বুধবার, ২৯ অক্টোবর ২০২৫ ।। ১৩ কার্তিক ১৪৩২ ।। ৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৭

শিরোনাম :
আফগান শান্তি আলোচনা ভেঙে যাওয়ার কারণ ভারত: পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী অবৈধ মোবাইলের ব্যবহার বন্ধ করতে চালু হচ্ছে এনইআইআর সিস্টেম ইরানের নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি বিমানের সফল উড্ডয়ন বাংলাদেশে সৌদি সরকারের পাঠানো কোরবানির মাংস বিতরণ শুরু ‘জুলাই সনদ পাস না হলে শহীদদের আত্মত্যাগ ব্যর্থ হবে’ এআইতে মানুষের অংশীদারত্বই হবে সবার মূল শক্তি: লিংকডইন সিইও জামিয়া দারুল আরকাম আল-ইসলামিয়া ইসলামিয়া ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ফুজালা ও আবনা সম্মেলন কাল প্রান্তিক মানুষদের পাশে বিত্তশালীদের দাঁড়ানোর আহ্বান ধর্ম উপদেষ্টার নির্বাচন বানচালের চেষ্টা হবে, সতর্ক থাকুন: প্রধান উপদেষ্টা মাদরাসা শিক্ষকদের ওপর পুলিশের লাঠিচার্জ-জলকামান, আহত ১৫

আজ আল্লামা নিয়াজ মাখদূম খোতানী আত-তুর্কিস্তানী (রহ.) এর ওফাত

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুহাম্মদ আম্মার হোসাইন

ইসলামি জ্ঞানের বিশাল পরিমণ্ডলে এমন কিছু ব্যক্তিত্ব আছেন, যাঁদের জীবন স্বয়ং এক দীপ্ত আলোকবর্তিকা, যাঁরা জ্ঞানের মাধ্যমে অন্ধকারকে আলোকিত করেছেন, ইলমের অরণ্যে পথ দেখিয়েছেন এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে। আল্লামা নিয়াজ মাখদূম খোতানী (রহ.) তাঁদেরই অন্যতম এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাঁর জীবনের প্রতিটি অধ্যায় যেন একখানি কিতাব— যেখানে লেখা রয়েছে ত্যাগ, প্রজ্ঞা, সংগ্রাম ও আলোকিত মানবতার কাব্য।

আল্লামা নিয়াজ মাখদূম খোতানী (রহ.) জন্মগ্রহণ করেন চীনের সিংকিয়াং প্রদেশের ঐতিহাসিক চীন-রাশিয়া সীমান্তবর্তী খোতান অঞ্চলে এক ধার্মিক ও বিদ্যোৎসাহী পরিবারে। তাঁর পিতা ছিলেন শায়খ মুহাম্মদ সিদ্দিক, যিনি ছিলেন এক আলেম ও সুফি মনা ব্যক্তিত্ব। শৈশবে আল্লামা নিয়াজের জীবনে নেমে আসে গভীর বেদনা, মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই পিতা ইন্তেকাল করেন, আর এক বছরের মধ্যেই মাতাও আল্লাহর ডাকে সাড়া দেন। এই নিঃসঙ্গতার মাঝেই তাঁর হৃদয়ে জ্বলে ওঠে জ্ঞানের পিপাসা, ইলমের জন্য অদম্য আকাঙ্ক্ষা।

শৈশবকালেই তিনি স্থানীয় মাদ্রাসায় প্রাথমিক কুরআন ও আরবি শিক্ষায় পারদর্শিতা অর্জন করেন। তার চাচা তাকে কাশগরে পাঠান। তাঁর বুদ্ধিমত্তা ও প্রখর স্মৃতিশক্তি দেখে শিক্ষকেরা তাঁকে “সুবহানুল মেধাবী” বলে অভিহিত করতেন।

কৈশোরেই আল্লামা নিয়াজের হৃদয়ে প্রজ্বলিত হয় জ্ঞানের দীপ্ত শিখা। উচ্চতর ইসলামি জ্ঞানার্জনের লক্ষ্যে তিনি দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ভারতে আসেন এবং ভর্তি হন উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ ইসলামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দারুল উলূম দেওবন্দে। সেখানে তিনি হাদীস, তাফসীর, ফিকহ, উসূল, যুক্তি, দর্শন ও আরবি সাহিত্যে নিজেকে পরিপূর্ণরূপে বিকশিত করেন। মুমতাজ ডিগ্রি পেয়ে সব সময় উত্তীর্ণ হতেন। তিনি ছিলেন শাইখুল ইসলাম হুসাইন আহমদ মাদানী রহ. এর শাগরেদ।

