|| শায়খ মিসবাহ উদ্দীন মাদানী ||
জামায়াত ফ্যামিলিতে বড় হয়েছি। ‘আল্লাহর আইন চাই, সৎ লোকের শাসন চাই’ লেখা বড় বড় পোস্টারের ছবি এখনও চোখে ভাসে। আমার বাবা আজীবন জামায়াতের জন্য মূল্যবান সময় ও সম্পদ উৎসর্গ করে গিয়েছেন। যদিও তার মধ্যে কখনো কট্টরতা দেখিনি। তাবলিগ ও সকল ধারার আলিমগণের খেদমত ও মুহব্বত তিনি নিজের জন্য সৌভাগ্যের কারণ মনে করেন। আমার বাবা এখনও মদিনা জামায়াতের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বশীল। তিনি চট্টগ্রামের দায়িত্বশীলদের কাছে আমাকে আইআইইউসি থেকে বের করে দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে কৌশলে পরোক্ষ জবাব দিয়েছেন- আপনি আমাদের সাথে আন্তরিক ও আপনার ত্যাগের তুলনা হয় না। কিন্তু আপনার দুইটা সন্তানের একটাও আমাদের সংগঠনে দেননি, বরং কওমি মাদরাসায় পড়িয়েছেন। ছেলের জন্য বউ এনেছেন এলাকার প্রসিদ্ধ তাবলিগ ফ্যামিলি থেকে।
আমার বাবার কথা হলো, আমার ছেলে জামায়াত করে না, কিন্তু জামায়াতসহ সকলের সাথে উদারতা ও হুসনে সুলূক করে চলেন। আমার ছেলে পড়াশোনামনস্ক দাঈ মানসিকতার মানুষ। তাদের আচরণে আমার বাবা নির্বাক। তাঁর সম্মানিত বন্ধুবান্ধবদের কেউ কেউ আমাকে অব্যাহতি পুনর্বিবেচনার দরখাস্ত নিয়ে সাথে করে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের সর্বোচ্চ ব্যক্তির সাথে কথা বলতে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। আমি বিনয়ের সাথে না করে দিয়েছি।
কেউ কেউ বলেন, আমার নিয়োগ প্রক্রিয়া সঠিক ছিল না। অথচ আমার নিয়োগ- পেপার সার্কুলার, লিখিত পরীক্ষা, ভাইভা বোর্ড, সিন্ডিকেট মিটিং, বিওটি অনুমোদিত হয়ে ইউজিসি অনুমোদন হয়ে সকল ক্রায়টরিয়া মেনটেইন করে হয়েছে। শিক্ষক হিসেবে আমার জনপ্রিয়তা ও দক্ষতার প্রমাণ হিসেবে আমার TER রিপোর্ট দেখতে পারেন। পরবর্তী সময়ে জামায়াত প্রশাসন এসে আবার পরীক্ষা নিলে অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমার বাবার আদেশে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছি। আলহামদুলিল্লাহ আমাকে আটকাতে পারেনি। লিখিত ভাইভা অতিক্রম করেছি। কিন্তু উত্তীর্ণ হওয়ার পরও তারা আমাকে নেয়নি। এই কথাগুলোর চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে বলেন।
এরকম চাকরি যে আমার খুব বেশি প্রয়োজন এমন না। আবেদন করে পরীক্ষায় ভালো করেছিলাম, সুযোগ পেয়ে সম্মান হিসেবে নিয়েছিলাম। আমাদের পারিবারিক অবস্থা হিসেবে আমাকে চাকরি করতে হয় না, আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু তাদের আচরণ, বৈষম্য, অকৃতজ্ঞতা আমাদেরকে হতবাক করেছে।
