রবিবার, ১৯ মে ২০২৪ ।। ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ ।। ১১ জিলকদ ১৪৪৫


ইতিহাসের পাতা: সম্রাট জাহাঙ্গীরের জীবন থেকে

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

সালাহউদ্দীন জাহাঙ্গীর: সম্রাট জাহাঙ্গীর যখন ১৫৮১ সালে প্রথম বিয়ে করেন, তখন তার বয়স মাত্র ১২ বছর। তিনি বিয়ে করেন তার মামাতো বোন শাহ বেগমকে, যিনি মান বাই নামেও পরিচিত ছিলেন, হিন্দু ধর্মাবলম্বী; তার বয়স তখন ১১।

শাহ বেগমের বাবার নাম রাজা ভগওয়ান্ত দাস এবং তার ভাইয়ের নাম আপনারা শুনে থাকবেন-মান সিং। বাংলায় মুঘল সালাতানাতের বিরুদ্ধে বারো ভূঁইয়ার বিদ্রোহ দমনে মান সিং বিশেষ ভূমিকা পালন করেন এবং ঈসা খাঁর সঙ্গে তার যুদ্ধকাহিনি বেশ বিখ্যাত আমাদের পাঠ্যপুস্তকে।
মান বাই উরফে শাহ বেগম ১৬০৫ সালে সুসাইড করেন, জাহাঙ্গীর সম্রাট হওয়ার ঠিক এক বছর আগে।

শাহজাদা জাহাঙ্গীর-এর নারীঘটিত নানা কেলেঙ্কারির দরুণ তিনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন। অন্যদিকে তার ছেলে খসরু মির্জাও বাবা হিসেবে জাহাঙ্গীরকে মোটেও সম্মান করতো না। এসব নানা মানসিক কষ্ট নিয়ে ৩৫ বছর বয়সে তিনি অতিরিক্ত আফিম সেবন করে সুসাইড করেন।

‘প্রেমিক’ জাহাঙ্গীর-এর নামের সঙ্গে যে দুই নারীর নাম অবিচ্ছেদ্যভাবে চলে আসে, তারা দুজন হলেন আনারকলি ও নুরজাহান। অনেকে নুরজাহানকেই আনারকলি হিসেবে ভুল করে থাকেন। মূলত তারা দুজন ছিলেন আলাদা দুই নারী এবং দুজনের প্রেমকাহিনিও আলাদা।
আনারকলি কে ছিলেন, এ নিয়ে বিস্তর দ্বিধাদ্বন্দ্ব রয়েছে ইতিহাসে।

কেউ আবার আগ বাড়িয়ে বলেছেন, আনারকলি নামে কেউ ছিলই না কখনো। এটা মূলত একটি বাগানের নাম, যেটি জাহাঙ্গীর তার অপর স্ত্রী সাহিব-ই-জামালের সমাধিসৌধের পাশে তৈরি করেছিলেন। এ বাগানে আনার তথা ডালিম গাছের আধিক্য ছিল বলে এ সমাধিসৌধকেই আনারকলি নামে ডাকা হয়।

জনপ্রিয় ইতিহাস হিসেবে যেটি প্রচলিত: আনারকলির মূল নাম ছিল নাদিরা বেগম অথবা শরফুন্নিসা। তিনি জাহাঙ্গীর-এর বাবা সম্রাট আকবরের হেরেমের একজন নর্তকী বা বিনোদিনী ছিলেন।

শাহজাদা জাহাঙ্গীর এই নর্তকীর প্রেমে পড়েন এবং দুজনে গভীর প্রণয়ে জড়িয়ে পড়েন। তখন অবশ্য মুঘল হেরেমে একটা নিয়ম ছিল, প্রত্যেকজন রাজকীয় পুরুষের আলাদা আলাদা হেরেম ছিল। তারা নিজেদের মতো হেরেমে সুন্দরী মেয়ে দিয়ে ভরপুর রাখতো। একজন রাজকীয় পুরুষ অন্য পুরুষের হেরেমের ত্রিসীমানায় কখনো ঘেঁষতে পারবে না।

হোক সে সম্রাট বা শাহজাদা। কিন্তু বদবখত জাহাঙ্গীর-এর সঙ্গে তার বাপ আকবর-এর বেশ ভালো রকম ঝগড়া চলছিল দীর্ঘ সময় থেকে। এ জন্য সে সুযোগ পেলেই নানাভাবে তার বাপকে অপমানিত ও অসম্মানিত করতে দ্বিধা করতো না। আনারকলি নামের সেই বিনোদিনীর প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার এটাও অন্যতম কারণ।

