|| বিশেষ প্রতিনিধি ||
দেশের কওমি মাদরাসাগুলোতে কোরবানির পশুর চামড়া কালেকশনের ধারা চলে আসছে অনেক বছর ধরে। একটি বড় উপার্জন এই খাত থেকে আসায় মাদরাসাগুলো বেশ গুরুত্বের সঙ্গেই এই কালেকশন করে থাকে। এই কাজে তারা মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকদের নিয়োজিত করে। এতে এক দিকে মাদরাসার আর্থিক যেমন উপকার হয়, তেমনি জনসাধারণ বিশুদ্ধভাবে কোরবানি করার সুযোগ পায়।
তবে গত কয়েক বছর ধরে অনেকটা পরিকল্পিতভাবে কোরবানির চামড়ার বাজার ধসিয়ে দেওয়া হয়। মাদরাসাগুলো চামড়া কালেকশন করলেও ভালো দাম না পাওয়ায় আর্থিকভাবে ততটা লাভবান হওয়ার সুযোগ থাকে না। তবু চামড়া কালেকশনের ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছে বেশির ভাগ মাদরাসা। কেউ কেউ প্রচলিত এই ধারা থেকে বেরিয়েও আসছে। যারা আগে কালেকশন করতেন, এখন করছেন না, তারা বলছেন- এতো কষ্ট করে চামড়া কালেকশনের ওপর যে দর পাওয়া যায় তাতে খুব একটা লাভ থাকে না। মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকরা যে শ্রম দেন সে অনুযায়ী সুফল আসে না। এছাড়া মাদরাসার সংখ্যা ব্যাপক হারে বেড়ে যাওয়ায় চামড়া কালেকশনে একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতাও শুরু হয়। যা দেখতে খুবই দৃষ্টিকটু লাগে এবং এর কারণে জনসাধারণের সামনে আলেম-উলামা হেয় হন। এজন্য তারা আর চামড়া কালেকশন করতে চান না। এছাড়া তরুণ ও সচেতন আলেমদের একটি বড় অংশ এভাবে কালেকশন করার বিষয়টি পছন্দ করেন না।
রাজধানীর রামপুরার একটি মাদরাসা চামড়া কালেকশন বন্ধ করে দিয়েছেন। সেখানকার একজন দায়িত্বশীল বলছিলেন, আমরা পরামর্শ করেই কালেকশন বন্ধ করে দিয়েছি। আমরা দেখেছি, যে হারে এই এলাকায় মাদরাসা বেড়েছে তাতে কালেকশন করতে গেলে অনেকটা ধাক্কাধাক্কি করতে হবে। তাছাড়া এই কালেকশনের কারণে হয়ত কয়েক লাখ টাকা আসবে। কিন্তু বছরে যেখানে প্রায় কোটি টাকা খরচ হয় সেখানে এই কয়েক লাখ টাকা কালেকশন না করলেও চলে আসবে। চামড়ার দাম আশানুরূপ পাওয়া গেলে এবং টাকার অংকটা বড় হলে হয়ত আমরা কাজটি করতাম। তবে তিনি বলছেন, কেউ মাদরাসায় এসে চামড়া দিয়ে গেলে সেটা গ্রহণের ব্যবস্থা থাকবে। এজন্য কয়েকজন ছাত্র-শিক্ষক মাদরাসায় অবস্থান করবেন। তার ভাষ্য অনুযায়ী, সম্মানজনকভাবে দুই-চারটা চামড়া কালেকশন হলেও সেটাতে বরকত হবে ইনশাআল্লাহ।
শুধু ওই মাদরাসাটিই নয়, খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আশপাশের আরও কয়েকটি মাদরাসাও চামড়া কালেকশন থেকে ফিরে আসার কথা ভাবছে। এর মধ্যে একাধিক মাদরাসা আগামী দিনে চামড়া কালেকশন বন্ধের ব্যাপারে ভাবছে। এভাবে দেশের আরও বেশ কিছু মাদরাসা কর্তৃপক্ষের মধ্যে এ ধরনের ভাবনা রয়েছে বলেও খবর পাওয়া যাচ্ছে।
একটা সময় চামড়ার দর বেশি থাকায় কালেকশনের মাধ্যমে আর্থিকভাবে বেশ লাভবান হওয়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু গত ৫/৭ বছর ধরে চামড়ার দর নেই বললেই চলে। কোরবানি ঈদের সময় পশুর চামড়া অনেকটা ফেলনা বস্তুতে পরিণত হয়। অনেক কষ্ট করে মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকরা যে কালেকশন করেন অনেক সময় সেটা বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। বাধ্য হয়ে পানির দরে বিক্রি করে দিতে হয়। তাছাড়া এই কালেকশন করতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রে দীনকে হেয় করা হয় বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। ফলে আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন আলেম ও তালিবুল ইলমের মধ্যে দিন দিন কোরবানির কালেকশনের প্রতি অনীহা চলে আসছে।
এবার অন্তর্বর্তী সরকার চামড়ার ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার ব্যাপারে তোড়জোর শুরু করেছে। তবে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত খুব বেশি আশার বাণী নেই। সরকার নির্ধারিত দর অনুযায়ী চামড়া বিক্রি করতে পারবেন কি না সেটা নিয়ে অনেকেই সন্দিহান। তাছাড়া যে দর ধরা হয়েছে সেই ধরে বিক্রি করলেও খুব একটা লাভ হবে না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বেশির ভাগ মাদরাসায় বছরে যে খরচ হয় এর তেমন উল্লেখযোগ্য কোরবানির কালেকশন থেকে আসে না। এটা না হলেও মাদরাসাগুলো তেমন কোনো অর্থ সংকটে পড়বে না। অথচ এই কালেকশন করতে গিয়ে ব্যাপক শ্রম ও সময় নষ্ট হয়। তাছাড়া ক্ষেত্রে বিশেষে জনসাধারণের কাছে অসম্মান ও হেয়ও হতে হয়। সাধারণ মানুষ অনেকেই মনে করেন, এই কালেকশনের দ্বারা মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকদের না জানি কী লাভ। অথচ এমন অনেকেই এই কাজের সঙ্গে স্বতস্ফূর্তভাবে যুক্ত হন যাদের বাড়িতে হয়ত এক বা একাধিক কোরবানি হয়। দীনের স্বার্থেই মূলত তারা এই কাজ করে থাকেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, কোরবানির কালেকশন এমন কিছু নয় যে, এটা বিকল্পহীন। এজন্য কোরবানির চামড়া কালেকশনের ব্যাপারে মরিয়া হওয়ার পক্ষপাতি নন অনেকেই। তারা বলছেন, প্রতিটি মাদরাসায় কোবরানির চামড়া গ্রহণের সুযোগ থাকতে পারে। প্রয়োজন হলে মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকরা এলাকাবাসীর কোরবানিতে সহযোগিতাও করতে পারে। তবে সেটা যেন মাদরাসাগুলোর মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা সৃষ্টি না করে। জনসাধারণের চোখে যেন আলেমদের ইজ্জত-সম্মানের হানি না হয়, তাদের যেন কেউ হেয় নজরে না দেখে। কারণ তাদের সম্মানের সঙ্গে দীনের ইজ্জত-সম্মান জড়িত। এজন্য এখনই চামড়া কালেকশনের ব্যাপারে মাদরাসা কর্তৃপক্ষকে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত বলে মনে করেন সচেতন আলেমরা।
এসএকে/