শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ।। ১৫ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৯ রমজান ১৪৪৫


‘জন্মের পরই আমার বিছানায় একটা সাপ এসে পড়েছিল’

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

[জামিয়া দারুল উলুম করাচির মুখপাত্র ‘ماہنامہ البلاغ মাহনামা আল-বালাগ’ এ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত বিশ্বনন্দিত আলেম, স্কলার আল্লামা তাকি উসমানির আত্মজীবনী আওয়ার ইসলামে প্রকাশ হবে ইনশাল্লাহ।

এ বিষয়ে আল্লামা তাকি উসমানি আনুষ্ঠানকিভাবে আওয়ার ইসলামকে ভাষান্তর করে প্রকাশের অনুমতি দিয়েছেন। গত ২ জানুয়ারি জামিয়া দারুল উলুম করাচির তাখাসসুস ফিল ইফতার শিক্ষার্থী, আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকমের শুভাকাঙ্ক্ষি উমর ফারুক ইবরাহীমীর মাধ্যমে আল্লামা তাকি উসমানি ও পত্রিকা কর্তৃপক্ষের কাছে আত্মজীবনী ‘ইয়াদে’ অনুবাদের অনুমতি চাওয়া হলে তারা খুশি মনে রাজি হন এবং আওয়ার ইসলামকে ধন্যবাদ জানান বাংলাভাষায় ইসলামের প্রচার ও প্রসারের জন্য।

আল্লামা তাকি উসমানির নতুন ধারাবাহিক আত্মজীবনী “یادیں ইয়াদেঁ ” মাহনামা আল-বালাগে সফর ১৪৩৯ হিজরি, নভেম্বর ২০১৭ ইংরেজি মাস থেকে। আওয়ার ইসলামে লেখাটি প্রতি শনিবার ও বুধবার প্রকাশ হবে ইনশাল্লাহ। আজ ছাপা হলো প্রথম কিস্তি। অনুবাদ করেছেন মাওলানা  উমর ফারুক ইবরাহীমী।]

পূর্বপ্রকাশের পর: আমার জন্ম পাঁচ শাউয়াল, ১৩৪২ হিজরি সনে।এমনটাই দেখেছি হযরত আব্বাজান রহ. এর ডায়েরিতে তখনকার সময়ে ইংরেজি সন তারিখ লেখার পরিবর্তে হিজরি সন তারিখ লেখার ব্যাপক রেওয়াজ ছিলো। তাই আব্বাজান শুধুমাত্র হিজরি সন তারিখ লিখে রাখাটাই যথেষ্ট মনে করেছেন।

পরবর্তীতে বিভিন্ন ক্যালেন্ডারের মাধ্যমে হিসেবকরে জানতে পারলাম, সেটা ছিলো ১৯৪৩ সালের অক্টোবরের ৩ তারিখ।

জন্মদিনের এমন একটি ঘটনাও আমি আমার আম্মাজান ও ভাইবোনদের থেকে শুনেছি-আমার জন্মের দিনে যে বিছানায় আমাকে শোয়ানো হয়েছিলো, আকস্মিক ছাদ থেকে একটি সাপ সেখানে এসে পড়লো। তখন কোনভাবে যদি সাপটাকে বধ করা না হতো, সেদিনই হয়তো পৃথিবী আমার অনিষ্ঠতা থেকে পরিত্রাণ পেয়ে যেতো!

যাই হোক! আমি আমার জীবনের শুধুমাত্র চার বছর সাত মাস (অক্টোবর ১৯৪৩ থেকে মে ১৯৪৮ পর্যন্ত) দেওবন্দ শহরে থাকার সুযোগ পেয়েছিলাম। আমার বাল্যকালের যে সময়টুকু দেওবন্দে কাটিয়েছি, আদতে তখন ছোট বাচ্চারা খেলাধুলাভিন্ন অন্যসব ব্যাপারে অনুভূতিশূূন্য থাকে। পরবর্তীতে বয়সের সাথে পাল্লা দিয়ে দূরন্ত শৈশবকেও ভুলে বসে।

কিন্তু আমার শৈশবের দেওবন্দে ঘটে যাওয়া এমন অনেক স্মৃতি আজও হৃদয়ের ক্যানভাসে চিত্ত ঝলমলে হয়ে আছে। কেমন যেন আজও দেখতে পাচ্ছি হারানো দিনগুলো!

