শনিবার, ১৮ মে ২০২৪ ।। ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ ।। ১০ জিলকদ ১৪৪৫


ইতিকাফের বিধান, গুরুত্ব ও ফজিলত

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মাওলানা আনিছুর রহমান আনছারী

ইতিকাফের পরিচয়
ইতিকাফ (اعتكاف) শব্দটি আরবি, যা عكف মূল ধাতু থেকে উৎকলিত। এর অর্থ হলো- অবস্থান করা। ইসলামি শরিয়তের পরিভাষায় ইতিকাফ বলা হয়, নিয়ত সহকারে বিশেষ বৈশিষ্ট্যের সাথে একাগ্রচিত্তে মসজিদে অবস্থান করাকে।

ইতিকাফের গুরুত্ব ও তাৎপর্য
ইসলামে ইতিকাফের গুরুত্ব অপরিসীম। আল্লাহ তা'আলা পবিত্র কুরআনে বলেন,'আর আমি ইবরাহিম ও ইসমাঈল (আঃ)কে নির্দেশ দিলাম যে, আমার ঘরকে তাওয়াফকারী ও ইতিকাফকারীদের জন্য পবিত্র কর।'( সূরা বাকারা- ১২৫ )

অপর আয়াতে আল্লাহ পাক বলেন-
‘তোমরা স্ত্রীদের সাথে মেলা-মেশা করো না যখন তোমরা মসজিদে ইতিকাফ কর। ' ( সূরা বাকারা - ১৮৭)।

অন্তরকে একমাত্র আল্লাহর প্রতি মনোনিবেশ করার জন্য ইতিকাফ এক চমৎকার প্রশিক্ষণ। সুন্নাতসম্মত পন্থায় দুনিয়া বিরাগী হওয়ার এবং লাইলাতুল কদর তালাশ করার ক্ষেত্রে ইতিকাফ এর বিকল্প নেই। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতি বছর রমজান মাসে ইতিকাফ করতেন।

আর উম্মতের জন্য রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ করা সুন্নাতে মুআক্কাদায়ে কিফায়া। যদি কোন মহল্লা থেকে একজন ব্যক্তি আদায় করে তাহলে সকলের পক্ষ থেকে আদায় হয়ে যাবে। কিন্তু যদি মহল্লার কেউ আদায় না করে তাহলে সকলেই গুনাহগার হবে।

একাধিক হাদিসে এসেছে -
عن عائشة رضي الله عنها، أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال: تحروا ليلة القدر في الوتر، من العشر الاواخر من رمضان.
'হযরত আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমরা রমজানের শেষ দশকের বিজোড় রাতে লাইলাতুল ক্বদর তালাশ কর।' ( বুখারী শরীফ, হাদিস নং ১০৭২)।

عن عائشة رضي الله عنها زوج النبي صلى الله عليه وسلم، أن النبي صلى الله عليه وسلم كان يعتكف العشر الاواخر من رمضان حتى توفاه الله، ثم اعتكف أزواجه من بعده.
'রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর স্ত্রী আম্মাজান হযরত আয়েশা রা. হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন। ( বুখারী শরীফ, হাদিস নং - ১৯৮১)।

অন্য হাদিসে এসেছে,
عن عائشة رضي الله عنها قالت كان رسول الله صلى الله عليه وسلم إذ دخل العشر أحيا الليل و أيقظ أهله وجد و شد المءزر.
' হযরত আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রমযানের শেষ দশক শুরু হওয়ার সাথে সাথে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সারারাত জেগে থাকতেন ও নিজ পরিবারের সদস্যদের ঘুম থেকে জাগাতেন এবং তিনি নিজেও ইবাদতের জোড় প্রস্তুতি নিতেন। ( সহিহ মুসলিম, বাবুল ই'তিকাফ)

عن أنس بن مالك رضي الله عنه قال: كان النبي صلى الله عليه وسلم يعتكف في العشر الأواخر من رمضان، فلم يعتكف عاما، فلما كان في العام المقتل اعتكف عشرين.
'হযরত আনাস ইবনে মালিক রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজান মাসের শেষ দশ দিন ইতিকাফ করতেন। কিন্তু এক বছর তিনি ই'তিকাফ করলেন না। তাই পরবর্তী বছর তিনি ইতিকাফ করলেন। ( তিরমিযি শরীফ, হাদিস নং - ১০৭২)।

عن ابي هريرة رضي الله عنه قال: كان النبي صلى الله عليه وسلم يعتكف في كل رمضان عشرة أيام، فلما كان العام الذي قبض فيه اعتكف عشرين يوما.
'হযরত আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতি বছর দশ দিন ইতিকাফ করতেন। অতঃপর যে বছর তিনি ইন্তেকাল করেন সে বছর বিশ দিন ইতিকাফ করেন। ( বুখারী শরীফ, হাদিস নং - ১৯৯৭)

