রবিবার, ১৯ মে ২০২৪ ।। ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ ।। ১১ জিলকদ ১৪৪৫


মানব সেবায় আলেমদের ভূমিকা

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

আব্দুর রউফ আশরাফ: মানুষ সামাজিক জীব। মানুষ একাকী থাকতে পারে না। সমাজবদ্ধ হয়ে থাকতে হয় মানুষকে। পৃথিবী সূচনালগ্ন থেকে মানুষ তার সঙ্গী সাথী নিয়ে থাকার উপায় খুঁজেছিল। আদম (আ.)-কে প্রথম মানব হিসেবে সৃষ্টি করার পর হাওয়া (আ.)-কেও সৃষ্টি করা হয়েছিল, যাতে আদমকে নিঃসঙ্গ হয়ে থাকতে না হয়। এরপর ধীরেধীরে আদম আ.-হাওয়া আ. থেকে বংশ বিস্তার হয়। এখান থেকে শুরু হয় সমাজ ও সামাজিকতা। কালের পরিবর্তনে সমাজের সামাজিকতা ঘূণে ধরে।

ইসলামপূর্ব সময়ে মক্কায় চরম বিশৃঙ্খলা ও বিপর্যয় বিরাজ করছিল। ন্যায়বিচার, নিরাপত্তা, ভ্রাতৃত্ববোধ, সৌহার্দ্য-ভালোবাসা, পারস্পরিক সহযোগিতাসহ মানবিকতা হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম ছিল।

অতঃপর ইসলাম এসে সমাজকে নতুনভাবে সাজাতে থাকে। ইসলামের সুশীতল ছায়ায় এসে মানুষ পরিণত হয় সোনার মানুষে। তাই সমাজচ্যুত কেউ ইসলামের মৌলিক আদর্শ লালন করতে পারে না। সবাইকে নিয়ে বসবাস করা এবং সংঘবদ্ধ হয়ে সুষ্ঠু-সুশৃঙ্খল জীবন যাপন করাই ইসলামের মূল চাহিদা। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর তোমরা সবাই মিলে আল্লাহর রজ্জুকে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরো, বিচ্ছিন্ন হয়ো না, তোমাদের ওপর আল্লাহর অনুগ্রহের কথা স্মরণ করো যখন তোমরা ছিলে পরস্পর শত্রুভাবাপন্ন, অতঃপর তিনি তোমাদের অন্তর এক করেছেন এবং তোমরা তাঁর অনুগ্রহে পরস্পর ভাই ভাই হয়েছ।’

গোষ্ঠীবদ্ধভাবে থাকা মানুষের একটি সহজাত চাহিদা। চাইলেও কেউ একাকী থাকতে পারে না। তাই পারস্পরিক সহযোগিতা ও ভালোবাসা থাকলে মানুষের জীবন সত্যিকারভাবেই সুন্দর হয়। মানুষের মাঝে নানা গোষ্ঠী ও সমাজ থাকবে। সেখানেই মানুষ বসবাস করবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে মানুষ, আমি তোমাদের পুরুষ ও নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদের অনেক জাতি ও গোষ্ঠীতে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা একে অপরকে চিনতে পারো, তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সেই ব্যক্তি সবচেয়ে সম্মানিত যে তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক খোদাভীরু, আল্লাহ তায়ালা সর্বজ্ঞাত ও সর্ববিষয়ে অবগত।’

মানুষকে পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে হলে নানাজনের সঙ্গে মিলেমিশে থাকতে হয়। পরিবারের সদস্য ছাড়াও সমাজের মানুষদের নিয়ে থাকতে হয় । জীবনযাত্রায় পাড়া প্রতিবেশি ও সমাজের মানুষদের অনেক অধিকার আছে। সমাজের মানুষের বিপদ-আপদ ও কঠিন মুহূর্তে সাধ্যমতো পাশে থাকা আমাদের কর্তব্য। একে অপরের প্রতি যে কিছু হক রয়েছে তাদের মধ্যে সমাজের মানুষের প্রতি হকটা ভিন্ন। আপদে-বিপদে,সুখেদুঃখে পাশে থাকা।