দ্বীন কায়েমের জন্য জামায়াত-শিবিরের ভাইদের আবেগ উদ্দীপনা দেখেছি। তাদের দারসুল কুরআন ও উসতাজ মাওলানা মওদূদীর কিছু রচনা আমাকে মুগ্ধ করেছিল। যদিও আরব-আজমের আলিমগণের বড় একটি অংশ তার কিছু মতামত ও রচনার সমালোচনা করেন, যা পরে জেনেছি। যার মধ্যে কিছু সমালোচনার গ্রাউন্ড আছে বলে মনে হয়েছে, আর কিছুর ব্যাখ্যার সুযোগ আছে বলে মনে হয়েছে। যাইহোক, জ্ঞানীগণ পারস্পরিক একাডেমিক বিতর্ক করবেন, মতামত জানাবেন, কিন্তু ঝগড়ার পর্যায়ে যাওয়া পছন্দ করি না। এই সংগঠনের ভাইদের আবেগ উদ্দীপনা ও সুশৃঙ্খল সাংগঠনিক প্র্যাকটিস ও জেনারেল সেক্টরে তাদের অবদান ও অবস্থান মুগ্ধ করার মতো। কিন্তু নির্দিষ্ট সিলেবাসে পড়ালেখা করে আলিমগণের ছাত্রত্ব ও সান্নিধ্য থেকে বেনিয়াজি তথা নির্মুখাপেক্ষিতা ও দ্বীনচর্চার ঐতিহ্যবাহী ধারার সাথে সংযুক্ত না থেকে দ্বীনের অধ্যয়ন ও অনুসরণে স্বাধীন মনোভাবের মন্দ প্রভাব আমি তাদের মধ্যে অনুভব করি। তাদের প্রতি আমার দরদি কিছু কথা বলার আছে। কিন্তু বলতে সাহস হয় না, এই ভয়ে যে, তারা আমার কথার উপকারী দিকটি সমর্থন না করে বরং অপবাদ, ট্যাগ ও কটূক্তির তীরে আমাকে জর্জরিত করে আবর্জনার স্তুপে নিক্ষেপ করার প্রয়াস চালাবেন।
যাক, আমার নিজের কিছু কথা বলি। স্কুলে পড়ালেখা করেছি। দশম শ্রেণি থেকে কুরআনের ভাষা আরবি শেখার নিয়তে কওমি মাদরাসায় ভর্তি হলাম। আল্লাহ তায়ালা আমাকে ইলমের জন্য কবুল করলেন। বাংলাদেশে শীর্ষ কয়েকটি দেওবন্দি মাদরাসায় পড়ালেখা করেছি। মহান উসতাজদের সান্নিধ্য পেয়েছি। শাহ আহমদ শফী রহ., শায়খুল হাদীস ইহসানুল হক্ব সন্দীপী রহ. আল্লামা সুলতান যওক নদভী রহ., আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী রহ., আল্লামা আবু তাহের মিসবাহ হাফিজাহুল্লাহসহ অসংখ্য বুযুর্গ ও নিষ্ঠাবান আলিমকে শিক্ষক হিসেবে পেয়ে ধন্য, আলহামদুলিল্লাহ।
ইলম আহরণে দেওবন্দিদের ঐকান্তিকতা, সুন্নাহর অনুসরণ ও আমল-ইবাদতে একাগ্রতা, আধ্যাত্মিকতার চর্চা, সাহাবা চেতনা ও বৃটিশবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব ও ত্যাগের ঐতিহ্য, সমকালীন যেকোনো বাতিলের বিরুদ্ধে সর্বদা সোচ্চার থাকা, উপমহাদেশে ইলমে ওহীর প্রদীপ প্রজ্জ্বলিত রাখার ক্ষেত্রে তাদের অবদান- এগুলোর কারণে তাদের প্রতি মুগ্ধতা তাদেরকে আমার নিজস্ব করে নেওয়ার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছে। উল্লেখ্য, 'দেওবন্দি' এটা মসলকি নাম, স্থান, ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে এই নামগুলো গড়ে উঠে। সামাজিকভাবে পরিচয়ে এগুলো ভূমিকা রাখে। কার্যত আমাদের পরিচয়- মুসলিম, মুহাম্মদ সা. এর উম্মত, আহলুস্ সুন্নাত ওয়াল জামা'আত।
দেশে আলিয়া মাদরাসা থেকে দাখিল আলিম পাস করেছি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামিক স্টাডিজে ছয় মাস পড়েছি। পরে বিদেশে চলে গিয়েছি। আলিয়া ও বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু দক্ষ ও নিষ্ঠাবান উসতাজ পেয়েছি। কিন্তু সরকারি নিয়ন্ত্রণ ও চাপিয়ে দেওয়া সিস্টেমের কারণে সেখানকার যোগ্য ও নিষ্ঠাবান উসতাজগণ ছাত্রদের ভালোভাবে ইলম শিক্ষা দিতে পারেন বলে মনে হয়নি।
