রবিবার, ১৯ মে ২০২৪ ।। ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ ।। ১১ জিলকদ ১৪৪৫


ফাতেমীদের পাঠাগার ব্যবস্থা

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

।। আবু সাঈদ ।।

ফাতেমীদের মাকতাবার বিশালতা নিয়ে প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ইবনে আবী শামা রাওযাতাইন ফি আখবারিদ দাওলাতাইন গ্রন্থে উল্লেখ করেন, এটা ছিল তৎকালের ‘সপ্তাশ্চর্যের’ একটি। কথিত আছে, কায়রোর রাজপ্রাসাদে (ফাতেমীদের রাষ্ট্রীয় ভবনে) এত বিশাল মাকতাবা ছিল যে, তৎকালে এর কোন নজির ছিলনা। এই মাকতাবার অনন্য বৈশিষ্ট্য ছিল নুসখার আধিক্য। একেকটা কিতাবের শতাধিক নুসখাও মজুদ ছিল। কথিত আছে, এক তাফসীরে তাবারীর‌ই বারোশো নুসখা ছিল। নুসখার আধিক্যের মতো মূল গ্রন্থের সংখ্যাও অনেক ছিল।

সুলতানদের বইয়ের রাজ্য
এতো গেলো খলিফাদের কিতাব সংগ্রহের সৌখিনতা। সুলতানরা কি তবে পিছিয়ে ছিলেন? সালতানাত টিকিয়ে রাখার জন্য তাদেরও তো প্রয়োজন ছিল আলেমদের সমর্থন। ইতিহাস বলে, এজন্য সাধ্যের সবটুকু উজাড় করে সুলতানরাও মাকতাবা গড়ে তুলতেন। সমাহার ঘটাতেন বিপুল সংখ্যক রচনাবলীর। নিজে শরয়ী বিষয়ে পরিপুষ্ট হতেন। আলেমদের‌ও কাছে ডাকতেন। বিভিন্ন বিষয়ে রচনার প্রতি উদ্বুদ্ধ করতেন। প্রয়োজনীয় কিতাবাদি সরবরাহ করতেন। সুলতানি মাকতাবার কিছু নমুনা তবে পেশ করা যাক।

কয়েকটি সুলতানি মাকতাবা
এক. প্রখ্যাত ঐতিহাসিক সাফদি নুকাতুল হামায়ান গ্রন্থে উল্লেখ করেন, লেবাননের ত্রিপোলি শহরে তখন বনু আম্মার আলকাত্তানীর সুলতানগণ শাসন করতেন। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে গুরুত্বপূর্ণ কিতাবাদি সংগ্রহ করে সেখানে তারা গড়ে তুলেছিলেন এক বিশাল মাকতাবা। তারা ফাতেমী সালতানাতের অধীনতা স্বীকার করতেন।

দুই. প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ইবনে আবী উসাইবিয়া উয়ূনুল আমবা গ্রন্থে বলেন, জগৎ বিখ্যাত চিকিৎসা বিজ্ঞানী ইবনে সিনা বোখারার অধিপতি সুলতান নুহ ইবনে মানসুর আস-সামানীর মাকতাবা সম্পর্কে বলেন, সুলতান একবার ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার ব্যক্তিগত ডাক্তার চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছে। সর্বত্র সুখ্যাতি থাকায় সভাসদরা আমাকে ডাকে। আমি গিয়ে সুলতানের চিকিৎসা কাজে অংশগ্রহণ করি। কিছুদিন সুলতানের চিকিৎসার নিবিড় তত্ত্বাবধান দরকার ছিল। সে সুবাদে রাজপ্রাসাদে আমি থেকে যাই। রাজপ্রাসাদের মাকতাবার সুখ্যাতি ছিল দশদিক। তাই মাকতাবা পরিদর্শন ও কিছু সময় অধ্যয়নের অনুমতি গ্রহণ করি। মাকতাবাটি ছিল বিশাল, সুবিন্যস্ত ও বহু কক্ষবিশিষ্ট। প্রত্যেকটি কক্ষে ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ের কিতাবাদি রাখা হয়েছে। সুদৃশ্য আলমারিতে অত্যন্ত মনোরমভাবে কিতাবগুলো সাজিয়ে রাখা হয়েছে। বিভিন্ন কক্ষ পরিদর্শন করে আমি ইতিহাসের কক্ষে প্রবেশ করলাম। কিতাবের তালিকায় এমন অনেক কিতাবের নাম দেখলাম, যার নাম অনেক মানুষই জানেনা। এমনও কিছু কিতাব দেখতে পেলাম, যা সেখানে জীবনের প্রথম ও শেষ বারের মত‌ই দেখেছিলাম।

