|| আব্দুল্লাহ আলমামুন আশরাফী ||
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। মানবসভ্যতার অহংকার। তার কাছে গোটা মানবজাতি ঋণী। তিনি পৃথিবীকে একটি উন্নত,সমৃদ্ধ ও আলোকিত সমাজ উপহার দিয়েছেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, মানবজাতির প্রতি এত বড় অনুগ্রহশীল এই মহামানবের প্রতি একশ্রেণীর অমানুষ পাপিষ্ঠ নরাধম প্রায়ই অবমাননাকর মন্তব্য করে নিজের হীন মানসিকতার জানান দেয়।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অতুলনীয় পবিত্র চরিত্রে কালিমা লেপনের অপচেষ্টা চালায়। এতে করে স্বাভাবিকভাবেই রাসুলপ্রেমিক মুসলিম উম্মাহর হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। প্রতিবাদে ফুঁসে ওঠে তাওহিদী জনতা। ক্ষোভ আর দ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে প্রতিটি জনপদে। অনেক সময় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বেঁধে যায়। ফলে বিপর্যয় আর বিশৃঙ্খলার আগুনে সমাজ পুড়ে ছারখার হয়ে যায়।
ইসলামে রাসুল অবমাননা একটি অমার্জনীয় অপরাধ। কুরআন সুন্নাহয় রাসুল অবমাননার ভয়াবহ শাস্তির নির্দেশনা এসেছে।
কোরআনের আলোকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর অবমাননাকারীর শাস্তি
এক. ‘নিশ্চয়ই যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে কষ্ট দেয়, আল্লাহ তাদের দুনিয়া ও আখিরাতে লানত করেন এবং তিনি তাদের জন্য প্রস্তুত রেখেছেন লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি।’ (সুরা আহজাব, আয়াত : ৫৭)
দুই. ‘তারা কি জানে না, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের বিরোধিতা করে, তার জন্য রয়েছে অবশ্যই জাহান্নাম, তাতে সে চিরকাল থাকবে। এটা মহা লাঞ্ছনা।’ (সুরা তাওবা, আয়াত : ৬৩)
তিন. ‘আর যে হিদায়াত পাওয়ার পর রাসুলের বিরুদ্ধাচরণ করে এবং মুমিনদের পথের বিপরীত পথ অনুসরণ করে, আমি তাকে ফেরাব যেদিকে সে ফিরে এবং তাকে প্রবেশ করাব জাহান্নামে। আর আবাস হিসেবে তা খুবই মন্দ।’ (সুরা নিসা, আয়াত : ১১৫)
হাদিসের আলোকে নবী (সা.)-এর অবমাননার শাস্তি
এক. কাব বিন আশরাফ নামের একজন ইহুদি যে ইসলাম ও মুসলিমদের প্রতি অত্যন্ত শত্রুতা ও হিংসা পোষণ করত। সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কষ্ট দিত এবং তাঁর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে যুদ্ধের হুমকি দিয়ে বেড়াত। এমনকি মদিনায় ফিরে সাহাবায়ে কেরাম (রা.)-দের স্ত্রীদের ব্যাপারে বাজে কবিতা বলতে শুরু করে এবং কটূক্তির মাধ্যমে তাঁদের ভীষণ কষ্ট দিতে থাকে।
তার এ দুর্ব্যবহারে অতিষ্ঠ হয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাব বিন আশরাফকে হত্যার নির্দেশ দিলে মুহাম্মদ ইবনে মাসলামাহ (রা.)-এর নেতৃত্বে কয়েকজন সাহাবি তাকে হত্যা করেন। (আর রাহিকুল মাখতুম, পৃষ্ঠা ২৮৫)
দুই. আবু রাফে নামের এক ইহুদিকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ জন্যই হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন, সে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর বিরুদ্ধে সব সময় কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করত।
আল্লামা ইবনে কাসির (রহ.) ‘আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া’ গ্রন্থে ইমাম বুখারি (রহ.)-এর সূত্রে বর্ণনা করেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু রাফেকে হত্যা করার জন্য বেশ কজন আনসারি সাহাবিকে নির্বাচিত করলেন এবং আবদুল্লাহ ইবনে আতিক (রা.)-কে তাঁদের দলপতি নিয়োগ করলেন। আবু রাফে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কষ্ট দিত এবং এ কাজে অন্যদের সাহায্য করত। (বুখারি, হাদিস : ৪০৩৯, ৪০৪০)
তিন. মুজাহিদ (রহ.) বলেন, ওমর (রা.)-এর দরবারে এমন এক ব্যক্তিকে আনা হলো, যে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে গালি দিয়েছে। ওমর (রা.) তাকে হত্যা করেন। অতঃপর বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ বা কোনো নবীকে গালি দেবে তোমরা তাকে হত্যা করবে। (আস-সারিমুল মাসলুল : ৪/৪১৯)
এদের ব্যাপারে শরয়ী সিদ্ধান্ত
নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অবমাননাকারীর শাস্তি একমাত্র মৃত্যুদণ্ড। এ ব্যাপারে উম্মতের ইজমা (ঐকমত্য) প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আল্লামা ইবনে তাইমিয়া (রহ.) উল্লেখ করেন, সব মাজহাবের ঐকমত্যে সিদ্ধান্ত হলো—নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর অবমাননাকারী কাফির এবং তার শাস্তি একমাত্র মৃত্যুদণ্ড। ওপরে উল্লিখিত আলোচনা থেকে এ কথা স্পষ্ট যে—
এক. রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর শানে বেয়াদবিমূলক মন্তব্য, বক্তব্য বা তাঁর প্রতি ঠাট্টা-বিদ্রূপকারী এবং ধর্মীয় কোনো বিধান নিয়ে ব্যঙ্গকারী ব্যক্তি উম্মতের সর্বোচ্চ ঐকমত্যে মুরতাদ বলে সাব্যস্ত হবে।
দুই. রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অবমাননাকারীর শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।
তিন. তবে মৃত্যুদণ্ড প্রদানের দায়িত্ব শাসকদের।
চার. শাসকদের জন্য আবশ্যক হলো এ ধরনের লোকদের চিহ্নিত করে আইনের মাধ্যমে তাদের মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত করা।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি অবমাননাকর মন্তব্য করা অত্যন্ত ঘৃণ্য ও অমার্জনীয় অপরাধ। রাসুল অবমাননাকারীরা দেশ, সমাজ ও মানবতার শত্রু। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও বিশ্বশান্তির পথে এরা অন্তরায়। সামাজিক স্থিতিশীলতা ও শৃঙ্খলা বজায় রাখতে রাষ্ট্রীয়ভাবে ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে রাসূল অবমাননাকারীদের সর্বোচ্চ নিন্দা, ঘৃণা ও শাস্তি প্রদান করার বিকল্প নেই।
লেখকঃ মুহাদ্দিস, জামিয়া গাফুরিয়া মাখযানুল উলুম টঙ্গী, গাজীপুর। খতীব, আউচপাড়া জামে মসজিদ টঙ্গী, গাজীপুর।
এমএম/