আলিয়া ঘরানার আমার একজন মহান উসতাজের নাম হচ্ছে মাওলানা নূরুল আজীম হাফিজাহুল্লাহ, বর্তমান প্রিন্সিপ্যাল, ঐতিহ্যবাহী গারাঙ্গিয়া আলিয়া মাদরাসা সাতকানিয়া। কওমি মাদরাসা থেকে দাখিল পরীক্ষা দেওয়ার জন্য যখন গ্রামে এসেছিলাম তখন তার কাছে ব্যক্তিগতভাবে ২ মাসে হেদায়াতুন্নাহু শেষ করেছিলাম। এখনও মনে পড়ে, লোহাগাড়া থানা মসজিদের বারান্দায় অল্প আলোতে হুজুর আমাকে দারসগুলো দিতেন। হুজুর আমার মত তালিবুল ইলমকে পেয়ে অনন্য ভালবাসায় গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর মুহাব্বাত ও এহসান আমাকে ঋণী করে রেখেছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ড. আনুয়ারুল হক্ব খতীবী রহ. ও ড. বদরুদ্দোজা হাফিজাহুল্লাহ স্যারসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যারদের গবেষণা ও জ্ঞানচর্চা আমাকে কিছুটা টাচ করেছিল। ড. বদরুদ্দোজা স্যার একদিন ক্লাসে হোয়াইট বোর্ডে বাংলায় একটি বাক্য লিখলেন: আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে সালামের ভূমিকা। তিনি বললেন: এই বাক্যটি কে আরবীতে বলতে পারবে? আমি হাত তুললাম। স্যার আমাকে বলতে বললেন। বললাম:
. دور السلام في تكوين المجتمع المثاليّ
তিনি খুব খুশি হয়েছিলেন। জিজ্ঞেস করলেন, এর আগে কোথায় পড়েছি? মাদানী নেসাব ও দারুল মা'আরিফে পড়ার কথা বললাম। তিনি দোয়া করে দিলেন।
পরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশিদিন পড়িনি। সেখানকার সহশিক্ষা, যাতায়াতে দীর্ঘ সময় নষ্ট হওয়া ও বিভিন্ন কারণে ভালো লাগছিল না। আল্লাহ তা'আলা করুণা করে মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য কবূল করলেন। মদিনা ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন করে যা পেলাম- তাওহিদের প্রতি অধিক গুরুত্ব, সিরাতকে একাডেমিক সিস্টেমে পড়ার ব্যবস্থা, দাওয়াতের পদ্ধতি বিষয়ে বিস্তারিত পাঠ, ফিকহের তুলনামূলক পাঠ, হাদিসের সনদ বিশ্লেষণ অন্যান্য বিষয়ের সাথে আমাকে আলাদা ঋদ্ধতা দিয়েছে।
শিক্ষকদের শারাফত, উত্তম আচরণ, উদারতা, কথায় ও আচরণে অন্যরকম পবিত্রতা আমাকে ঋদ্ধ করেছে।
একজন ছাত্রের সাথে ছাত্র হওয়ার পরও কিভাবে সম্মান দিয়ে কথা বলতে হয় তার আলোকিত নমুনা মদীনার উসতাজগণ। শায়খ ড. আতিয়া জাহরানী রহ., শায়খ ড. মুহাম্মদ নাফে' হাফিজাহুল্লাহ, শায়খ মুহাম্মদ সালেহ হাফিজাহুল্লাহ সহ অসংখ্য সম্মানিত উসতাজ আমার জীবনে আলো ছড়িয়েছেন। ড. আতিয়য়াহ জাহরানী আমাকে একবার বললেন, তোমাদের দেশে একজন শায়খ সুলতান জওক্ব আছেন, তাঁকে চিন? আমি বললাম, শায়খ! উনি আমার উসতাজ। শুনে তিনি খুব খুশি হয়েছিলেন। উসতাজ ড. নাফে অন্ধ ছিলেন। কিন্তু পুরো কিতাব তার মুখস্থ। আমাকে বেশি এবারত পড়তে বলতেন। কয়েক লাইন পড়ার পর তিনি শরাহ করতেন, আবার পড়া শুরু করার জন্য বলতেন:
.واصل إضاءتك، يا مصباح
অর্থাৎ, তোমার আলো বিলিয়ে যাও, হে প্রদীপ। তখন আমি আবার এবারত পড়া শুরু করতাম।
