রবিবার, ১৯ মে ২০২৪ ।। ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ ।। ১১ জিলকদ ১৪৪৫


বিশ্বজয়ী হাফেজরা ভালো আলেম হচ্ছে না কেনো?

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

।।কাউসার লাবীব।।

দীর্ঘ একটা সময় ধরে আমাদের দেশের হাফেজে কোরআনরা মেধার স্বাক্ষর রাখছে বিশ্বময়। লাল-সবুজের পতাকাকে তারা আলোকিত করছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। তাদের এমন প্রতিভায় জাতি মুগ্ধ। তবে কিছুটা বিষণ্ন। বিশ্বজয় করা প্রতিভাবান এই হাফেজরা কেন যোগ্য, মুহাক্কিক ও ভালো হয়ে গড়ে উঠছে না? এ প্রশ্ন অনেকের মনে।

এর উত্তর খুঁজতে আমরা দ্বারস্থ হয়েছিলাম রাজধানীর মারকাজুল লুগাতিল আরাবিয়্যার প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক মাওলানা মহিউদ্দীন ফারুকীর। মদিনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমফিল করা এ আলেম বলছেন, আমাদের দেশের কোরআনের হাফেজরা বিশ্বব্যাপী বড় বড় প্রতিযোগিতায় ভালো ফলাফল করছে। এমনকি বিশ্বের মধ্যে প্রথম হয়েও প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছে। এটি আমাদের জন্য খুবই পজেটিভ একটি অধ্যায়। তবে এর সঙ্গে যদি আরেকটি বিষয় যুক্ত হতো তাহলে আরো সুন্দর হত। সেটি হলো তার মেধাকে কাজে লাগিয়ে সে যদি একজন মুহাক্কিক ও ভালো আলেম হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করতে পারত। কিন্তু দুঃখের বিষয় এটি হয়ে উঠছে না

এর পেছনে কী কারণ নিহিত? জানতে চাইলে বলেন তিনি বলেন, অন্যতম একটি কারণ হলো, খ্যাতির মোহ। অল্প বয়সে তারা যখন দেখে তাদের জনপ্রিয়তা এবং খ্যাতি তুঙ্গে। তখন তারা অল্প বয়সী হওয়ার কারণে অনেক সময় এই বিষয়টিকে  সঠিকভাবে নিতে পারে না। আর এটিই কাল হয়ে দাঁড়ায়।

‘তাছাড়া সে যেহেতু ছোট মানুষ, নিজেকে ভবিষ্যতের জন্য যোগ্য করে গড়ে তোলার জন্য তার সঠিক কাউন্সেলিং দরকার। তাকে বোঝানো দরকার যে আগামীর ভবিষ্যৎ তোমাদের মত প্রতিভাবানদের হাতে। কিন্তু এটি করা হয় না। এই প্রতিভাবানদের আশপাশে যারা থাকেন তাদের মাঝে অনেকেই তাকে দিয়ে বিভিন্নভাবে বাণিজ্য করার একটি সুযোগ খোঁজে। অনেক সময় দেখা যায় প্রতিষ্ঠানে ভর্তি বিজ্ঞপ্তি থেকে নিয়ে প্রায় সব জায়গাতেই ওই প্রতিভাবান শিশুটিকে ব্যবহার করে থাকে’- বলেন মাওলানা মহিউদ্দীন ফারুকী।

তার মতে এসব কারণে আমরা বিশ্বজয়ী হাফেজ পেলেও, সে যে নিজের প্রতিভাকে কাজে লাগিয়ে শায়খ আবদুর রহমান আস-সুদাইস, শায়খ আব্দুর রহমান আল-কাসেম, শায়খ আব্দুর রহমান আল হুজাইফি, শায়খ ড. জুহানীদের মতো ভালো হাফেজ ও ক্বারী হওয়ার পাশাপাশি ভালো আলেম হবে তা হচ্ছে না।

ভিন্ন একটি কারণ উল্লেখ করেন সোনারগাঁও মাদরাসাতুশ শরফ আল ইসলামিয়ার প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক মাওলানা উবায়দুল কাদের নদভী কাসেমী। ভালো আলেম তৈরি না হওয়ার বিষয়ে তিনি দায়ী করছেন এসব হাফেজে কোরআনদের শিক্ষকদের সচেতনতা ও বিচক্ষণতার কমতিকে। পাশাপাশি তিনি বলছেন, আমাদের দেশের আলেমদের মধ্যে মোতালাআ ও জাগতিক বিষয়ে গভীরতা দিন দিন কমে আসছে।

