রবিবার, ১২ মে ২০২৪ ।। ২৮ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ৪ জিলকদ ১৪৪৫


বিশ বছরের আফগান যুদ্ধের অপেক্ষা এখন ১১ সেপ্টেম্বর

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

আমব্রিন সিকান্দার।।

আমেরিকার নতুন প্রেসিডেন্ট দায়িত্ব গ্রহণ করার পর আফগানিস্তানে সফরের ঘোষণা দেন, কিন্তু পেন্টাগনের  দেওয়া সাম্প্রতিক বিবৃতির পর তার সেই সফর নিয়ে দোলাচল শুরু হয়েছে। কাবুল বিমানবন্দর, পাকিস্তানকে সামরিক ঘাঁটি হস্তান্তর নিয়ে বিরোধের কারণে বর্তমানে এটা বলা যেতে পারে যে, এ বছরের ১১ সেপ্টেম্বর আফগানিস্তান থেকে বিদায় নিচ্ছে আমেরিকা।

২০০১ সালে শুরু হওয়া এই যুদ্ধ গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি মোড় নিয়েছিল। বিস্তারিতভাবে এগুলো নিয়ে আলোচনা করা হবে। ২০০১ সালে টুইন টাওয়ার ও আমেরিকার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলার পর মার্কিন কর্তৃপক্ষের বর্ণনা অনুযায়ী তিন হাজার মানুষকে মারা গিয়েছেন, আহত হয়েছে কয়েক হাজার।

হামলার পর দিন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ‘সন্ত্রাসবাদে’র বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দেন। সে বছরের ২০ সেপ্টেম্বর জর্জ বুশ আফগানিস্তানের তৎকালীন তালেবান সরকারের কাছে ওসামা বিন লাদেনকে আমেরিকায় কাছে হস্তান্তরের আহ্বান জানান, অন্যথায় কঠিন পরিস্থিতি ও হামলার হুমকি দেওয়া হয়।

সে বছরের ৭ অক্টোবর তালেবান সরকারের পক্ষ থেকে আমেরিকার হাতে ওসামা বিন লাদেনকে তুলে দিতে অস্বীকৃতি জানানোর পর আমেরিকা আফগানিস্তানে বিমান হামলা শুরু করে। বিমান হামলার পর  একই বছরের ১৯ অক্টোবর আমেরিকা ও ন্যাটো জোট মিলে আফগানিস্তানে স্থল হামলা শুরু করে।

১১ নভেম্বর ২০০১ আফগানিস্তানে মার্কিন সমর্থিত বাম জোট মাজার শরীফ শহরে তালেবানকে পরাজিত করে। এটা আফগানিস্তানের চতুর্থ বড় শহর, যা বালাখ প্রদেশের পশ্চিমে অবস্থিত।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা আগ্রাসী কার্যক্রম বৃদ্ধি করতে গিয়ে ১৩ নভেম্বর  ২০০১ আফগান ক্ষমতা থেকে তালেবানকে সরিয়ে কাবুল দখল করে নেয়। কাবুল দখলের পর ৭ ডিসেম্বর মার্কিন বাহিনী কান্দাহারকে তাদের পরবর্তী টার্গেট হিসেবে ঘোষণা করে।

আফগানিস্তানের দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত কান্দাহারও তালেবানের হাতছাড়া হয়ে যায়। এভাবে আস্তে আস্তে দেশটির গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে তালেবানের ক্ষমতা হ্রাস পেতে থাকে। সে বছরের ৬ ডিসেম্বর আমেরিকা ও ন্যাটো জোট আফগানিস্তানের নানগাহার প্রদেশের পাহাড়ে ঢাকা আঁকাবাঁকা তোরাবোরা শহরে কথিত আল-কায়েদার ঘাঁটিতে বোমা হামলা শুরু করে।

আফগানিস্তানের বিশাল অংশ দখল ও তালেবান শাসনের পতনের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা আফগানিস্থানে নিজেদের পক্ষ থেকে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এর প্রেক্ষিতে ২০০১ সালের ২২ ডিসেম্বর হামিদ কারজাইকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দেশটির অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধান হিসেবে নির্বাচিত করে।

