অত্যন্ত দুঃখজনক। অথচ সংগীতের মতো বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে ডেডিকেটেড শিক্ষক নিয়োগ স্পষ্টতই জন আকাঙ্ক্ষা পরিপন্থী। আমরা আমাদের সন্তানদের বিশ্বাস ও মূল্যবোধের নিরাপত্তা চাই।’
মূল্যবোধ আন্দোলনের সমন্বয়ক মুহসিনুদ্দীন মাহমূদ বলেন, আমরা মনে করি, মৌলিক শিক্ষায় যখন ভয়াবহ ঘাটতি, তখন সংগীতের শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া শিক্ষানীতির সাথে সাংঘর্ষিক এবং অগ্রাধিকারভিত্তিক জাতীয় স্বার্থবিরোধী।
ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশের (আইইউবি) সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সরোয়ার হোসেন বলেন, 'বাংলাদেশের ৯২% মুসলিম জনগোষ্ঠী থাকা সত্ত্বেও প্রাথমিক স্তরে ইসলাম শিক্ষার জন্য নির্দিষ্ট শিক্ষক নেই। অথচ সংগীতের মতো বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে শিক্ষক নিয়োগ স্পষ্টতই জাতীয় চাহিদা ও সাংস্কৃতিক বাস্তবতার সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। এটি শিক্ষাক্ষেত্রে নতুন দ্বন্দ্ব ও বিভাজন তৈরি করবে।
এমএইচ/