শনিবার, ১৮ মে ২০২৪ ।। ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ ।। ১০ জিলকদ ১৪৪৫


সারা বিশ্বে একই দিনে ঈদ অসহায় যুক্তি-তর্ক (২য় পর্ব)

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুফতি জুনাঈদ আহমাদ

আসলে ইখতেলাফ কী নিয়ে? বিভিন্ন ফিকহের কিতাবে উদয়স্থলের গ্রহন যোগ্যতা নিয়ে যে মতবিরোধ রয়েছে তা হচ্ছে কাছাকাছি শহর বা দেশসমূহের ব্যপারে।

ইমাম নববী র. শরহুল মুহায্যাবে লিখেন..
إذا رأوا الهلال في رمضان في بلد ولم يروه في غيره ، فإن تقارب البلدان فحكمهما بلد واحد ويلزم أهل البلد الآخر الصوم بلا خلاف وإن تباعدا فوجهان مشهوران في الطريقتين ( أصحهما ) لا يجب الصوم على أهل البلد الآخر=شرح المهذب-٦/٢٨٣

একটি শহরের লোকেরা যদি রমযানের চাঁদ দেখে। আর অপর আরেকটি শহরের লোকেরা না দেখে। তাহলে শহর দুটি যদি কাছাকাছি হয় তখন দুই শহরের বিধান একই হবে। আর যে শহরে চাঁদ দেখা যায়নি সেই( নিকটবর্তী) শহরের লোকদেরও রোযা রাখতে হবে। এতে কোন দ্বীমত নেই। আর শহর যদি দূরবর্তী হয় এবিষয়ে দুটিমত আছে: সহীহ মত হচ্ছে এক শহরে চাঁদ দেখার দ্বারা অপর শহরে রোযা রাখা লাগবে না। ৬/২৮৩

আবুল আব্বাস কুরতুবি র. বলেনে:
قلت : وهذا الإجماع الذي حكاه أبو عمر يدل على أن الخلاف الواقع في هذه المسألة إنما هو فيما تقارب من البلاد . ولم يكن في حكم القطر الواحد . المفهم-٣/١٤٢

আবু উমর যে ইজমা নকল করেছেন তা থেকে বোঝা যায় এই মাসালায় মতবিরোধটা হচ্ছে কাছাকাছি শহর বা দেশসমূহের ব্যপারে। (আল মুফহিম-৩/১৪২-৪৪)
আবুল ওয়ালিদ ইবনে রুশদ বিদায়াতুল মুজতাহিদ গ্রন্থে লিখেন..
وأجمعوا أنه لا يراعى ذلك في البلدان النائية كالأندلس والحجاز .بداية المجتهد-١/٢٣٨

এব্যপারে সকলেই একমত যে , দূরবর্তী দেশসমূহের ব্যপারে-যেমন স্পেন আর হেজায - এক দেশের চাঁদ দেখা আরেক দেশে ধর্তব্য হবে না।(বিদায়াতুল মুজতাহিদ-১/২৩৮,৩৯ )

একই দিনে সারা বিশ্বে ঈদ অসম্ভব বিষয়: একই দিনে সারা বিশ্বে ঈদের দাবি যারা তুলেছেন তারা কি ভেবেও দেখেন না ? যে একই দিনে সারা বিশ্বে ঈদ উদযাপন একটি অসম্ভব বিষয় । কারন ইসলামের দৃষ্টিতে ঈদ উদযাপন করতে যা বুঝায় তাতে সর্ব প্রথমই আসে ঈদের নামাজের বিষয় । ঈদুল ফিতরের দিনের ওয়াজীব শুধু এই একটিই তা হচ্ছে ঈদের নামাজ।

আর ঈদুল আযহার দিনে আগে ঈদের নামাজ পরে কুরবানী। মোটকথা: উভয় ঈদের দিনের প্রথম কাজ হচ্ছে ঈদের নামাজ। সহীহ বুখারীতে আছে

وعنه رضي الله قال: "كان النبي صلى الله عليه وسلم يخرُجُ يوم الفطر والأضحى إلى المصلى، وأول شيء يبدأ به الصلاة، ثم ينصرف فيقوم مقابل الناس، والناس على صفوفهم فيَعِظهم ويأمرهم"؛ متفق عليه.

রাসূল সা. ঈদুল ফিফতর ঈদুল আযহার দিনে ঈদগাহে গিয়ে সর্ব প্রথম ঈদের নামাজ আদায় করতেন। হা. ৯৫৬ ।
অন্য হাদীসে রয়েছে

عن البراء بن عازب، قال: قال النبي صلى الله عليه وسلم: ্রإن أول ما نبدأ في يومنا هذا أن نصلي، আজকের দিনে আমরা সর্ব প্রথম যে কাজ দিয়ে শুরু করব তা হচ্ছে নামাজ। বুখারী, হা. ৯৬৫। ঈদের নামাজ আদায় করতে হয় সূর্যদয়ের পর । এর আগে ঈদের নামাজ আদায় করলে তা মোটেই সহীহ হবে না।