দেওবন্দের বিদগ্ধ মাশায়েখদের নিকটে তিনি কিতাবুল হিদায়া, সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম, তিরমিজি প্রভৃতি গ্রন্থ অধ্যয়ন করেন। তিনি ছিলেন মেধা ও বিনয়ের অনন্য সংমিশ্রণ। শিক্ষা সমাপনান্তে আলেমসমাজ তাঁকে “আলিমে রাব্বানী” উপাধিতে ভূষিত করেন। তার লিখিত কিতাব “শরহুন খোতানী আলা সুনান আত-তিরমিজি।”

বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে চীনের মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে কমিউনিস্ট নিপীড়ন যখন চরমে, তখন আল্লামা নিয়াজ (রহ.) স্বদেশত্যাগে বাধ্য হন। তিনি দারিদ্র্য ও বিপদের পরোয়া না করে ইলমের আলো ছড়িয়ে দিতে হিজরত করে আসেন উপমহাদেশে, বর্তমান বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে।

পীর নেছারুদ্দীন আহমদ রহ. এর অনুরোধে, হোসাইন আহমাদ মাদানী রহ. এর পরামর্শে ১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বরিশালের খ্যাতনামা ছারছীনা দারুস সুন্নাহ কামিল মাদ্রাসায় যোগ দেন। সেখানে তিনি প্রায় চার দশকব্যাপী শিক্ষকতা করেন। তাঁর কণ্ঠে হাদীসের পাঠ, তাফসীরের বিশ্লেষণ, ফিকহের ব্যাখ্যা যেন ইলমের মৃদুমন্দ স্রোতধারা হয়ে প্রবাহিত হতো। তাঁর তত্ত্বাবধানে বহু আলেম, মুহাদ্দিস ও খতিব সমাজে দীক্ষা গ্রহণ করেন।

আল্লামা নিয়াজ মাখদূম খোতানী (রহ.) ছিলেন একাধারে শিক্ষক, সুফি, চিন্তাবিদ ও সমাজসংস্কারক। তাঁর জীবনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল বিনয় ও আধ্যাত্মিক গভীরতা। তিনি কখনো ইলমকে পেশা হিসেবে দেখেননি, বরং একে দেখেছেন দায়িত্ব ও আমানত হিসেবে। তাঁর কণ্ঠস্বর ছিল মৃদু, বাক্য ছিল পরিমিত; তবুও তাঁর প্রতিটি বাণী ছাত্রদের হৃদয়ে স্থায়ী ছাপ রেখে যেত।

তাঁর দৃষ্টিতে জ্ঞান ছিল না কেবল মুখস্থের বিষয়; বরং ছিল আল্লাহভীতি, নৈতিকতা ও মানবসেবার এক জীবন্ত প্রকাশ। তিনি সর্বদা বলতেন, “যে ইলম মানুষের হৃদয় পরিবর্তন করে না, সে ইলমে বরকত নেই।

বাংলাদেশের ইসলামি শিক্ষাব্যবস্থার গঠনে আল্লামা নিয়াজের অবদান অপরিসীম। তিনি ছারছীনা মাদ্রাসায় পাঠ্যক্রম উন্নয়ন, শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও ছাত্রশিক্ষায় নতুন ধারা প্রবর্তন করেন। তাঁর প্রচেষ্টায় মাদ্রাসাটি একসময় উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিক্ষাপীঠে পরিণত হয়।

তাঁর ছাত্রদের মধ্যে বহু বিশিষ্ট আলেম, খতিব, মুফতি ও ইসলামি গবেষক পরবর্তীতে দেশের বিভিন্ন স্থানে ইসলামের প্রচারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তাঁর শিক্ষা ছিল দুনিয়া ও আখিরাতের ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন। আল্লামা নিয়াজ মাখদূম খোতানী (রহ.) ছিলেন এক গভীর চিন্তাশীল ও আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব। তাঁর রাত্রিগুলো কেটেছে তাহাজ্জুদের নীরব অশ্রুতে। আজ ২৯ অক্টোবর তিনি পরম করুণাময়ের ডাকে সাড়া দিয়েছেন। তাঁকে ঢাকায় দাফন করা হয়। আল্লাহ তায়ালা এই মহান মনীষীকে জান্নাতুল ফেরদৌসের উচ্চতম মাকাম দান করুন — আমিন।

লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামী আইন বিভাগ, আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়।

আরএইচ/


সম্পর্কিত খবর

সর্বশেষ সংবাদ