আফগান যুদ্ধে বড় টার্নিং পয়েন্ট আসে ২০০৩ সালের ১ মার্চ। যখন পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো দাবি করে যে তারা পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডি শহরে আল-কায়েদার গুরুত্বপূর্ণ নেতা খালেদ শেখ মোহাম্মদকে গ্রেফতার করেছে, যাকে নাইন এলিভেন হামলার মাস্টারমাইন্ড বলা হত।

২০০৪ সালের ১৮ জুন আমেরিকার ড্রোন হামলায় তেহরিকে তালেবান-এর গুরুত্বপূর্ণ নেতা মোহাম্মদকে হত্যা করা হয়। এখানে তার আলোচনা এজন্য জরুরী যে আফগানিস্তানে ন্যাটো জোট তালেবানের ক্ষমতা দখল করে নেওয়ার পর তিনি পাকিস্তানে আত্মগোপন করেছিলেন। তালেবানের বর্ণনামতে, মোহাম্মদ বাগরাম এয়ারপোর্টে চাকরি করতেন এবং তিনি আফগান তালেবানের আন্দোলন ও আদর্শ দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন।

২০০৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর তৎকালীন আফগান প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই-এর উপর হওয়া আত্মঘাতী হামলা থেকে তিনি জানে বেঁচে যান। হামলার সময় তিনি হেলিকপ্টারে ছিলেন। আফগানিস্তানের আঞ্চলিক দলগুলো হামিদ কারজাইয়ের কঠোর বিরোধী ছিলেন।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য আফগানিস্তানে নির্বাচনের আয়োজন করেছিল। ২০০৪ সালের ৯ অক্টোবর নির্বাচনের মাধ্যমে হামিদ কারজাই আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন।

২০০৯ সালের ১ ডিসেম্বর তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা আরো ৩০ হাজার সৈন্য আফগানিস্তানে পাঠানোর ঘোষণা দেন।

পাকিস্তান ও আমেরিকার সম্পর্কের মধ্যে বড় ধরনের পরিবর্তন আসে ২০১১ সালের ২ মে যখন পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে আমেরিকার সৈন্যদের গোপন অপারেশনে ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা করা হয়।

২০১৩ সালের ১৮ জুলাই ন্যাটো বাহিনী আফগানিস্তানের নিরাপত্তার দায়িত্ব আফগান বাহিনীর হাতে হস্তান্তর করে। তবে আফগান বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার নামে এখন পর্যন্ত আফগানিস্তানে ন্যাটোর সৈন্যরা অবস্থান করছে।

২০১৪ সালের ২৭ মে আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ২২ হাজার সৈন্যকে আফগানিস্তান থেকে প্রত্যাহার করার ঘোষণা দেন।

২০১৪ সালের ১৮ ডিসেম্বর আমেরিকা আফগানিস্তানে তাদের অপারেশন সমাপ্ত করার ঘোষণা দিয়ে শুধু ১০ হাজার সৈন্য আফগানিস্তানের রাখার কথা জানায়।

২০১৫ সালের ১১ জানুয়ারি সেসময় বিশ্বব্যাপী দ্রুত প্রভাব বিস্তার করা আইএস-এর পক্ষ থেকে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে তাদের কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেওয়া হয়।

২০১৫ সালের ২৯ জুলাই আফগান তালেবানের পক্ষ থেকে ২০১৩ সালে আফগান তালেবানের নেতা মোল্লা ওমরের ইন্তেকালের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়। একই দিনে আফগান তালেবানের পক্ষ থেকে মোল্লা আখতার মানসুরকে নতুন আমির হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

এক বছর পর ২০১৬ সালের ২১ মে ইরানের রাস্তা দিয়ে পাকিস্তানের প্রবেশের সময় আমেরিকার ড্রোন হামলায় নৃশংসভাবে তাকে হত্যা করা হয় মোল্লা আখতার মানসুরকে। সে বছরেরই ২৫ মে আফগান তালেবানের পক্ষ থেকে মোল্লা হাইবাতুল্লাহকে আফগান তালেবানের তৃতীয় আমির ঘোষণা করা হয়।