কিন্তু একই দিনে সারা বিশ্বে ঈদ উদযাপন করতে গেলে যখন একই সাথে ঈদের নামাজ আদায় করারও দাবি উঠবে। তখন দেখা যাবে তা সম্পূর্ন অসম্ভব । কারন দেশে দেশে রয়েছে সময়ের বিস্তর ব্যবধান। এক দেশে যখন সকাল ৬টা অন্য দেশে হয়ত তখন রাত ১২টা । আবার অন্য কোন দেশে হয়ত তখন সন্ধ্যা। রাতে বা সন্ধ্যায় তো ঈদের নামাজ সহীহ হবে না। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন نَّ الصَّلَاةَ كَانَتْ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ كِتَابًا مَوْقُوتًا [النساء: ১০৩ إ

নির্ধারিত সময়ে নামাজ আদায় করা মুমিনদের জন্য কর্তব্য। নিসা-১০৩। একই দিনে সারা বিশ্বে ঈদ উদযাপন করতে হলে একই দিনে রোযা রাখাও শুরু করতে হবে। আর একই দিনে রোযা রাখতে হলে গোটা পৃথিবীর মানুষকে একই সময়ে সাহারি খাওয়া লাগবে। নির্দিষ্ট সময়ে সাহরি খাওয়া শরীয়তে জরুরী না। তবে সুবহে সাদিকের পর সাহরী খাওয়া কোনভাবেই জায়েজ নাই । খেলে রোযা হবে না।

কিন্তু সকল দেশের সুবহে সাদিক তো আর একসাথে হবে না। আল্লাহ তয়ালা ইরশাদ করেন

وَكُلُوا وَاشْرَبُوا حَتَّى يَتَبَيَّنَ لَكُمُ الْخَيْطُ الأَبْيَضُ مِنَ الْخَيْطِ الأَسْوَدِ مِنَ الْفَجْرِ [البقرة:১৮৭] তোমরা পানাহার কর যতক্ষন না রাতের কালো রেখা হতে ভোরের সাদা রেখা সুস্পস্ট নাহয়। বাকারা- ১৮৭

একই দিনে সারা বিশ্বে ঈদ উদযাপন করতে হলে একই দিনে রোযা রাখা শেষও করতে হবে।আর সে জন্য গোটা পৃথিবী বাসীর একই সময়ে ইফতারও করতে হবে। ইফতার করতে হয় সূর্যাস্তের পর। কিন্তু গোটা পৃথিবীর সূর্যাস্ত কি একসাথে কোন দিনও হবে? আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন ثُمَّ أَتِمُّوا الصِّيَامَ إِلَى اللَّيْلِ অত:পর রাত পর্যন্ত রোযা পূর্ন কর। বাকারা- ১৮৭

মোটকথা একই দিনে সারা বিশ্বে ঈদ উদযাপন করতে হলে গোটা পৃথিবীর সাহরী,ইফতার ও পাঁচ ওয়াক্তের নামাজের জন্য একটি স্বতন্ত্র ক্যালেন্ডার প্রণয়ন করতে হবে। এটা কি কোন দিন সম্ভব ? যদি এটা করতেই হয় তাহলে উপরোক্ত পবিত্র তিনটি আয়াতকেই সুস্পস্ট লংঘন করতে হবে।

একটু ভেবে দেখুন একটি বিষয়কে প্রমান করতে গিয়ে পবিত্র কুরআনের অন্তত তিনটি আয়াত , কিছু হাদীস এবং ফুকাহায়ে কেরামের মতকে অস্বিকার করতে হবে।

তবে কি একই দিনে সারা বিশ্বে ঈদ উদযাপন করার গোড়ামী দাবী করে ঈমান হারা হওয়া অযৌক্তিক নয় কি? একই দিনে সারা বিশ্বে ঈদ উদযাপন করতে গেলে প্রশ্ন উঠবে: কোন দেশের চাঁদ দেখে সারা বিশ্বের মানুষ ঈদ করবে? পবিত্র কুরআন ও হাদিসে এমন কথা কি কোথাও আছে যে তোমরা বিশ্ববাসী অমুক দেশের চাঁদ দেখে ঈদ উদযাপন করবে? যারা বলছেন যে সৌদি আরবে যেদিন ঈদ হবে সেদিনই গোটা বিশ্বে ঈদ হবে।

কিন্তু এমন একটি আয়াত বা দূর্বল হাদিসও কি কেউ দেখাতে পারবে? যাতে সৌদি আরবের চাঁদ দেখে গোটা বিশ্বকে ঈদ করতে বলা হয়েছে। কিয়ামত পর্যন্ত তা সম্ভব হবে না ইনশাআল্লাহ। সুতরাং কিয়ামত পর্যন্ত গোটা পৃথিবীতে একই দিনে ঈদও হবে না।

লেখক: মুদাররিস, শেখ জনূরুদ্দীন র. দারুল কুরআন মাদরাসা, মালিবাগ, চৌধুরী পাড়া-ঢাকা।


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