عن عبدالله بن عمر رضي الله عنهما قال: كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يعتكف العشر الاواخر من رمضان.
'হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন। ( বুখারী শরীফ, হাদিস নং - ১৯৮০)

সুতরাং এই হাদিসগুলো দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, ইতিকাফ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আমল, যা তিনি জীবনের শেষ রমজান পর্যন্ত গুরুত্ব সহকারে আদায় করেছেন। তাই আমাদের উচিত রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই গুরুত্বপূর্ণ আমলটি আঁকড়ে ধরা।

ইতিকাফের ফজিলত
ইতিকাফ মুমিনের জীবনে এক গুরুত্বপূর্ণ ও ফজিলতপূর্ণ ইবাদত। হাদিসে এর অনেক ফজিলত বর্ণিত হয়েছে । যেমন :

عن عبدالله بن عباس رضي الله عنه أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال في المعتكف هو يعكف الذنوب و يجري له من الحسنات كعامل الحسنات كلها.
'হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইতিকাফকারী সম্পর্কে বলেছেন, সে নিজেকে গুনাহ থেকে বিরত রাখে এবং নেককারদের সকল নেকী তার জন্য লেখা হয়। ( সুনানে ইবনে মাজাহ, বাবুস সাওম)

عن عبدالله بن عباس رض. عن النبي صلى الله عليه وسلم قال في المعتكف و من اعتكف يوما ابتعاء وجه الله تعالى جعل الله بينه وبين النار ثلاث خناديق أبعد ما بين الخافقين.
'হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে একদিন ইতিকাফ করবে আল্লাহ তাআলা তার ও জাহান্নামের মাঝে তিন খন্দক সমান দুরত্ব সৃষ্টি করবেন, যা আসমান জমিনের দুরত্ব অপেক্ষা বেশি। ( তবারানী শরীফ)।

قال رسول الله صلى الله عليه وسلم من اعتكف عشر في رمضان كان كحجتين و عمرتين.
'রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি রমজান মাসে দশ দিন ইতিকাফ করবে তার জন্য দুইটি হজ্জ ও দুইটি ওমরার সওয়াব লেখা হবে।' ( বায়হাকী, হাদিস নং - ৩৬৮০)

উপরন্তু ইতিকাফকারী যদি রমজানের শেষ দশকের বিজোড় রাত্রগুলোতে ইবাদত করে তাহলে অবশ্যই সে লাইতুল কদরের ফজিলত লাভ করবে। আর কদর রাতের ফজিলত সম্পর্কে আল্লাহ তা'আলা বলেন -

لَيْلَةُ الْقَدْرِ خَيْرمِّنْ اَلْفِ شَهْرٍ.

'কদরের রাত্র হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম।'
( সূরা ক্বদর - ০৩)

এছাড়াও ইতিকাফের মাধ্যমে ব্যক্তি সহজেই আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে পারে।

ইতিকাফের প্রকারভেদ ও হুকুম
১. ওয়াজিব ইতিকাফ। তা হলো মান্নত ই'তিকাফ। অর্থাৎ যে কয়দিন মান্নত করবে সে কয়দিন ইতিকাফ করা ওয়াজিব।
২. সুন্নাত ইতিকাফ। এটা হলো রমজানের শেষ দশ দিনের ই'তিকাফ। রমজানের শেষ দশক দিনের ইতিকাফ করা সুন্নাতে মু'আক্কাদায়ে কিফায়া। মহল্লাবাসীর কোন একজন আদায় করলে সকলের পক্ষ থেকে আদায় হয়ে যাবে। আর কেউ আদায় না করলে মহল্লাবাসী সকলেই গুনাহগার হবে।
উল্লেখ্য, রমজানের ২০ তারিখ সূর্যাস্তের কিছুক্ষণ পূর্ব থেকে সুন্নাত ইতিকাফ আরম্ভ হয়। আর যে দিন ঈদুল ফিতরের চাঁদ দেখা যায় সে দিন শেষ হয়। যদি সূর্যাস্তের কিছুক্ষণ পূর্বে চাঁদ দেখা যায়, তাহলে সূর্যাস্ত হওয়া পর্যন্ত ইতিকাফে অবস্থান করা আবশ্যক।
( ফাতাওয়ায়ে শামি ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা ১৭৯)
৩. নফল ইতিকাফ। মান্নত ও রমজানের শেষ দশকের ইতিকাফ ব্যতীত অন্য সময়ের ইতিকাফ নফল পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত। এই ইতিকাফে সময়ের ব্যাপারে কোন সীমাবদ্ধতা নেই।