২০১৮ সালের ২৮ জুলাই আমেরিকা ও তালেবানের মাঝে আলোচনায় বসার বিষয়টি সামনে আসে। ২০২০ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি কাতারের দোহায় মার্কিন-তালেবান নেতৃত্বের মধ্যে সফল আলোচনা ও শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তির মূল বিষয় ছিল, আফগানিস্তান থেকে বিদেশি সৈন্যদের পুরোপুরি প্রত্যাহার করা, যা ২০২১ সালের মে মাসে শুরু হওয়ার কথা ছিল। দোহায় অনুষ্ঠিত শান্তি চুক্তিতে তালেবানের পক্ষ থেকে আরো একটি শর্ত দেওয়া হয়েছিল যে, আফগান সরকারের অধীনে থাকা ৫ হাজার তালেবান বন্দিকে মুক্তি দিতে হবে। দোহায় এই গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি স্বাক্ষর কালে উভয়পক্ষ একমত হয়েছিল যে, তালেবান নিশ্চিত করবে আফগানিস্থানকে তারা কোন ধরণের দেশ বিরোধী কার্যক্রমে ব্যবহার করবে না।

এরপর উভয় পক্ষ থেকে আফগানিস্থানে পরিস্থিতি স্থিতিশীল হতে শুরু করে। এরই মাঝে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন সরকার ক্ষমতায় আসে। নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ২০২১ সালের জানুয়ারিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তালেবানের মধ্যে অনুষ্ঠিত শান্তিচুক্তি সংশোধন করার ইঙ্গিত দেন। বাইডেনের বক্তব্য এ অঞ্চলের কেন্দ্রীয় রাজনীতি ও আফগানিস্তানের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ মোড় নিতে শুরু করে। পরবর্তীতে ১৪ এপ্রিল মার্কিন প্রেসিডেন্টের পক্ষ থেকে আফগানিস্তান থেকে বিদেশি সৈন্য পুরোপুরি প্রত্যাহারের ঘোষণা দেওয়া হয়। সৈন্য প্রত্যাহারের নতুন তারিখ ঘোষণা করা হয় ১১ সেপ্টেম্বর ২০২১।

রিপোর্ট অনুযায়ী এই ২০ বছরের আফগান যুদ্ধে ২ লাখ ৪১ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, এর মধ্যে মার্কিন সৈন্যও অন্তর্ভুক্ত। যুদ্ধে প্রাণ হারানোদের মধ্যে ৭১ হাজার ৩৪৪ জন ছিলেন সাধারণ নাগরিক, ২ হাজার ৪৪২ জন ছিলেন মার্কিন সেনা, ৭৮ হাজার ৩১৪ জন আফগান নিরাপত্তা বাহিনী, ৪৮ হাজার ১৯১ জন তালেবান সৈন্য এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। যুদ্ধে এখন পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২২.৬ ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়েছে।

সব ইতিহাস, ঐতিহাসিক ঘোষণা নিজ নিজ জায়গায়, তবে সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন প্রতিরক্ষা দফতর পেন্টাগনের দেওয়া ঘোষণা অন্য কোনো দিকেই ইশারা করছে। পেন্টাগনের মুখপাত্র জনকিরবি বলেছেন,  ১১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে মার্কিন বাহিনী আফগানিস্তান ত্যাগের ডেডলাইন এখনো বহাল রয়েছে। তবে এই গতি পরিবর্তন হতে পারে।

কিরবির বর্ণনা মতে, আফগানিস্তানের বিভিন্ন জেলায় তালেবানের ‘হামলা ও সহিংসতা’র পরে পরিস্থিতি বদলে যাচ্ছে। তাই নির্দিষ্ট দিন বা সপ্তাহের মধ্যে সৈন্য প্রত্যাহারের গতি পরিবর্তন করার প্রয়োজন হলে আমরা তাই করবো।

এখন দেখার বিষয় হলো সামনের দিনগুলোতে সত্যিই নির্দিষ্ট তারিখে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার করা হয়, নাকি ঘটনা নতুন কোন দিকে মোড় নেয়?  নাকি আবারো অতীতের মতো সৈন্য প্রত্যাহারের তারিখ পাল্টে দিবে আমেরিকা? নাকি আফগানিস্তান সিনড্রোম ভিয়েতনামের মতো আমেরিকার মন-মানসিকতায় প্রভাব ফেলবে?

উর্দুভাষী  সাংবাদিক ও কলামিস্ট আমব্রিন সিকান্দারের কলাম ( সামা নিউজ অনলাইন ২২ জুন ২০২১) থেকে ভাষান্তর নুরুদ্দীন তাসলিম।

কেএল


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