কোনো কোনো ইউরোপীয় ঐতিহাসিক অবশ্য বলেছেন, আনারকালি ছিলেন মূলত রাশিয়ান এক উদ্ভিন্ন সুন্দরী অষ্টাদশী। যাকে কোনো এক পর্তুগিজ বা ইংরেজ ব্যবসায়ী সম্রাট আকবরের জন্য উপহার স্বরূপ নিয়ে এসেছিল।

যাই হোক, আকবরের হেরেমের নারী জাহাঙ্গীর-এর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে, এমন সংবাদে ক্ষোভে ফেটে পড়েন সম্রাট। তিনি জাহাঙ্গীরকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়ার জন্য গ্রেপ্তার করেন আনারকলিকে এবং তাকে একটি অন্ধকূপে বন্দী করে রাখেন। অন্ধকূপ বলতে এমন এক কারাগার যেখানে কোনো আলো বাতাস নেই, বদ্ধ বন্দীশালা, পুরো সাউন্ডপ্রুফ। সেখানে কেনো প্রকার খাবার-পানীয় ছাড়া তাকে আবদ্ধ করে রাখা হয় এবং সেখানেই তার মৃত্যু হয়।

লোকগাথা অনুযায়ী এ ঘটনা ১৫৯৯ সালের দিকে। আনারকলির এমন মর্মন্তুদ মৃত্যুসংবাদে শাহজাদা জাহাঙ্গীর ভেঙে পড়েন। শুধু তাই নয়, তিনি মজনুর মতো পাগলপ্রায় হয়ে যান। তিনি সম্রাট হওয়ার পর লাহোরে আনারকলির নামে দৃষ্টিনন্দন একটি সমাধিসৌধ নির্মাণ করেন এবং

সমাধিগাত্রে লিখেন এক ছত্র শের:
Could I behold the face of my beloved once more,
I would thank God until the day of resurrection.
যদি আর একটি বারের জন্য দেখতে পেতাম মম প্রিয়তমার অনিন্দ্য মুখ
পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত পড়ে থাকতাম খোদার কৃতজ্ঞতায়
এই পঙক্তির নিচে জাহাঙ্গীর নিজের নাম লিখেছিলেন: মাজনুন সেলিম আকবর

জাহাঙ্গীর-এর প্রেমকাহিনির এখানেই শেষ নয়। কয়েক বছর পর তিনি আবার প্রেমে পড়েন মেহেরুন্নিসা, মানের আমাদের সম্রাজ্ঞী নুরজাহানের। নুরজাহান তখন বিবাহিত এবং এক কন্যাসন্তানের জননী।

আর আমাদের সম্রাটের তো স্ত্রীর ইয়ত্তা নেই। তবু প্রেমের টানে সকল কিছুই ছিল তাদের কাছে তুচ্ছ। ১০২০ হিজরির ১২ রবিউল আউয়াল মোতাবেক ২৫ মে ১৬১১ সালে তারা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। এ সময় সম্রাট জাহাঙ্গীর-এর বয়স ছিল ৪২ এবং নুরজাহানের বয়স ছিল ৩৪।
এ গল্প আরেকদিন বলা যাবে।

জাহাঙ্গীর-এর মা ছিলেন মরিয়ম-উজ-জামানি। এটি তার মুসলিম নাম। আদিতে তিনি হিন্দু ছিলেন, যোধা বাই নামেই তিনি পরিচিত। জাহাঙ্গীর-এর বাবা সম্রাট আকবর ১৫৬২ সালে তাকে বিয়ে করেন। বিয়ের দুই বছর পর তিনি হাসান ও হোসাইন নামে দুজন জময শিশুর জন্ম দেন। কিন্তু দুঃজনকভাবে জন্মের কয়েকদিন পরই যোধা বাইয়ের এ জময সন্তান মারা যায়।

এর কয়েক বছর পর তিনি আবার গর্ভবতী হলে সম্রাট আকবর যোধা বাইকে আগ্রার বিখ্যাত দরবেশ সেলিম চিশতির দরবারে নিয়ে যান আশীর্বাদের জন্য। সেলিম চিশতি যোধা বাইয়ের অনাগত সন্তানের সুস্থতা ও সফলতার জন্য আশীর্বাদ করেন।

যোধা বাই হিন্দু ধর্মাবলম্বী ছিলেন এবং তিনি কখনো ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলিম হননি। ১৫৬৯ সালের ৩০ আগস্ট যোধা বাইয়ের কোলজুড়ে ভূমিষ্ঠ হয় এক পুত্রসন্তান। সম্রাট আকবর তার পূজনীয় দরবেশ সেলিম চিশতির সম্মারার্থে সন্তানের নাম রাখেন সেলিম। সেই সেলিমই পরবর্তীতে সম্রাট জাহাঙ্গীর নামে ইতিহাসে অমর হয়ে আছে।

-এটি


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