মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১০ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫


‘এই শিক্ষকের কাছে অনেক ঋণ আমার’

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

সাব্বির জাদিদ।।

মাদরাসা-জীবনে যত শিক্ষক পেয়েছি, মুফতি নুরুন্নবী ছিলেন সবার থেকে আলাদা। মাদরাসায় তিনি ছিলেন আমার শ্রেষ্ঠ শিক্ষক।

মাদরাসায় বাংলা বই, ম্যাগাজিন পড়ার কারণে শিক্ষকদের কাছে বহু গালমন্দ শুনেছি। অনেক বই বাজেয়াপ্ত হতে দেখেছি চোখের সামনে। কিন্তু আমার এ ব্যতিক্রম শিক্ষক একাডেমিক পড়াশোনার ফাঁকে আমাকে আউটবই পড়ার সুযোগ দিয়েছিলেন। সাহিত্য সাধনার প্রতি উৎসাহিত করেছিলেন।

পল্লবীর আফতাব উদ্দীন মাদরাসায় ভর্তি হওয়ার সপ্তাখানেকের মাথায় একদিন বাদ ইশা কিতাবের নিচে লুকিয়ে মাসিক রহমত পড়ছিলাম। চুরি করে পড়লেও ধরা পড়ে গিয়েছিলাম হুজুরের হাতে।

তখনো তাকে চিনে উঠতে পারিনি। ফলে, ভেবেছিলাম, এই বুঝি শাস্তি নেমে এল। ভয়ে কাঁপছিলাম ভেতরে ভেতরে। তিনি কতক্ষণ পত্রিকাটা উল্টেপাল্টে দেখে ফেরত দিয়েছিলেন।

ভীষণ অবাক হয়েছিলাম সেদিন। এই প্রথম মাদরাসার কোনো শিক্ষকের হাতে পড়েও আমার বাংলা পত্রিকা ফেরত আসতে দেখেছিলাম।

আমার মাথায় কিলবিলানো লেখালেখির পোকার খবর তিনি অল্প কদিনেই জেনে গেছিলেন। আর তাইতো মাঝে মাঝে আমাকে ডেকে নিতেন নিজের কামরায়। গল্প করতেন। গল্প করতেন ক্লাশেও।

পড়ানোর ফাঁকে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির গল্প করতেন। মাদরাসা লাইনের অগ্রজ লেখক মুহীউদ্দীন খান, ফরীদ উদ্দীন মাসউদ, ইসহাক ফরিদী, ইসহাক ওবায়দী সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতেন। ক্লাশে তার এসব গল্পের প্রধান শ্রোতা ছিলাম আমি। আমার জন্যই তিনি এসব গল্প বলার উদ্দীপনা খুঁজে পেতেন সম্ভবত। তার সঙ্গে বাইরে কোথাও গেলে আমাকে পরিচয় করাতেন 'শাগরেদ' বলে।

একবার মাদকাসক্ত অল্পবয়সী এক চোর এসেছিল মাদরাসার ড্রাম চুরি করতে, যে ড্রামে আমরা ময়লা ফেলতাম। দারোয়ান তাকে পাকড়াও নিয়ে এল হুজুরের কাছে।

আমরা তখন হুজুরের ক্লাশে। কোনো ধমক নয়, বকাঝকা নয়, ক্লাশ থামিয়ে তিনি চোরের উদ্দেশে পাঁচ মিনিট কথা বলেছিলের। এমন বিবেক জাগানিয়া কথা—আমার লোম দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। মনে আছে, বক্তৃতা শেষে তিনি বলেছিলেন, এবার তুমি ড্রামটা নিয়ে যেতে পারো। তোমাকে অনুমতি দিলাম।

বুঝেছিলাম, বইপড়া মানুষ ছাড়া বিবেকে টোকা দেয়া এমন কথা কম মানুষই বলতে পারে। হুজুর বই পড়তেন।
শৈশব থেকেই বিপ্লবী বিপ্লবী ভাব ছিল নিজের মধ্যে। সবকিছুকে প্রথার বাইরে ভিন্নভাবে দেখতে পছন্দ করতাম। মাদরাসা-ব্যবস্থার অনেক ব্যাপার নিয়েও প্রশ্ন জাগত মনে।

অদ্ভুতভাবে খেয়াল করতাম, আমার এই শিক্ষকও জগতকে ভিন্নচোখে দেখেন। কথা বলেন প্রথার বাইরে। সকল বিষয়ে তার চিন্তার সাথে মিলে যেতে থাকে আমার চিন্তা। আর বেড়ে যেতে থাকে তার প্রতি আমার মুগ্ধতা।

তার কাছেই প্রথম জেনেছিলাম হুমায়ুন আজাদের গদ্যের সৌন্দর্য সম্পর্কে। তিনি হুমায়ূন আহমেদের গদ্যের সহজতায় মুগ্ধ ছিলেন। একবার তাঁর নাকে অস্ত্রপচার করতে হয়। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার আগে আমাকে বলে গিয়েছিলেন, অপারেশনের পর আমি যেন হুমায়ূনের কয়েকটা হাসির বই হাসপাতালে দিয়ে আসি। হাসপাতালের নিঃসঙ্গতা দূর করতে তিনি শাগরেদের কাছে হুমায়ূন আহমেদের বই চেয়েছিলেন।

সবাই হাসপাতালে রোগী দেখতে যায় ফলমূল নিয়ে, সেবার আমি গিয়েছিলাম হিমু সিরিজের চারটা বই নিয়ে।
আমার এই শিক্ষকের কাছে অনেক ঋণ আমার। মাদরাসার সাদাকালো দিনগুলোতে তিনি ছিলেন আমার পরম আশ্রয়ের জায়গা। তাঁর কাছে গেলে আমার সকল দুঃখ দূর হয়ে যেত।

তাকে না পেলেও হয়তো আমি একজন লেখকই হতে চাইতাম শেষ পর্যন্ত। কিন্তু বেড়ে ওঠার কালে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস দিয়ে আমার কাজটাকে অনেক সহজ করে দিয়েছিলেন তিনি।

গল্প লেখার কুখ্যাতির কারণে মাদরাসা-জীবনের কোনো শিক্ষকের সাথে আর যোগাযোগ নেই আমার, নুরুন্নবী হুজুর ছাড়া।

শিক্ষক দিবসে শাগরেদ আমি ওস্তাদকে স্মরণ করি।

লেখক: তরুণ লেখক ও কথাসাহিত্যিক

এনটি


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