সেকালে দেওবন্দের ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ,ফ্যানের কোনরকম সুবিধা ছিলো না। ছিলো না নলকূপের অস্তিত্বও। না ছিলো একালের মতো তেল-গ্যাসের চুলায় রান্না বান্নার ব্যবস্থাপনা।

বৈদ্যুতিক বাল্বের স্থানে হয়তো মোমবাতি অথবা কেরোসিন ল্যাম্পের প্রচলন ছিলো। আজকালের নলকূপের পরিবর্তে মটকা অথবা পিতলের পাত্রে পানি সঞ্চয় করা হতো। এগুলোতে পানি সঞ্চয় করার জন্য সাধারণত মজদুরের সাহায্য নেয়া হতো। তারা চামড়ার বড়বড় পাত্র কোমরে বহন করে ঘরেঘরে পানি পৌঁছে দিতো। তবে মডার্ন ও আভিজাত্য অঞ্চলে সবাই সম্মিলিতভাবে লোহার পাইপ লাইনের ব্যবস্থা করে নিতো।

সেখানে লাগানো হ্যান্ডেলে সজোরে দাবিয়ে বালতি বা পাত্রে পানি পূর্ণ করা হতো। পানির সুবিধা ছাড়াও হ্যান্ডেলের আরেকটি ফায়দা ছিলো-এটা দাবানোর দ্বারা শারীরিক কসরতও হয়ে যেতো।

বয়সস্বল্পতার কারণে আমি এধরণের শারীরিক কসরতের উপযুক্ত ছিলাম না। তাই অন্যদের হ্যান্ডেলে ঝুলতে দেখেই পরমসুখ অনুভব করতাম! পানের জন্য ঘরের পানপাত্রে সংরক্ষিত পানি গুমোট গরমে ঠাণ্ডা-শীতল হয়ে থাকতো। বৈদ্যুতিক পাখার স্থানে হাতপাখার প্রচলন ছিলো। আজও যখন বিদ্যুৎ চলে যায়, নিজের অজান্তেই  স্মৃতির দর্পণে হারিয়ে যাই আমি।

মে- জুনের মৌসুমে যখন ইট পাথরের দেয়াল ভেদ করে ক্রুদ্ধ উষ্ণতা পারদ ছড়াতো, বাড়ির আঙিনায় লালইটের নির্মিত ফ্লোরে কেউ একজন পানি ছিটিয়ে দিতো। নির্বাত পরিবেশের ঈষদুষ্ণ হাওয়াকে হাতপাখার সাহায্যে মুখাভিমুখে করে দেয়া হলে, স্যাঁতস্যাঁতে ফ্লোর থেকে নিঃসৃত খুশবোয় আশপাশ মুখরিত হয়ে উঠতো। এতে প্রচণ্ড গরমে কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাসও ফেলা যেতো।

সেই মৌসুমে আমি আমার আম্মাজানের সাথে বাড়ীর আঙিনায় পেতে রাখা খেজুরপাতার তৈরি চৌকিতে শুতাম। তখন আমার আর তারাভরা আকাশের মাঝে না গ্যাস-পেট্রোল বা ডিজেলের কোন আবরণ প্রতিবন্ধক হতো। না দূরাকাশের প্রান্তজুড়ে বিস্তৃত আলোকচ্ছটার ফলে ক্ষুদ্রতম তারকারা চোখের আড়াল হতো।

অবাক রাতের দীপ্তিময় তারকারাজির বুকচিরে বয়ে চলা আকাশগঙ্গা,  এবং তার থেকে ফুটে উঠা শুভ্রতার দিকে আমি অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতাম। আমরা ছেলেপুলেরা ভাবতাম-এটা আকাশপথ। আল্লাহ্‌ তা'য়ালা ফেরেশতাদের যাতায়াতের জন্য বানিয়েছেন। সে আকাশপথে ফেরেশতাদের বিচরণের কল্পনাকরে করেই কখন যেন স্বপ্নরাজ্যে হারিয়ে যেতাম!

মন চাচ্ছে আজ আমার দুরন্ত শৈশবের কিছু বিক্ষিপ্ত স্মৃতির অ্যালবাম খুলে বসি। কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন, প্রথমে আমাদের পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় জেনে নেয়া। আব্বাজান হজরত মুফতি মুহাম্মদ শফি রহ. কে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কিছু নেই।

কারণ, আমার পরিচয় তাকে দিয়ে; তার পরিচয় আমাকে দিয়ে নয়। (আলহামদুলিল্লাহ্‌! আমার লেখা ‘মেরে ওয়ালিদ মেরে শাইখ’ কিতাবে তাঁর সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছি  এবং ‘মাহনামা আলবালাগ’ এর মুফতিয়ে আ'যম সংখ্যায়ও এব্যাপারে আলোচনা এসেছে। সেখানে মুহতারাম বড় ভাই মুফতি মুহাম্মদ রফি উসমানি আব্বাজানের জীবনবৃত্তান্ত নিয়ে সবিস্তার আলোচনা করেছেন। পরবর্তীতে সেটা কিতাব আকারেও প্রকাশ পেয়েছে। সেখানে আমাদের বংশ এবং পূর্বপুরুষদের জীবনবৃত্তান্তও স্থান পেয়েছে।)