সময়ের প্রয়োজনে নিজেদেরকে কীভাবে উপস্থাপন করতে হবে সে বিষয়ে উদাসিনতাকেও দায়ী করছেন গবেষক এ আলেম।

এদিকে উল্লিখিত বিষয়গুলোর সঙ্গে কিছু কথা যুক্ত করেন কক্সবাজারের রাজারকুল আজিজুল উলুম মাদরাসার মোহতামীম মাওলানা মোহছেন শরীফ

তার মতে, আমাদের দেশের প্রতিভাবান ছেলেরা যেভাবে বিশ্বজয়ী হাফেজ এবং বিশ্বজয়ী ক্বারী হচ্ছে, আমরা চাই তারা বিশ্বজয়ী আলেম হিসেবেও নিজেদেরকে সমাজের সামনে উপস্থাপন করতে পারুক। কিন্তু এসব শিশুদেরকে যারা গাইড করছেন, যেমন তাদের অভিভাবক এবং শিক্ষক পক্ষ কিছুটা বাণিজ্যিকরণের পথে হাঁটছে বলে মনে হয়। আমাদের আকাবির ও আসলাফের শিক্ষা ‘প্রতিটি কাজেই খুলুসিয়াতকে প্রাধান্য দেয়া’ সেটি আর থাকছে না।

‘এর ফলে একটি পর্যায়ে ওই বিশ্বজয়ী হাফেজের জীবনটাকে সে বাহ্যিক প্রদর্শনীর জন্য তৈরি করে ফেলছে। নিজেকে যোগ্য, মুহাক্কিক এবং গবেষক আলেম হিসেবে গড়ে তোলার আগ্রহ তার ভেতরে তৈরি হচ্ছে না।  তাই তাকে সঠিকভাবে গাইড করতে হবে’- বলেন মাওলানা মোহছেন শরীফ।

অপরদিকে তাদেরকে কাউন্সিলিং বা সঠিকভাবে গাইড করা বিষয়ে কিছু বিষয় উল্লেখ করে মাওলানা মহিউদ্দীন ফারুকী বলেন, বিশ্বজয়ী হাফেজে কোরআনরা যে নিজেদের প্রতিভা নষ্টের বিপদের মুখোমুখি হচ্ছে এটি তাদেরকে বোঝানোর জন্য কিংবা তাদেরকে কাউন্সেলিং করার জন্য অনেক সময় তরুণ বিচক্ষণ আলেমরা তাদের কাছাকাছি হচ্ছেন না। ইচ্ছে করেই দূরে থাকছেন। এর কারণ হলো, অল্প বয়সে খ্যাতি এবং জনপ্রিয়তার কারণে কিছু কিছু বিশ্বজয়ী হাফেজদের মাঝে একটি আত্মঅহমিকা দেখা যায়। মাঝে মাঝে এই আত্মঅহমিকা বেয়াদবি পর্যন্ত গড়ায়। এটি অনেক সময় তার ইচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায় তার মাঝে তৈরি হয়। আর সচেতন কেউই চাইবে না কারো বেয়াদবির শিকার হতে।

‘সমাজে তৈরি হওয়া এই জটিলতার সমাধান হিসেবে বলা যায় এসব হাফেজদেরকে যারা গড়ে তুলছেন তাদের মনমানসিকতায় আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। তাদেরকে নিজেদের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে এই ছেলের ভবিষ্যৎকে প্রাধান্য দিতে হবে। নিজের সন্তানের মতো করে নি:স্বার্থভাবে তার ভবিষ্যতের কল্যাণ চাইতে হবে’- বলেন মাওলানা মহিউদ্দীন ফারুকী।

তিনি মনে করেন, জাতীয় যে প্রতিষ্ঠানগুলো আছে তারা যদি নিজেদের উদ্যোগে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করে তাহলেও এসব প্রতিভাবান প্রজন্মকে ভালো আলেম হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব।

অপরদিকে প্রতিভাবান বিশ্বজয়ী হাফেজদেরকে সতর্ক করে মাওলানা মোহছেন শরীফ বলেন, নামের সঙ্গে লাগা ‘বিশ্বজয়ী’ শব্দ টা যেন তার জন্য অভিশাপে পরিণত না হয় সে বিষয়ে সর্বোচ্চ সর্তকতা অবলম্বন করতে হবে।

-কেএল


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