পাবনার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহত শহীদ জাহিদুল ইসলামের পরিবার আজও নিরাপত্তাহীনতায় দিন কাটাচ্ছে। খুনিরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ালেও পুলিশ প্রশাসনের নীরবতা ও উদাসীনতায় ক্ষোভ ঝাড়লেন শহীদ জাহিদের বাবা দুলাল উদ্দিন মাস্টার।
৩ আগস্ট (মঙ্গলবার) পাবনার সদর উপজেলার চর বলরামপুরে নিজ বাড়িতে কথা বলছিলেন তিনি। তার চোখেমুখে হতাশা আর ক্ষোভ—“খুনিদের ভয়ে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতেও যেতে পারি না। রাতেও ঘুমাতে পারি না। বাড়ি থেকে বের হয়ে ফিরতে পারব কি না, সেটাও অনিশ্চিত।”
দুলাল উদ্দিন বলেন, “সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্যে ঘুরছে, অথচ পুলিশ কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। প্রধান খুনি স্কুলের শিক্ষক হয়েও ক্লাস নিচ্ছে। প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করেও লাভ হয়নি। পুলিশ আসামিদের কাছ থেকে নিয়মিত টাকা খায়। আমাদের খোঁজখবর তো নেয়ই না, ফোন দিলে শুধু বলে ‘দেখতেছি’, এরপর কোনো সাড়া মেলে না।”
তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, “এক বছরও পার হয়নি, অথচ চারপাশ থেকে টিটকারি শুনি। মনে হয়, আমরাই যেন এখন অপরাধী হয়ে যাচ্ছি। রাজনৈতিক নেতারা মামলা করিয়ে এখন আমাদের খবরও নিচ্ছে না। আমাদের মতো নিরীহ পরিবারে এমন জুলুম আর কত হবে?”
তিনি আরও বলেন, “একজন শহীদের মেয়েকে ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়েছে। এর চেয়ে জঘন্য ঘটনা আর কী হতে পারে? রাষ্ট্র যেন আমাদের বোঝা মনে করছে। খুনিরা দেশেই আছে, প্রকাশ্যে ঘোরাফেরা করছে, হুমকি দিচ্ছে। কিন্তু পুলিশ কিছুই করছে না। মামলা চলছে নামমাত্র। পুলিশ যেন শুধু বালু আর মাটি কাটার পেছনেই ব্যস্ত।”
শহীদদের স্মরণে জামায়াতে ইসলামীর প্রকাশিত বই ও অনলাইন উদ্যোগের প্রশংসা করে দুলাল উদ্দিন বলেন, “প্রত্যেক শহীদের জীবনী নিয়ে বই বের করেছে তারা, অনলাইনেও সংরক্ষণ করেছে। এই কাজ তো রাষ্ট্রের করার কথা ছিল। তাই আমরা তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ।”
জাহিদের মা আপিয়া খাতুন বলেন, “তিন ছেলের একজন চলে গেছে। বাকি দুইজনকে নিয়েও এখন আতঙ্কে থাকি। অনেক হুমকি আসে। কিছু আসামি ধরা পড়লেও টাকার বিনিময়ে ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে। প্রশাসন আমাদের পাশে নেই।”
জাহিদের ছোট ভাই তৌহিদুল ইসলাম বলেন, “ভাই শহরের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতেন। হোয়াটসঅ্যাপে গ্রুপ চালাতেন, কর্মসূচি দিতেন। বলতেন, আন্দোলনে সামনে থাকতে হয়, পেছনে থাকলে শহীদ হওয়া যায় না। আজ খুনিরা ধরাই পড়ছে না, আমরা শঙ্কায় রাস্তায় চলাচল করি।”
দুলাল উদ্দিন চর বলরামপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। বড় ছেলে তৌহিদুল এডওয়ার্ড কলেজে, ছোট ছেলে নাহিদ এসএসসি দিয়েছে এবং মেয়ে দিলারা পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ করে হেলথ সেক্টরে চাকরি করছেন।
পরিবার জানায়, জাহিদের স্মরণে পাঠাগার নির্মাণ করা হচ্ছে, যা কয়েকদিনের মধ্যে উদ্বোধন হবে। “জুলাই ফাউন্ডেশন” ৫ লাখ টাকা অনুদান দিয়েছে। ডিসি অফিস, বিএনপি, জামায়াত, শিবির, আইডিবি, শেকড় পাবনা ফাউন্ডেশনসহ অনেকে অর্থসহায়তা করেছে।
শহীদ জাহিদের মৃত্যুর ঘটনায় তার বাবা বাদী হয়ে ১০ আগস্ট পাবনা সদর থানায় মামলা করেন। এতে সাবেক এমপি গোলাম ফারুক প্রিন্সসহ আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১০৩ নেতাকর্মীর নাম উল্লেখ করা হয়েছে। বিস্ফোরক আইনে আরেকটি মামলায় ১২৩ জনকে আসামি করা হয়। হত্যা মামলায় ৩০ জন এবং বিস্ফোরক মামলায় ১১৩ জন এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার হয়েছে।
পাবনা সদর থানার ওসি (তদন্ত) এ এফ এম মনিরুজ্জামান মণ্ডল বলেন, “আমরা সব সময় শহীদ পরিবারগুলোর খোঁজ রাখছি। মামলা তদন্তাধীন। দ্রুত চার্জশিট দেওয়া হবে।”
এসএকে/