তিন. নূহ সামানীর সমকালীন সুলতান ছিলেন আযদুদ্দীন আল-বায়ুহি। তিনিও গড়ে তুলেছিলেন জ্ঞান-বিজ্ঞানের বহু গুরুত্বপূর্ণ কিতাবাদি সমৃদ্ধ এক বিশাল গ্রন্থালয়। এই মাকতাবা সম্পর্কে প্রখ্যাত ঐতিহাসিক মাকদাসি আহসানুত তাকাসীম গ্রন্থে বলেন,আযদুদ্দাওলা সিরাজে এক বিশাল গ্রন্থালয় প্রতিষ্ঠা করেন। পৃথিবীর কোথাও এত বিশাল মাকতাবা আমার চোখে পড়েনি। তাতে ৩৬০ টি কক্ষ রয়েছে। প্রতিটি কক্ষের বিষয় ছিল ভিন্ন। প্রত্যেক কক্ষের জন্য ছিলেন আলাদা পরিচালক, তত্ত্বাবধায়ক ও কিতাব সংগ্রহকারী। যেন একেকটি কক্ষ একেকটি মাকতাবা। এতে নিয়োগ দেওয়া হতো সময়ের সেরা ব্যক্তিবর্গকে। ন্যায়পরায়ণতা ও তাকওয়ার পরীক্ষায় তারা হতেন শতভাগ উত্তীর্ণ। কিতাব সংগ্রহের জন্য তাদেরকে পৃথিবীর দিক দিগন্তে পাঠিয়ে দেওয়া হত। তারা অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে কিতাব সংগ্রহের চেষ্টা করতেন। ফলে সেসময় পর্যন্ত রচিত সকল কিতাব সংগ্রহ করা সম্ভব হয়ে ওঠেছিল।

সভাসদদের বইয়ের রাজ্য
খলিফা ও সুলতানদের দ্বারা তাদের সভাসদবৃন্দ‌ও প্রভাবিত হয়েছিলেন। তারাও গড়ে তুলেছিলেন খ্যাতনামা বহু মাকতাবা। সেসবের আলোচনাও স্থান পেয়েছে ইতিহাসের পাতায়। তাদেরও কিছু নমুনা পরিবেশন করা হলো।

এক. বায়ুহি সালতানাতের মন্ত্রীপ্রধান ফজল ইবনে আমিদ গড়ে তুলেছিলেন বিশাল এক কিতাবকানন। এর পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন বিশিষ্ট দার্শনিক মাস্কুয়াহ। তিনি তার অমর গ্রন্থ তাজারিবুল উমামে এই মাকতাবা সম্পর্কে বলেন, খোরাসানের বাহিনী যখন বায়ুহী সালতানাত দখল করে সর্বত্র লুটতরাজ আর ধ্বংসযজ্ঞের রাজত্ব কায়েম করে, লুটতরাজ থেকে বাদ পড়েনি মন্ত্রী-প্রধানের বাড়িও। তারা ঘোড়ার আস্তাবল, ধন-সম্পদ ও অন্যান্য বিষয়-আশয় লুণ্ঠন করে। কিন্তু মাকতাবার প্রতি কোনো অবিচার করেনি। এ সময় আমি লক্ষ্য করেছি, মন্ত্রীপ্রধান সবচেয়ে বেশি চিন্তিত ছিলেন তার এ মাকতাবা নিয়ে। তার কাছে পৃথিবীর সবচাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল এই মাকতাবা। এতে এতপরিমাণ কিতাব ছিল যে, শতাধিক উট বোঝাই করা হলেও তা শেষ হবে না। দর্শন ও পদার্থবিজ্ঞানের বিশাল সম্ভার ছিল এতে।

দুই. বায়ুহি মন্ত্রী সাহেব ইবনুল ঈমাদের‌ও ছিল বিপুল সংখ্যক কিতাবের সমাহার। ঐতিহাসিক ইয়াকুত হামাবি তার অমর কীর্তি মু’জামুল উদাবাতে এ গ্রন্থাগারের মূল্যায়নে ইবনুল ঈমাদের‌ই একটি উক্তি উল্লেখ করেছেন। ইবনুল ঈমাদ বলেন, আমার এই বইবাড়িতে দুই লক্ষ ছয় হাজার বই আছে।

অতঃপর ইয়াকুত হামাবি বলেন, একবার নূহ সামানী গোয়েন্দা মারফত ইবনুল ঈমাদকে প্রস্তাব করেন, আপনি আমার সালতানাতে চলে আসেন। আপনাকে যথাযথ মূল্যায়ন করা হবে। ইবনুল ঈমাদ সে প্রস্তাব এ বলে প্রত্যাখ্যান করেন যে, আমি এমন সম্প্রদায়কে কিভাবে বিদায় জানাব, যাদের অবদানে গড়ে উঠেছে আমার ভীষণ জনপ্রিয়তা। উন্নীত হয়েছি আমি এই মহা মর্যাদায়। আমার রয়েছে বিশাল কিতাবকানন। চার শতাধিক উটও তা বহন করে শেষ করতে পারবে না। অন্যান্য বিষয়াদি তো আছেই। তবে বলুন আমি আপনার সালতানাতে কিভাবে গমন করি!

ইয়াকুত হামাবী রাই শহরের একটি বিরল মাখতুতার (হাতে লেখা পান্ডুলিপি) আলোচনা করতে গিয়ে বলেন, এক ইতিহাসবিদ লিখেছেন, এ কিতাবটি তিনি ইবনুল ঈমাদের ওয়াকফকৃত মাকতাবায় দেখেছিলেন। হয়তো আমাদের এই আলোচিত মাকতাবাই সেই মাকতাবা, যার কথা সেই ঐতিহাসিক’ লিখেছেন।

কেএল/


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