ইতিকাফের শর্তসমূহ
১. ইতিকাফের নিয়ত করা ।
২. রোজাদার হওয়া।
৩. জামাত হয় এমন মসজিদ হওয়া।
৪. মুসলমান হওয়া।
৫. আকেল ও জ্ঞানবান হওয়া।
৬. জানাবাত ও হায়েজ নেফাস থেকে পবিত্র থাকা।
৭. মহিলা তার ঘরে নামাজের জন্য নির্ধারিত স্থানে ইতিকাফ করা।
৮. মহিলা ইতিকাফ অবস্থায় ঘর থেকে বের না হওয়া।
৯. মহিলাদের জন্য স্বামীর অনুমতি নেওয়া।
১০. ওয়াজিব ও সুন্নাত ইতিকাফের জন্য রোজা শর্ত কিন্তু নফল ইতিকাফের জন্য রোজা শর্ত নয়।
১১. পাগল না হওয়া।
( সূত্রঃ ফাতাওয়ায়ে শামি ও ফাতাওয়ায়ে আলমগীরী )।

ইতিকাফের আদবসমূহ
* বেশি বেশি কুরআন ও হাদিস পাঠ করা।
* সিরাতুন্নবী সা. অধ্যয়ন করা।
* আম্বিয়া আ.গণের জীবনী পাঠ করা।
* ইলমে দ্বীন শিক্ষা করা ও শিক্ষা দেওয়া।
* গুনাহ হয় এমন কাজ না করা।
* সালিহীনদের কিতাবাদি পাঠ করা।
* বেশি বেশি আল্লাহর জিকির করা।
* শরয়ি আহকামের কিতাবাদি পাঠ ও রচনা করা।
* প্রয়োজন ছাড়া মুবাহ কথা না বলা। ইত্যাদি।
( ফাতাওয়া ও মাসায়েল ই.ফা. ১ম খন্ড)

ইতিকাফ ভঙ্গের কারণসমূহ
১. ইতিকাফ অবস্থায় স্ত্রীর সাথে সহবাস করা।
২. শরয়ি ও মানবীয় প্রয়োজন ছাড়া মসজিদ থেকে বের হওয়া। শরয়ি প্রয়োজন হলো: জুমার নামাজ, ফরজ গোসল ইত্যাদি। আর মানবীয় প্রয়োজন হলো : প্রস্রাব, পায়খানা ইত্যাদি।
* ইমাম আবু হানিফা রহ. এর মতে, এই সকল কাজ ছাড়া মসজিদের বাহিরে গেলে ই'তিকাফ ভঙ্গ হয়ে যাবে। হোক সেটা ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত।
৩. ইতিকাফ অবস্থায় জানাযার নামাজে অংশগ্রহণ করা ।
৪. ইতিকাফ অবস্থায় রুগী দেখতে যাওয়া।
৫. যে সকল কাজ মসজিদে করা সম্ভব, ঐ সকল কাজ করার জন্য মসজিদ হতে বের হওয়া। যেমন, ঘুম, খাওয়া।
৬. ইতিকাফ অবস্থায় পাগল বা বেহুশ হয়ে যাওয়া।
৭. ইতিকাফ অবস্থায় কোন মহিলার মাসিক শুরু হলে ইতিকাফ নষ্ট হয়ে যাবে।
( সূত্র : হেদায়া, ফাতাওয়ায়ে শামি, ফাতাওয়ায়ে আলমগীরী )

নিষিদ্ধ কার্যাবলী
* ব্যবসার উদ্দেশ্যে মসজিদে ক্রয় বিক্রয় করা মাকরূহ।
* ক্রয় বিক্রয়ের বস্তু মসজিদে উপস্থিত করা মাকরূহ।
* ইতিকাফ অবস্থায় কথা না বলাকে ইবাদত মনে করা মাকরূহ। তবে গুনাহ হয় এমন কথা পরিহার করা ওয়াজিব।
* ই'তিকাফ অবস্থায় স্ত্রীকে চুম্বন করা, স্পর্শ ও আলিঙ্গন করা বা সঙ্গম করা হারাম।
( সূত্র : ফাতাওয়ায়ে শামি ও ফাতাওয়ায়ে আলমগীরী )।

পরিশেষে বলা যায়, ইতিকাফের মতো একটি বরকতময় ইবাদাতে আমাদের অংশগ্রহণ করে দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ হাসিল করা এবং মহান রাব্বুল আলামিনের সন্তুষ্টি অর্জন করা খুবই প্রয়োজন। মহান আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে ইতিকাফ করার মাধ্যমে তার নৈকট্য লাভ করার তৌফিক দান করুন। আমীন।

-একে


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