নিশ্চয়ই মানুষের মধ্যে আলেমরাই আল্লাহকে ভয় করে।’ আল্লাহর ভয়ে যারা ভীত তারা স্বভাবতই নিজেরা ভালো থাকে এবং অন্যের জন্যও ক্ষতিকর হতে পারে না। কারণ স্বাভাবিকভাবে একজন ভীত মানুষ নিজের নিরাপত্তা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। ইসলাম এমন এক সার্বজনীন কল্যাণব্যবস্থা যা গঠিত হয়েছে আল্লাহর ভয়ে ভীত জনগণ নিয়ে। আবার এটাও স্বাভাবিক, যে ব্যক্তি আল্লাহতে ভীত সে অপর কোনো কিছুতে ভীত নয়। মানবজাতির কল্যাণের যত পর্যায় রয়েছে তার সবকটি ইসলামে বিদ্যমান। আর এসব কর্মসূচি কেবল আলেমের মাধ্যমেই আবহমানকাল ধরে মানব সমাজে লালন-পালন হয়ে আসছে। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে ছায়াদার বৃক্ষের ন্যায় আলেমরা বিনামূল্যে মানুষকে নৈতিক ও ধর্মশিক্ষা।

দ্বীন প্রচারের পাশাপাশি সামাজিকভাবেও সেবামূলক বহুমুখী খেদমত করে যাচ্ছেন আলেম সমাজ। সম্প্রতি করোনাকালীন সময়ে যখন করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া রোগীর লাশ দাফনের জন্য কেউ এগিয়ে আসতো না, লাশ ফেলে রেখে আত্মীয়- স্বজনরা পালিয়ে যেতো তখন উলামায়ে কেরাম করোনায় মৃতদের লাশ দাফন কাফনের মতো বিশাল সেবামূলক কাজ করেছেন। নোভেল করোনা ভাইরাসের নাজুক পরিস্থিতিতে উলামায়ে কেরাম না থাকলে করোনায় আক্রান্ত মৃতদের লাশ কুকুর শেয়ালে ছিঁড়ে ফেড়ে খেতো। এই কঠিন দূর্যোগে উলামায়ে কেরামের ভূমিকা অবিস্মরণীয়।

অপরদিকে মাসের মাস টানা লকডাউনে নিম্নআয়ের ঘরবন্দি মানুষের খাদ্য সঙ্কটে যখন নিরন্ন মানুষের মুখে দু’বেলা খাদ্য তুলে দেবার লড়াই চলছিল। ভুলুণ্ঠিত মানবতাকে বাঁচিয়ে রাখার লড়াইয়ে হাঁপিয়ে গিয়েছিল সাধারণ জনগন। এমন এক কঠিন মুহূর্তে একশ্রেণির মানুষ যখন খাদ্যের অন্বেষণে জীবন সংহার হতে পারে জেনেও লকডাউন উপেক্ষা করে ত্রাণের জন্য ঘর ছেড়ে রাস্তায় নামছিল। তখন আরেক শ্রেণির মানুষ(!) গরিবের ত্রাণের চাল চুরিতে ব্যস্ত। এরা কোথাও কোথাও ক্ষমতার দাপটে আবার কোথাও কোথাও ক্ষমতাসীন দলের পরিচয়ে ত্রাণ লোপাট করছিল। মানবতা বিবর্জিত কিছু মানুষের ত্রাণ চুরির ঘটনায় গোটা জাতি অবাক ছিল।

করোনায় কে বাচঁবে কে মরবে তা আমরা কেউ জানি না। কিন্তু মানবতা, নৈতিকতা ও কল্যাণবোধ থেকে লাশ দাফন, লাশের সৎকার, নিরন্ন মানুষের মুখে খাবার তুলে দেওয়া থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে কওমি মাদরাসার আলেম-উলামা ও ছাত্র-শিক্ষকরা। বৈশ্বিক মহামারীর করোনা পরিস্থিতিতে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক দল, সংস্থা ও অনেক মানবহিতৈষী যার যার জায়গা থেকে এগিয়ে এসেছেন। কিন্তু আলেমরা এগিয়ে এসেছেন সম্পূর্ণ নিজ উদ্যোগে। তাদের সেবাগুলো মানুষের বিবেককে নাড়িয়ে দিয়েছে।