আমি যাই হই না কেন, সবই তার (মুফতি শফি রহ.) নিসবতের কারণে। যদি কোন ভালাই আল্লাহর তরফ থেকে পেয়ে থাকি, তবে সেটাও তার ফয়েজ ও বরকত। যদি কোন খারাবি থাকে, তবে সেটা তার সান্নিধ্যে থেকে ফায়দা হাসিল না করার কারণে। মোটকথা সব কৃতিত্বই তার।

কবি বলেছেন-

দিল যদি হয় মোর কৃষ্ণবর্ণের
তবে কলঙ্ক আমি তব ফুলেল উদ্যানের।

নিয়তি যদি হয় মোর প্রসন্ন, সদয়ের
তবে সব কীর্তি তব কুসুমাস্তীর্ণ বসন্তের।

সুতরাং, আমার এ স্মৃতিচারণে ঘুরেফিরে বারংবার তার আলোচনা আসতেই থাকবে।

আমি জন্মের পর থেকে আব্বাজানকে দুটি কাজে ব্যস্তসময় কাটাতে দেখেছি। সে সময়ে তিনি যদিও দারুল উলুম দেওবন্দের মুফতিয়ে আ'যম পদবি এবং শিক্ষকতা থেকে অবসরপ্রাপ্ত ছিলেন, তথাপি অনেক তালিবুল ইলম তার শিষ্যত্ব লাভের জন্য উদগ্রীব ছিলো। তারা আমাদের ঘরে এসে পড়তো। বর্তমানে এটাকে কোচিং বা টিউশন বলে। তবে উভয়টির মাঝে রয়েছে বিস্তর ফারাক। আজকাল কোচিং ও টিউশনিকে উপার্জনের একটি বড় মাধ্যম মনে হিসেবে ধরা হয়।

ইসলামি যিন্দেগী অ্যাপটি ইনস্টল করুন আপনার মোবাইলে

অথচ, দীনি মাদরাসাগুলোতে উস্তাদ-ছাত্রের সম্পর্ক এতটাই নিস্বার্থ হয়ে থাকে, যদি কোন ছাত্রের জন্য দরস বা ক্লাসের পাঠ যথেষ্ট না হয়, তবে শিক্ষক তাকে ওভারটাইম বা অতিরিক্ত সময় পড়ানোকে শুধু দায়সারা নয়, বরং পূর্ণ দায়িত্ববোধের সাথে ছাত্রের হক মনে করে পড়িয়ে দেন।

বিনিময়ে ছাত্রদের কাছ থেকে কিছু গ্রহণ করা তো মাদরাসার পরিবেশে অত্যন্ত দোষণীয় মনে করা হয়। এবার শিক্ষক আর্থিকভাবে যতই দূর্বল হোন না কেন! আব্বাজান রহ. এই আবেগ নিয়েই ছাত্রদেরকে আমাদের ঘর অথবা মসজিদে পড়াতেন।

আমাদের মহল্লার মসজিদের নাম ছিলো ‘আ-দীনি মসজিদ’ (ফার্সিভাষায় এটার অর্থ হচ্ছে-জুম'আর মসজিদ)। তবে ব্যাপকভাবে লোকেরা এটাকে দীনি মসজিদ বলতেন। প্রথমে আমাদের দাদা মাওলানা ইয়াসিন রহ. এবং পরবর্তীকালে আব্বাজান রহ. এই মসজিদের মুতাওয়াল্লি ছিলেন। কখনো কখনো আব্বাজান রহ. এই মসজিদেই দরস দিতেন।

দ্বিতীয়ত, তিনি যখন ঘরে অবস্থান করতেন অধিকাংশ সময়ে তাকে কিছু না কিছু লিখতে দেখতাম। গ্রীষ্মের রাতে আমাদের ঘরের বারান্দায় রশ্মির জন্য কেরোসিনের ল্যাম্প টানিয়ে দেয়া হতো। অধিকাংশ রাতে আব্বাজান সেই ল্যাম্পের নিবুনিবু আলোয় বসে বাঁশের কলম (সেকালে এটাকে ক্লিক কলম বলা হতো) দোয়াতকালিতে ডুবিয়ে কী যেন লিখতেন। তখনো ফাউন্টেনপেনের প্রচলন হয়নি।

এছাড়াও তিনি বৈঠকখানার সাথে একটি ছোট্ট কামরা বানিয়েছিলেন। আমরা ওটাকে ‘হুজরা’ বলতাম।বৈঠকখানাটি মূলত তার ইবাদতখানা ছিলো।অহর্ণিশ সেখান থেকে তিলাওয়াত, যিকির-আযকারের মধুর গুঞ্জরন উঠতো।

চলবে... আগামী পর্ব প্রকাশ হবে শনিবার ইনশাআল্লাহ 

প্রথম পর্ব যারা পড়েননি: ‘নিজেকে দেওবন্দের অনুসারী বলে প্রচার করতে সংকোচবোধ করি’


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