শনিবার, ১৮ মে ২০২৪ ।। ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ ।। ১০ জিলকদ ১৪৪৫


তাবলিগ জামাতের প্রতিষ্ঠাতা মুরুব্বি মাওলানা ইলিয়াস কান্দলভি রহ.

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মিরাজ রহমান: ১৮৮৫ সালে ভারতের ‘কান্দালা’ নামক এক শহরে জন্ম গ্রহণ করেন মাওলানা ইলিয়াস রহ.। শহরের নাম অনুসারে তাই নামের শেষে ব্যবহৃত হয় ‘কান্দলভি’ শব্দটি। তাঁর ছোটবেলা কেটেছে নানিবাড়ি মেওয়াতে।

মাওলানা ইলিয়াস যখন একটু বড় হলেন, পড়াশুনা করার তাগিদে বাবার কাছে নিজামুদ্দিন চলেন এলেন তিনি। বাবা মাওলানা ইসমাইলের রহ. কাছেই ‘আলিফ-বা’র সবক শুরু করেন এবং খুব অল্পদিনের মাঝে পবিত্র কোরানের হিফজ সমাপ্ত করেন। প্রখর মেধাবী ছাত্র ছিলেন ইলিয়াস। মেধা-দক্ষতার পাশাপাশি পরিবারের সবার মুরুব্বি ‘আম্মিবি’র (মাওলানা ইলিয়াস রহ.-এর নানি) দোয়া ছিল তাঁর প্রতি। আম্মিবির আশা ছিল, ‘আমার নাতি যেন সাহাবা আজমাইনের মতো দীনের দায়ি থেকে পারে।

মানুষের দ্বারে দ্বারে দীনের দাওয়াত নিয়ে পৌঁছার জন্য আল্লাহ যেন আমার নাতিকে কবুল করেন। আল্লাহ যেন আমার নাতিকে দায়ি হিসেবে কবুল করেন’। আম্মিবি আমাতুস সালামের দোয়া ও প্রার্থনাকে পূরণ করলেন আল্লাহ মহান। কেবল ভারত কিংবা দিল্লি এলাকায় নয়; গোটা পৃথিবীজুড়ে দীনি দাওয়াতের বর্তমান যে ধারা প্রচলিত রয়েছে, তাবলিগি কার্যক্রমের নবিওয়ালা যে পদ্ধতি চালু রয়েছে এর নেপথ্যে মাওলানা ইলিয়াস রহ.-এর চিন্তা-ফিকির, দোয়া-মোনাজাত ও চোখের পানি সবচেয়ে বড় নিয়ামক হিসেবে কবুল হয়েছে। এক কথায়, উম্মতে মুহাম্মাদির পরলৌকিক মুক্তিকামী এই নবিওয়ালা কাজের উদ্ভাবক, বর্তমান তাবলিগ জামাতের প্রাণপুরুষ-রূপকার একমাত্র তিনিই হজরত মাওলানা ইলিয়াস কান্দলভি রহ.।

পবিত্র কোরান হিফজ করার পর বড় ভাইয়ের সঙ্গে পড়াশুনা করার জন্য গাঙ্গুহ চলে আসেন ইলিয়াস। এখানে এসেই তিনি মাওলানা রশিদ আহমদ গাঙ্গুহির রহ. সোহবত-সংস্পর্শ লাভ করেন। ইলমে অহির সফল ধারক; সুন্নাতে নববির পরিপূর্ণ সাধক এক মহাপুরুষের সংর্স্পশ-শুভ্রতায় আলোকিত হয়ে ওঠে মাওলানা ইলিয়াসের জীবন-সাধনা। কিছুকাল অসুস্থ থাকার কারণে ভালোভাবে পড়াশুনায় অংশ গ্রহণ করতে পারেননি তিনি। পুরোপুরি সুস্থতা লাভ করার পর পুনরায় মনোনিবেশ করেন পড়াশুনায় এবং খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে দাওরায়ে হাদিস জামাত সমাপ্ত করেন।

