শনিবার, ১৮ মে ২০২৪ ।। ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ ।। ১০ জিলকদ ১৪৪৫


তাবলিগ জামাত ও বিশ্ব ইজতেমা

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

আমিন ইকবাল: ‘তাবলিগ’ আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ প্রচার করা, প্রসার করা, ইসলামের দাওয়াত দেয়া, বয়ান করা, প্রচেষ্টা করা বা পৌঁছানো প্রভৃতি। পরিভাষায় একজনের অর্জিত জ্ঞান বা শিক্ষা নিজ ইচ্ছা ও চেষ্টার মাধ্যমে অন্যের কাছে পৌঁছানো বা শিক্ষা দেওয়াকে তাবলিগ বলা হয়।

তাবলিগ এক নিরলস সংগ্রাম ও সাধনার নাম। তাবলিগের মুখ্য উদ্দেশ্য আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে মানুষের সঙ্গে তার সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর পরিচয় ও সম্পর্ক হওয়া, যাতে তার কাছ থেকে মানুষ সব সমস্যার সমাধান লাভ করে দুনিয়া ও আখিরাতে শান্তি সফলতা অর্জন করতে পারে।

ধর্মপ্রাণ মানুষ আত্মশুদ্ধি ও তাকওয়া অর্জনের মাধ্যমে সমাজজীবনে নানারকম দুর্নীতি, সুদ, ঘুষ, চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, সন্ত্রাস, বোমাবাজি, হত্যাকাণ্ড নির্যাতন, অন্যায়-অবিচার, পাপাচার, ব্যভিচার, বিশৃংখলা, মিথ্যাবলা, অন্যের ক্ষতি করা প্রভৃতি সামাজিক অনাচার থেকে বিরত থাকতে পারেন। মূলত ইসলাম ধর্মের মৌলিক নীতি, আদর্শ ও শিক্ষাবলী অন্যের কাছে সহজভাবে পৌঁছে দেয়াই হলো তাবলিগ।

‘ইজতেমা’ শব্দের অর্থ সমবেত করা, সভা সমাবেশ বা সম্মেলন। ধর্মীয় কোনো কাজের জন্য বহুসংখ্যক মানুষকে একত্র করা, কাজের গুরুত্ব বোঝানো, কাজটি যথাযথভাবে সম্পন্ন করার জন্য সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং ব্যাপকভাবে এর প্রচার প্রসারের জন্য বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণ করা ইত্যাদি বিষয়কে পরিভাষায় ধর্মীয় ইজতেমা বলা হয়।

‘তোমার কাছে যদি কোনো বাণী থাকে তা অন্যের কাছে পৌঁছে দাও’ নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মুখনিঃসৃত এ শাশ্বত বাণীকে আহ্বান করে ঢাকার অদূরে টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরে প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হয় তাবলিগ জামাতের বিশ্ব ইজতেমা। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসলমান এ মহাসম্মেলনে সমবেত হন। একই সঙ্গে মিলিত হন বিশ্বের অর্ধশতাধিক দেশ থেকে আগত হাজার হাজার তাবলিগ অনুসারী ঈমানদার মুসল্লি। তারা কোনো রকম দুনিয়াবি লাভের আশা না করে কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য দ্বীনের মেহনত করে ইজতেমা ময়দানকে মুসলিম মহামিলনের জন্য প্রস্তুত করে তোলেন।

বলা চলে তাওহিদের শক্তিতে বলীয়ান হতে প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয় বিশ্ব ইজতেমা। বিশ্ব ইজতেমা তাবলিগ জামাতের সবচেয়ে বড় সম্মেলন। পৃথিবীর বহু দেশ থেকে এ ইজতেমায় মুসল্লিরা অংশগ্রহণ করেন। নানা মাজহাব এবং মত ও পথের মুসলমানরা এখানে হাজিরা দেন। একই সামিয়ানার নিচে অবস্থান করেন। প্রতিবছর শীতকালে ঢাকার অদূরে টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরে এই সমাবেশের আয়োজন করা হয়।

তাবলিগ জামাতের ইতিহাসে এই ধরনের সমাবেশের নজির প্রথম থেকেই রয়েছে। ১৯১০ সালে ভারতবর্ষের বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ মাওলানা ইলিয়াছ রহ. তাবলিগ জামাতের কার্যক্রম শুরু করেন রাজস্থানের মেওয়াত নামক এলাকা থেকে। একইসঙ্গে এলাকাভিত্তিক সম্মেলন বা ইজতেমারও আয়োজন করেন। বাংলাদেশে ১৯৫০ এর দশকে তাবলিগ জামাতের প্রচলন করেন মাওলানা আবদুল আজিজ রহ.। বাংলাদেশে তাবলিগ জামাতের কেন্দ্রীয় মারকাজ বা প্রধান কেন্দ্র কাকরাইল মসজিদ থেকে বিশ্ব ইজতেমা কেন্দ্রীয়ভাবে পরিচালনা করা হয়।