মদীনার আলিমগণের কাছে সমালোচনার আদব শিখেছি। তাঁরা কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর সমালোচনার ক্ষেত্রে বলেন: "فيهم خير ولهم أخطاء"। অর্থাৎ, তাদের মধ্যে এই এই কল্যাণ ও ভাল গুণ আছে, তবে তাদের সংশোধনযোগ্য কিছু ভুলও আছে।
এককথায়, মদিনা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশের কওমি দেওবন্দি মাদরাসার প্রভাব আমার জীবনে ব্যাপকভাবে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে।
আমার জীবনের সকল উসতাজকে নিয়ে একসময় বিস্তারিত লিখব ইনশাআল্লাহ। এখানে মূলত আমার জীবনে কাদের প্রভাব রয়ে তার সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করছি।
বাংলাদেশে এসে কুস্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স করতে গিয়ে খোঁজে পেয়েছি আরেক 'জ্ঞানের দরবেশ' জাত গবেষক উসতাজকে। প্রফেসর ড. আব্দুর রহমান আনোয়ারী হাফিজাহুল্লাহ। কতবড় প্রফেসর অথচ জ্ঞান-গবেষণায় ছাত্রকে এগিয়ে দিতে শিশুর হাত ধরে পিতার এগিয়ে দেওয়ার মত আচরণ আমাকে বারবার কৃতজ্ঞতা আবদ্ধ করেছে।
এরপর দ্বিতীয়বার মাস্টার্স করেছি আইআইইউসির দাওয়াহ ডিপার্টমেন্টে। আগাগোড়া শিক্ষা ও শিক্ষার্থীবান্ধব উদার মানুষ উসতাজ ড. আমিনুল হক্ব হাফিজাহুল্লাহ। ছাত্রের প্রতি হিতাকাংখী ও কল্যানকামী উসতাজ আমার মাস্টার্সের থিসিসের সুপারভাইজার প্রফেসর ড. শাফী উদ্দীন মাদানী এখনও আমার খোঁজখবর রাখেন।
আমার উসতাজগণের বাহিরে সমকালীন যাদের চিন্তা আমাকে অনেকটা নিয়ন্ত্রণ করে: শায়খ আবুল হাসান আলী নদভী রহ., শায়খ মুহাম্মদ বিন সালেহ আল উসামীন রহ., আল্লামা ইউসুফ আল ক্বারজাবী রহ., আল্লামা মুফতী তাক্বী উসমানী হাফি., শায়খ উবায়দুর রহমান খান নদভী হাফি. ও মুফতী আব্দুল মালেক হাফি. প্রমুখ।
আমি মনে করি, বিভিন্ন ধারার শিক্ষা, সান্নিধ্য ও অধ্যয়ন আমাকে দিয়েছে মৌলিকত্বের উপর অটল থেকে উদারতা ও বৈচিত্র্যের সৌন্দর্য। সবাইকে ভালবেসে যাওয়া। কিন্তু বাস্তব জীবনে বিভিন্ন অভিজ্ঞতা কষ্ট দিয়েছে।
আলহামদুলিল্লাহ, কর্মজীবনে দারুল মা'আরিফে শিক্ষকতা করেছি সাড়ে পাঁচ বছর, আইআইইউসিতে আড়াই বছর এবং বর্তমানে জামিয়া আরাবিয়া জিরিতে আরবি ভাষা ও ইসলামি দাওয়াহ বিভাগের প্রধান হিসেবে ইলমের খেদমত করে যাচ্ছি।
আমি আমার ফেসবুক ফলোয়ার ভাই-বন্ধুদের নির্যাস কথাটা বলব: সত্যনিষ্ঠ মুত্তাকী জ্ঞানী আলেমদের আঁচল ধরে থাকবেন, তাদের ছাত্রত্ব গ্রহণ করার চেষ্টা করবেন, কখনো বেয়াদবি করবেন না, তার কোন আচরণ বা কথায় খটকা লাগলে তার কাছ থেকে ব্যাখ্যা জানার চেষ্টা করবেন অথবা নিরব থাকবেন। দলমতের পার্টিশন ছিন্ন করে 'কালিমাগো' সকল মুসলমানকে ভালোবাসবেন, কল্যাণকামনা করবেন। শত্রুর সাথেও ইনসাফ করবেন। আল্লাহ আমাদেরকে ক্ষমা করে দিন।
লেখক: প্রধান, আরবি ভাষা ও ইসলামি দাওয়াহ বিভাগ, জামিয়া আরাবিয়া জিরি মাদরাসা, চট্টগ্রাম
এসএকে/