পড়াশুনার পাশাপাশি আধ্যাত্মিক সাধনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে মাওলানা রশিদ আহমদ গাঙ্গুহির রহ. কাছে বায়আত গ্রহণ করেন মাওলানা ইলিয়াস। কোনো কোনো ইতিহাসবিদের মতে, মোট বিশ বছর মাওলানা রশিদ আহমদ গাঙ্গুহির রহ. সোহবাতে ছিলেন মাওলানা ইলিয়াস রহ.। মাওলানা রশিদ আহমদ গাঙ্গুহির রহ. ইনতিকালের পর দেওবন্দে চলে আসেন তিনি এবং মাওলানা মাহমুদ হাসানের রহ. ছাত্রত্ব গ্রহণ করেন। এ সময় তিনি মাওলানা মাহমুদ হাসানের রহ. কাছে পুনরায় তিরমিজি শরিফসহ বিভিন্ন হাদিসের গ্রন্থ পাঠ করেন বলে জানা যায়।

ভারতের সাহরানপুরে অবস্থিত মাজাহিরুল উলূম মাদরাসায় শিক্ষকতা প্রাপ্তির মাধ্যমে মাওলানা ইলিয়াস রহ.-এর কর্মজীবনের সূচনা ঘটে। প্রথম শিক্ষকতা। প্রথম কর্মক্ষেত্র। একাধারে আট বছর এই মাদরাসায় শিক্ষকতা করেছেন তিনি। মাদরাসায় শিক্ষক থাকাকালীন ১৯১২ সালের ১৭ অক্টোবর মামাতো বোনের সঙ্গে শুভ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন মাওলানা ইলিয়াস। এরপর তাঁর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়টির আগমন ঘটে। পরির্বতন আসে জীবনের কর্মে-চিন্তায় এবং বিশ্বাস-আমলে। যেখানে, যে অঞ্চলে থাকাকালীন এবং যে মানুষগুলোর পশ্চাৎপদতায় মনের গভীরে চিন্তার জোয়ার উঠেছিল, সেই এলাকায় যাওয়া হলো মাওলানার। পিতা ও বড় ভাইয়ের ইনতিকালের কারণে মেওয়াতি জনসাধারণ এবং পরিবারের বিশেষ অনুরোধে মাজাহিরুল উলূম মাদরাসা ছেড়ে মেওয়াত চলে এলেন মাওলানা ইলিয়াস।

মেওয়াতে এসে বাবার প্রতিষ্ঠিত মক্তব দেখাশুনা শুরু করলেন এবং একই ধারাবাহিকতায় নিজ খরচে আরো বেশ কয়েকটি মক্তব প্রতিষ্ঠা করলেন তিনি। দীনি এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতে গিয়ে মেওয়াতবাসীর মানসিক জাহেলিপনা ও জ্ঞানগত অন্ধত্ব ভীষণভাবে চিন্তিত করে তোলে তাঁকে। গভীর ভাবনায় নিমগ্ন ইলিয়াস ভাবতে থাকেন, কীভাবে এবং কোন পদ্ধতি অবলম্বন করে দীনহীন এই মানুষগুলোকে আল্লাহর পথে আনা যায়; জাহেলিপনায় মত্ত এই লোকগুলোকে কীভাবে আল্লাহওয়ালা বানানো যায়। চিন্তা-ভাবনার এক শুভক্ষণে নবিওয়ালা দাওয়াতি চিন্তা-পদ্ধতির কথা স্মরণ করেন এবং নিজ কওমের লোকজনকে নবিদের আদলে দীনের দাওয়াত দেওয়া শুরু করেন তিনি। তাদের বোঝাতে শুরু করেন যে, আমরা যেখানে আছি এটাই আমাদের চিরস্থায়ী নিবাস নয়; আমাদের চিরস্থায়ী নিবাস হলো জান্নাত।