১৯৪৬ সালে প্রথম বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয় কাকরাইল মসজিদে। ১৯৪৮ সালে ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয় চট্টগ্রামের হাজিক্যাম্পে এবং ১৯৫০ সালে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে। ১৯৬৬ সালে টঙ্গীর রেল স্টেশনের পাশে পাগাড়ে অনুষ্ঠিত ইজতেমায় সর্বপ্রথম বাংলাদেশ ছাড়াও বেশ কয়েকটি দেশের মুসল্লি অংশগ্রহণ করেন।

স্থান সংকুলানে সমস্যা হলে পরের বছর অনুষ্ঠিত হয় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পশ্চিম পাশে টঙ্গীর কহরদরিয়া বা তুরাগ নদীর পূর্ব তীরে। তুরাগের পাড়ে ১৬০ একর জায়গায় ১৯৬৭ সাল থেকে বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। স্থান সংকুলান না হওয়ায় ২০১১ সাল থেকে বিশ্ব ইজতেমা দুই পর্বে অনুষ্ঠিত হচ্ছিল।

এক পর্বে দেশের ৩২ জেলা ও অন্য পর্বে বাকি ৩২ জেলার মুসল্লিরা অংশ নিতেন। এতেও স্থান সংকুলান না হওয়ায় তাবলিগের মুরব্বিরা নতুন সিদ্ধান্ত নেন ২০১৩ সাল থেকে ইজতেমা দুই পর্বে হলেও বাংলাদেশের মুসল্লি অংশ নেবেন চার ভাগে। এক বছর দুই পর্বে ৩২ জেলার মুসল্লি অংশ নেবেন, পরের বছর দুই পর্বে বাকি ৩২ জেলার মুসল্লিরা অংশ নিতে পারবেন। অবশ্য এ সময় জেলায় জেলায়ও ইজতেমার আয়োজন করে কর্তৃপক্ষ।

কিন্তু ২০১৮ সালে তাবলিগ জামাতের শীর্ষ মুরব্বি মাওলানা সাদ কান্ধলভীকে কেন্দ্র করে বিতর্ক তৈরি হলে তাবলিগ জামাত দুটি অংশে ভাগ হয়ে যায়। এক অংশ সাদ কান্ধলভীকে তাবলিগের আমির মানলেও অন্য অংশের দাবিÑ তাবলিগ চলবে আলমী শূরার ভিত্তিতে। একক কারও সিদ্ধান্তে নয়।

সর্বশেষ ২০১৯ সাল থেকে বিশ^ ইজতেমা দুই গ্রুপের তত্ত্বাবধানে পৃথকভাবে দুই পর্বে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। অবশ্য গত দুই বছর করোনার কারণে বিশ্ব ইজতেমার আয়োজন স্থগিত ছিল।

সাধারণত তাবলিগ জামাতের অংশগ্রহণকারীরা সর্বনিম্ন তিনদিন আল্লাহর পথে কাটানোর নিয়ত করে থাকেন। সে হিসাবে বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয় তিনদিন ব্যাপী। এই তিন দিনের মধ্যে শুক্রবারকে রাখার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। শুক্রবার ফজর নামাজের আম বয়ান বা উন্মুক্ত বক্তৃতার মাধ্যমে শুরু হয়েছে ইজতেমার আনুষ্ঠানিকতা এবং রোববার আখেরি মোনাজাতের মাধ্যমে শেষ হয় এই জমায়েত।

অনেকে শুধু জুমার নামাজ কিংবা আখেরি মোনাজাতে অংশগ্রহণ করেন। তবে সবচেয়ে বেশি মানুষ অংশগ্রহণ করেন আখেরি মোনাজাতে। সাধারণত সরকার প্রধান, রাষ্ট্রপ্রধান, বিরোধী দলীয় নেতাসহ অন্যান্য নেতা-নেত্রীরা আখেরি মোনাজাতে আলাদা-আলাদাভাবে অংশগ্রহণ করে থাকেন।

বিশ^ ইজতেমা মুসলিম উম্মাহর জন্য শিক্ষণীয় বৈশিষ্ট্যকে লালন করে আসছে। এখানে কোনো মুসলমানকে ছোট করে দেখা হয় না। আল্লাহর কাছে প্রত্যেক মুসলমানের মূল্য আছেÑ এটি ভালোভাবে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয় ইজতেমায়। এক মুসলমান যেন আরেক মুসলমানকে সম্মান করে সে জন্য জোর তাগিদ দেওয়া হয়। কোনো মাজহাবের মুসলমানকে খাটো করা হয় না। বরং সবাইকে ঈমান ও আমলের মেহনতের প্রতি আহ্বান করা হয়।

ইজতেমায় আগত মুসল্লিরা এক প্লেটে খাবার খান, একসঙ্গে ঘুমান। কারও মধ্যে কোনো হিংসা-বিদ্বেষ বা ঘৃণা থাকে না। সাদা-কালোর পার্থক্য থাকে না। সবার মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ থাকে। সম্প্রতি থাকে। আখেরি মুনাজাতে দেশ, জাতি ও বিশ^ মুসলিম উম্মাহর শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনা করা হয়।

লেখক : সিনিয়র সাব-এডিটর, দৈনিক সময়ের আলো
সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ইসলামি লেখক ফোরাম


সম্পর্কিত খবর