বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে ঘিরে জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের সময় রাজধানীর সাইন্সল্যাবের মামার বাসা থেকে সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহকে ও সারজিস আলমকে তুলে নিয়েছিল ডিরেক্টরেট জেনারেল অফ ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স (ডিজিএফআই)।
মঙ্গলবার (৯ ডিসেম্বর) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ দেওয়া জবানবন্দিতে এসব কথা জানান জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ।
জুলাই আন্দোলনে প্রথম মৃত্যুবরণ করা রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ হত্যার ঘটনায় করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার ২২তম সাক্ষী হিসেবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ সাক্ষ্য দিয়েছেন তিনি। জবানবন্দি শেষে তাকে জেরা করেছেন আসামিপক্ষের আইনজীবীরা। পরে এ মামলার পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য আজকের দিন ধার্য করেছেন ট্রাইব্যুনাল। প্রসিকিউশনের পক্ষে প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম, গাজী এম এইচ তামিম, মঈনুল করিম, ফারুক আহাম্মদ, আবদুস সাত্তার পালোয়ান, বিএম সুলতান মাহমুদসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন।
জবানবন্দিতে হাসনাত বলেন, ‘সেদিন সরকারের তিন মন্ত্রীর সঙ্গে মিটিং করে আন্দোলন প্রত্যাহারে চাপ দেয় ডিজিএফআই। মিটিং না করায় ডিজিএফআই আমাদের উপর ক্ষুব্ধ হয়। আমাদের বাসায় ফেরত না দিয়ে সেদিন রাতে মৎস্য ভবন ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের মাঝে একটি গোপন স্থানে নিয়ে আটকে রাখে। ওই জায়গাটি সেইফ হাউজ নামে পরিচিত।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের যে বাড়িতে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছিল তা বাহির থেকে একটি পরিত্যক্ত বাড়ি মনে হলেও তার ভেতরটা ছিল আধুনিক সরঞ্জাম সজ্জিত।’
তিনি আরও বলেন, ‘গত বছরের ১৭ জুলাই রাজধানীর সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় আমি আমার মামার বাসায় যাই। হল বন্ধ করায় সমন্বয়ক সারজিস আলমও আমার মামার বাসায় যায়। সেদিন রাতে মামার বাসা থেকে আমাকে ও সারজিসকে উঠিয়ে নিয়ে যায় ডিজিএফআই। আমার যেতে অস্বীকৃতি জানালে পরিবারসহ আমাদের ক্ষতি করার হুমকি দেওয়া হয়।’
এনসিপির এই নেতা বলেন, ‘১৭ জুলাই রাতে আমাদের রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় নেওয়া হয়। সেখানে নেওয়ার ৩০ মিনিটের মধ্যে তৎকালীন তিন মন্ত্রী আনিসুল হক, মোহাম্মদ এ আরাফাত ও মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল পদ্মায় আসেন। ডিজিএফআইয়ের সদস্যরা তিন মন্ত্রীর সঙ্গে আমাদের সভা করতে চাপ দেন। এক ঘণ্টার বেশি সময় নানাবিধ প্রলোভন, ভীতি ও চাপ দিয়ে শুধু সভা করতে বলেন। নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদের সঙ্গে কথা না বলে আমরা কোনও ধরনের বৈঠক করতে অস্বীকৃতি জানাই। ডিজিএফআই পীড়াপীড়ি করে আমাদের বৈঠকে বসাতে ব্যর্থ হয়। পরে তিন মন্ত্রী রাষ্ট্রীয় ভবন পদ্মা থেকে বের হয়ে যান।’
জবানবন্দিতে হাসনাত আবদুল্লাহ আরও বলেন, ‘সেদিন মিটিং না করায় ডিজিএফআই আমাদের উপর ক্ষুব্ধ হয়। ডিজিএফআই আমাদের বাসায় ফেরত না দিয়ে সেদিন রাতে মৎস্য ভবন ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের মাঝে একটি গোপন স্থানে নিয়ে আটকে রাখে, যা সেইফ হাউজ নামে পরিচিত। সেখানে আমাদের ডিজিএফআইসহ বিভিন্ন সংস্থার লোকজন জিজ্ঞাসাবাদ করে।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের যেখানে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় তার ঠিক পেছনে একটি টেলিভিশন সেট করা ছিল। আমাদের যিনি জিজ্ঞাসাবাদ করছিলেন তিনি আমাদের জিজ্ঞাসাবাদের সঙ্গে সঙ্গে টিভি দেখছিলেন কিন্তু আমরা আমাদের পেছনে থাকা টিভি দেখতে পারছিলাম না। তিনি সেখান থেকে ফোন করে বিভিন্ন টিভি চ্যানেল, বিশেষ করে ডিবিসি, সময় টিভি ও একাত্তর টিভিতে ফোন করে নিউজ পরিবর্তন এবং সংশোধনের নির্দেশ দিচ্ছিলেন। সে অনুযায়ী টিভি চ্যানেলগুলো সংবাদ প্রচার করছিল এবং পরিস্থিতি স্বাভাবিক মর্মে দেখানোর চেষ্টা করছিল।’