অবাক করার মতো বিষয় হলো- আলেমদের নেতৃত্বাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর সেবা বিতরণের ক্ষেত্রে সেবাগ্রহীতার মান-মর্যাদা ও সৌজন্যতার নানামাত্রিক দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে। সেবাগ্রহীতার ছবি প্রচার থেকে নির্মোহ থেকে সঙ্কটগ্রস্ত মানুষকে খাবারের প্যাকেজ পৌঁছে দেওয়া, বাড়ির সামনে গোপনে খাবার রেখে আসা, যাচনাবিমুখ অভাবগ্রস্ত ভদ্র মানুষজনের মাঝে গোপনে নগদ অর্থ পৌঁছে দেওয়া, রান্না করা খাবার ও ইফতার বিভিন্ন জায়গায় পৌঁছে দেওয়া, স্বাস্থ্য সুরক্ষার সরঞ্জাম এবং স্যানিটাইজারসহ প্রয়োজনীয় দ্রব্য বিভিন্ন পরিবারের হাতে তুলে দিয়েছেন আলেম সমাজ। এমনকি লাশ দাফনের ক্ষেত্রে মৃতের পরিবারের মান-মর্যাদা রক্ষায় সবোর্চ্চ গোপনীয়তা অবলম্বন করা হয়েছে। এখনও পথে-ঘাটে জীবাণুনাশক ছিটানো এবং করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণকারী মানুষজনের জানাজা ও দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করাসহ ঈদকে সামনে রেখে বিভিন্ন সেবা অব্যাহত রেখেছেন।

ডেঙ্গু মশা প্রতিরোধে মাদ্রাসার ছাত্র ও আলেম সমাজ যে পরিমাণে পরিস্কার-পরিছন্নতার কাজ করেছেন তা বলাবাহুল্য। গ্রামে-গঞ্জে শহরের মোড়ে আবর্জনামুক্ত রাখতে ভিবিন্ন কীটনাশক স্পে মেরে ডেঙ্গু প্রতিরোধে ভূমিকা রেখেছেন। বন্যাকালীন দূর্যোগে উলামায়ে কেরামের ভূমিকা প্রশংসনীয় ছিল। বন্যার্ত মানুষের ঘরেঘরে বিশুদ্ধ পানি খাদ্যাদি ঔষধপত্রসহ যাবতীয় জিনিসপত্র নিজ উদ্যোগে পৌঁছে দিয়ে মানবিকতা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে আলেম সমাজ।

বন্যাকালীন সময়ে আলেমদের ভূমিকা ছিল উদাহরণীয়। কোটি কোটি টাকার অর্থদান করে মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে বিশ্বের সানইবোর্ড ওয়ালা মানবদিকার কর্মী নেতাকর্মীদের দেখিয়ে দিয়েছেন মানুষ মানুষের জন্যে। সেবার জন্যে মোটা অংকের টাকা প্রয়োজন হয় না। পরিশুদ্ধ মনমানসিকতা থাকলে সবাই ঐক্যবদ্ধ হলে সমাজ ও সামাজিকতা এগিয়ে যাবে।

এছাড়াও সমাজসেবামূলক বহু কাজে উলামায়ে কেরাম সম্পৃক্ত আছেন। কোনো দিক থেকেই উলামায়ে কেরামকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। হক্কানি উলামায়ে কেরামের দ্বীনী দাওয়াত, ওয়াজ ও নসীহতের ফলে দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা হচ্ছে। উলামায়ে কেরাম দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষার অতন্দ্র প্রহরী। আজ যারা নানাভাবে উলামায়ে কেরামের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করছে, বিষোদগার করছে এবং মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানির শিকার করছে, তাদের ব্যাপারে সরকার, প্রশাসন সহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের জরুরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা সময়ের অপরিহার্য দাবী।

লেখক: শিক্ষক, জামিয়া মাদানিয়া ইসলামিয়া হলদারপুর, হবিগঞ্জ।


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