সেই চিরস্থায়ী নিবাসে বসবাস করার সামান জোগাড়ের জন্য পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছে আমাদের। একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করাই আমাদের কাজ। এই কাজের জন্যই আমরা এই পৃথিবীতে প্রেরিত হয়েছি।

একে একে দুই। দুইয়ে দুইয়ে চার। এভাবেই ধীরে ধীরে বাড়তে থাকলো মাওলানা ইলিয়াসের রহ. দাওয়াত শোনা মানুষের সংখ্যা। আরো বেশি পরিমাণে মানুষের আগমন ঘটতে লাগলো তাঁর দীনি হালকায়। মানুষ তাঁর কথা শুনে ফিরে এলো দীনের পথে এবং ছেড়ে দিলো অতীত জীবনের নানান কু-কর্ম। দিন, সপ্তাহ, মাস এবং বছরের সীমানা পেরিয়েই আজকের এই সফলতার শীর্ষমিনারের স্থান দখল করেছে মাওলানা ইলিয়াস রহ. প্রবর্তিত নবিওয়ালা দাওয়াতি মিশন- তাবলিগ। মাওলানা ইলিয়াস রহ.-এর তাবলিগ জামাতের সফলতা সম্পর্কে মাওলানা সাইয়িদ সুলাইমান নদভি রহ. বলেন, ‘হজরত মাওলানা অত্যন্ত মৌনতার সাথে নিজের ইখলাস এবং সাদাসিধা পদ্ধতিতে দীনি দাওয়াতের সঠিক উসূল প্রণয়ন করার মাধ্যমে সুদীর্ঘ ২৫ বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমের দ্বারা গোটা মেওয়াতবাসীকে খাঁটি মুসলমানে পরিণত করেছেন।

মেওয়াতবাসী এইসব মুসলমানের ভেতর-বাহিরের অবস্থা দেখে খানদানি মুসলমনারাও ঈর্ষান্বিত হয়’। মাওলানা ইলিয়াসের মেহনতে গোটা মেওয়াতে আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল আর সেই আমূল পরিবর্তনের ব্যাপ্তি আজ বিশ্বময়।

পৃথিবীতে এলে বিদায় নিতেই হবে। জন্ম যার ঘটেছে মৃত্যুর স্বাদ তিনি আস্বাদন করবেনই। কুল্লু নাফসিন যা-ইকাতুল মাউত। এক কবি লিখেছেন মৃত্যু এমন এক পেয়ালা শরবত; যে শরবত সবাইকেই পান করতেই হবে এবং কবর এমন এক ঘর যে ঘরে সবাইকে প্রবেশ করতেই হবে। চলে যেতে হয়, চলে যেতে হবে- মুসলিম জাতির জীবনের একটি অমোঘ সত্য এই মৃত্যু। একজন মুমিন বান্দা হিসেবে; আল্লাহ মহানের একজন খাঁটি গোলাম হিসেবে মাওলানা ইলিয়াসও একদিন চলে গেলেন। প্রিয়তম প্রভুর ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গেলেন তিনি।

ইহলৌকিক মায়া-মহব্বত আর ভালোবাসাকে বিদায় জানিয়ে মহান প্রভুর সান্নিধ্য-সুখ অর্জন করলেন একজন মাওলানা ইলিয়াস কান্দলভি। কাজ রয়ে গেল, জারি রইলো একটি আন্দোলন; কাজের সফলতার ব্যাপ্তি ঘটলো, আলোকিত-আলোড়িত হলো লক্ষ-কোটি হৃদয়-আত্মা। কিন্তু যিনি এই কাজটি শিখিয়েছিলেন তিনিই আর রইলেন না। চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে।

নবিওয়ালা কাজের জিম্মাদারি কাঁধে চড়িয়ে দিয়ে বিদায় নিলেন তিনি। ১৯৪৪ সালেল ১২ জুলাই প্রিয়তম প্রভুর সান্নিধ্যে চলে গেলেন মাওলানা ইলিয়াস।

-এসআর


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