মাওলানা বাহাউদ্দীন যাকারিয়া
খেলাধুলা মানুষকে আল্লাহর স্মরণ, নামায ও ইবাদত থেকে দূরে সরিয়ে রাখে, বিমুখ করে দেয়। খেলাধুলাতে সময়ের অপচয়, অর্থের অপচয় এবং আরো নানা অকল্যাণকর বিষয় রয়েছে। ইসলামে নিছক খেলাধুলায় মগ্ন থাকার অনুমোদন নেই; বরং শরীর সুস্থ রাখার জন্য পরিমিত ব্যায়াম ও শারীরিক কসরতের অনুমোদন রয়েছে। ব্যায়াম ও শরীরচর্চার জন্য অনেক উপায় রয়েছে— হাঁটা, দৌড়, সাঁতার, তীরন্দাজি, ঘোড়দৌড় কিংবা যেকোনো মেহনতি কাজ। এগুলো শরীয়তসিদ্ধ ও ফলপ্রসূ।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)-এর সভাপতি ‘মাদরাসা ক্রিকেট’ চালুর প্রস্তাব করেছেন। কিন্তু দেশের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ক্রিকেটের চিত্র বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, নিছক মাদরাসা শিক্ষার্থীদের শরীরচর্চার জন্য বিসিবি এমন উদ্যোগ নিচ্ছে না। বিসিবির মূল উদ্দেশ্য শারীরিক চর্চা নয়, বরং বাণিজ্যিক ক্রিকেটের প্রসার ও পেশাদার ক্রিকেটার তুলে আনা— যেখানে বিজ্ঞাপন, জুয়ার টাকায় স্পনসরশিপ ও শরিয়তের দৃষ্টিতে নাজায়েজ লেনদেন জড়িত। এ ধরনের নানা কারণে পেশাদার ক্রিকেট ইসলামে বৈধ নয়।
কওমী মাদরাসাগুলো মুসলিম উম্মাহর আত্মিক ও নৈতিক পুনর্জাগরণের কেন্দ্র। এখানে খালেছ দ্বীনি ইলম অর্জন, আত্মশুদ্ধি ও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনই ছাত্রদের মূল লক্ষ্য। এখানে ক্রিকেটের মতো সময় নষ্টকারী ও বিনোদননির্ভর খেলা যুক্ত করার চেষ্টা নিঃসন্দেহে মাদরাসা শিক্ষার স্বকীয়তা ও মূল উদ্দেশ্যের পরিপন্থী। মাদরাসার ছাত্রদের শরীরচর্চার প্রয়োজন আছে, কিন্তু সেজন্য মাদরাসায় সাংগঠনিকভাবে ক্রিকেট যুক্ত করার কোনো প্রয়োজন নেই।
মাদরাসা হলো তাকওয়া, ইখলাস ও ইলমের কেন্দ্র। ক্রিকেট ও মাদরাসা, এই দুটি ক্ষেত্র দুটি ভিন্ন জগৎ। কওমী মাদরাসা ও ক্রিকেটকে এক করা মানে দ্বীনি শিক্ষা ও বাণিজ্যিক বিনোদনের মিশ্রণ ঘটানো, যা একেবারেই অনুচিত ও অগ্রহণযোগ্য।
ক্রিকেট মূলত উপনিবেশবাদীদের অবসরের বিনোদনের মাধ্যম ছিল। ব্রিটিশ শাসকরা শাসিত জাতিগুলোকে বিনোদন ও মোহে আবিষ্ট রাখার জন্যই এমন খেলাধুলার প্রচলন ঘটায়। এজন্যই চীন, ফ্রান্স, জার্মানি প্রভৃতি উন্নত দেশে ক্রিকেটের তেমন প্রসার নেই। এখন আমাদের দেশে ক্রিকেটসংশ্লিষ্টরা ঠিক কেন ‘মাদরাসা ক্রিকেট’ চালু করতে চান, তা ভেবে দেখার বিষয়। এটি মাদরাসা শিক্ষার স্বকীয়তাকে নষ্ট করার সুদূরপ্রসারী কোনো মাস্টারপ্ল্যানের সূচনা কি না, তাও ভেবে দেখতে হবে।
করোনাকালীন সংকটের সময় সরকার মাদরাসাগুলোকে আর্থিক সহায়তার প্রস্তাব দিয়েছিল, কিন্তু মাদরাসাগুলোর স্বকীয়তা ও স্বাধীনতা রক্ষার স্বার্থে হাইয়াতুল উলয়া ও বেফাকসহ শীর্ষ সবগুলো মাদরাসা তা প্রত্যাখ্যান করেছিল। শুধু ক্রিকেট নয়, মাদরাসা শিক্ষার মূল লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের সাথে সাংঘর্ষিক যেকোনো উদ্যোগ অবশ্যই আমরা বর্জন করব।
‘মাদরাসা ক্রিকেট’ ইসলাম, শরীয়ত ও মাদরাসা শিক্ষার মূল স্পিরিটের পরিপন্থী একটি উদ্যোগ। তাই মাদরাসার ছাত্র ও শিক্ষকদের প্রতি আহ্বান থাকবে, আমরা যেন এ ধরনের চটকদার কোনো উদ্যোগে প্রলুব্ধ না হই; এমন কোনো কাজের পরিবেশ তৈরিতে সহায়ক না হই, যা আমাদের সময় নষ্ট করবে এবং ইতিহাস-ঐতিহ্য, দ্বীনি তালিম ও হেফাজতে দ্বীনের লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করবে। এরই সাথে ইন্টেরিম সরকার ও বিসিবির কর্তা-ব্যক্তিদের প্রতি আমাদের জোরালি দাবি, দুরভিসন্ধিমূলকভাবে মাদরাসা শিক্ষার লক্ষ্য ও আদর্শবিরোধী কোনো কিছুকে চাপিয়ে দেওয়ার অপপ্রয়াস চালাবেন না।
আল্লাহ তায়ালা এ দেশের কওমি মাদরাসাগুলোকে সকল চক্রান্ত থেকে হেফাজত করুন।
লেখক: সহসভাপতি, বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া; মুহতামিম, জামিয়া ইসলামিয়া হোসাইনিয়া, আরজাবাদ, ঢাকা
এলএইস/