জবানবন্দিতে হাসনাত আরও বলেন, ‘১৭ জুলাই রাত প্রায় আড়াইটা পর্যন্ত আমাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। ফজরের সময় আমাদের আবার ডেকে তোলা হয় এবং পুনরায় জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয়। জিজ্ঞাসাবাদের সময় ডিজিএফআইয়ের একজন সেনা কর্মকর্তা আমাকে বলেন, ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর ১০ মিনিটে বিএনপি এর লাখ জনতার আন্দোলন নস্যাৎ করে দিয়েছিলেন এবং আমাদের আন্দোলন একইভাবে নস্যাৎ করতে তার সময় লাগবে না। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সেটআপ আমাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তারা আমাদের চাপ দিচ্ছিলো আন্দোলন প্রত্যাহার করে সরকারের সঙ্গে আলোচনা বসতে এবং সেটি সংবাদ সম্মেলন করে জাতির কাছে জানাতে।’
জবানবন্দিতে হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ‘ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় আমরা অন্য সমন্বয়কদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছিলাম না। ডিজিএফআইয়ের সদস্যরা আমাদের মুঠোফোন ব্যবহার করে সমন্বয়কদের সঙ্গে যোগাযোগ করে অন্য সমন্বয়কদের অবস্থা নির্ণয়ের চেষ্টা করেন। একপর্যায়ে আমার ফোন দিয়ে সমন্বয়ক হাসিবের সঙ্গে যোগাযোগ করতে সক্ষম হই। আমি তাকে তার অবস্থান জানতে চাইলে সে জানায় চানখারপুল এলাকায় আন্দোলনে আছে। ডিজিএফআই তাকে কিছুক্ষণের মধ্যে চানখারপুল থেকে তুলে এনে আমাদের সঙ্গে আটক রাখে। সেখানে আমাদের নানাভাবে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করা হয়। সমন্বয়ক হাসিব মাদ্রাসার ছাত্র হওয়ায় এবং খুব সম্ভবত তার বোনও মাদ্রাসার ছাত্রী হওয়ায় তাকে শিবির ট্যাগ দিয়ে নির্মমভাবে নির্যাতন করা হয়। আমার ফোন দিয়ে হাসিব এর অবস্থান নির্ণয় করতে পারায় আমি নিজে বিব্রত হই এবং আমার মধ্যে অপরাধবোধ কাজ করে।’
জবানবন্দিতে হাসনাত আরও বলেন, ‘১৮ জুলাই সারাদিন আমাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। ওই দিন সন্ধ্যায় ডিজিএফআইয়ের ডিজিসহ বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা ওই সেইফ হাউজে উপস্থিত হয়ে শেষবারের মতো আমাদের মিটিং করে আন্দোলন প্রত্যাহার করতে চাপ প্রয়োগ করেন। বিভিন্ন সংস্থা যেমন, এসবি, এনএসআই, ডিজিএফআই, ডিবিসহ সব গোয়েন্দা সংস্থার মধ্যে আন্দোলন দমনের ক্রেডিট নেওয়ার প্রতিযোগিতা দেখতে পাই।’
তিনি বলেন, ‘আমরা যেহেতু বাইরের কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছিলাম না সেহেতু আমি, সারজিস ও হাসিব সিদ্ধান্ত নেই আমাদের প্রেস কনফারেন্স করে আমাদের দাবি দাওয়া জানাতে দিলে আমরা পদ্মায় যাবো। সে শর্তে আমরা পদ্মায় যেতে রাজি হই এবং প্রেস কনফারেন্স করে আমাদের দাবি দাওয়া লিখিতভাবে প্রকাশ করি। আমরা প্রেস কনফারেন্সে বারবার বলি যে, আমরা সরকারের সঙ্গে কোন মিটিং এ আসি নাই এবং শহীদদের রক্ত মাড়িয়ে আমরা কোন সংলাপ করতে পারি না। আমাদের পূর্ব ঘোষিত শাটডাউন কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। দুঃখজনকভাবে মিডিয়া আমাদের বক্তব্যের খণ্ডিত অংশ প্রচার করে। ১৯ জুলাই দুপুরে আমাদের ছেড়ে দেওয়া হয়।’
আবু সাঈদসহ জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে নিহত ও আহত করার ঘটনায় দায়ীদের বিচার চান হাসনাত আবদুল্লাহ।
আরএইচ/