সোমবার, ২৩ জুন ২০২৫ ।। ৯ আষাঢ় ১৪৩২ ।। ২৭ জিলহজ ১৪৪৬


ট্রাম্প এখন শান্তির বার্তাবাহক নন, যুদ্ধের দূত


নিউজ ডেস্ক

নিউজ ডেস্ক
শেয়ার
ছবি: সংগৃহীত

|| হামিদ মীর ||

এটি আইনের লঙ্ঘন নয় তো কী? মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষ থেকে ইরানে হামলার ঘোষণা আন্তর্জাতিক আইনের একটি স্পষ্ট লঙ্ঘন এবং বৈশ্বিক শান্তির জন্য সরাসরি হুমকি। বিশ্বে 'জঙ্গল আইনের' প্রয়োগের প্রচেষ্টা এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। ২১ জুন পাকিস্তান সরকার ট্রাম্পকে শান্তির নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত করেছে এবং ২২ জুন ট্রাম্প ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছেন। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ইরানের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগ আন্তর্জাতিক শান্তির জন্য সরাসরি হুমকি এবং তিনি জাতিসংঘের চার্টার ও আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছেন।

অন্যদিকে, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ইরানে হামলার পর ট্রাম্পকে অভিনন্দন জানিয়েছেন এবং ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের দৃঢ় সম্পর্কের প্রতি সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। এটি নেতানিয়াহুর একটি বড় কৃতিত্ব যে, তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে এই সংঘাতে জড়িত করেছেন।

ডোনাল্ড ট্রাম্প ১৯ জুন হোয়াইট হাউসে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনিরের সঙ্গে বৈঠকের পর ঘোষণা করেছিলেন যে, তিনি ইরান ও ইসরায়েলে যুদ্ধবিরতির জন্য দুই সপ্তাহ অপেক্ষা করবেন। এরপর ইস্তাম্বুলে ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে কূটনৈতিকভাবে সমস্যার সমাধান নিয়ে আলোচনা করা হয়। কিন্তু এই সম্মেলনের কয়েক ঘণ্টা পরই যুক্তরাষ্ট্র ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালায়। যদি ডোনাল্ড ট্রাম্প কয়েক দিন অপেক্ষা করতেন এবং দুই সপ্তাহ পর ইরানে হামলা করতেন, তাহলে হয়তো এতো প্রতিক্রিয়া হতো না। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প দুই দিনও অপেক্ষা করেননি। এখন ইসরায়েল ও ইরানের যুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের যুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইরান যুক্তরাষ্ট্রের হামলার কিছু সময় পরই ইসরায়েলে নতুন ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। জাতিসংঘের চার্টারের অধীনে ইরানকে আত্মরক্ষার অধিকার রয়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে যে, ইরান মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটিগুলোতে হামলা করতে পারে। 

তবে এই বাস্তবতায় কোনো সন্দেহ থাকা উচিত নয় যে, ইসরায়েলের সামরিক শক্তির ভ্রান্তি প্রকাশ পেয়েছে। ইসরায়েল একা ইরানের মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং এই ব্যর্থতা ঢাকার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে যুদ্ধে জড়ানো হয়েছে। ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ মাত্র ছয় দিন স্থায়ী হয়েছিল। এই যুদ্ধে ইসরায়েল পূর্ব জেরুজালেম, গাজা এবং গোলান মালভূমিসহ মিসরের গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলগুলো দখল করেছিল। ১৯৭৩ সালের রমজান মাসে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ শুরু হয় এবং ১৯ দিন স্থায়ী হয়, যেখানে মিসর কেবল তার কিছু অঞ্চলই পুনরুদ্ধার করেনি, বরং এই যুদ্ধে ইসরায়েলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ১৯৮২ সালে ইসরায়েল লেবানন দখল করে। এই যুদ্ধে ইসরায়েলকে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা ছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ইসরায়েলকে লেবানন থেকে ফিরে যেতে হয়। লেবানন থেকে ইসরায়েলের পশ্চাদপসারণে হিজবুল্লাহর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। হিজবুল্লাহর সমর্থন ছিল ইরানের। যারা হিজবুল্লাহকে ইরানের প্রতিস্থাপন বলে মনে করেন, তারা ইসরায়েলকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিস্থাপন বলার ক্ষেত্রে অনেকটা দ্বিধা করেন।

১৩ জুন ২০২৫ ইসরায়েল ইরানে হামলা চালালে প্রথম দিকে ইসরায়েলেরই সুবিধা ছিল, কারণ তারা ইরানের সামরিক নেতৃত্ব ও গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞানীদের তাদের বাড়িতে আক্রমণ করে হত্যা করেছিল। এই সব শহীদরা তাদের বাড়িতে শান্তিতে ঘুমাচ্ছিলেন, কারণ তারা মনে করছিলেন যে, ১৫ জুন মাসকটে ইরান ও আমেরিকার মধ্যে আলোচনা হবে, তাই ১৫ জুনের আগে ইসরায়েল কোনো হামলা করবে না। ইসরায়েল ১৫ জুনের আলোচনা অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে ইরানের নেতৃত্বকে লক্ষ্য করে হামলা চালিয়ে মনে করেছিল যে, ইরানে অভ্যুত্থান হবে এবং কয়েক দিনের মধ্যে সরকার পরিবর্তন হবে।

কিন্তু যখন ইরান ইসরায়েলের ওপর পাল্টা হামলা শুরু করল, তখন ইসরায়েলের সুবিধা দ্রুত পরাজয়ে পরিণত হলো। ইরানের ক্ষেপণাস্ত্রগুলো তেল আবিব ও হাইফাসহ ইসরায়েলের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোতে সফলভাবে আঘাত করে বিশ্বকে অবাক করে দেয়। হাজার হাজার ইসরায়েলি নাগরিক সাইপ্রাসের পথ ধরে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়, তখন নেতানিয়াহু ট্রাম্পকে সাহায্যের জন্য ডাকেন।
ট্রাম্পের এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ আসলে ইসরায়েলের পরাজয়ের ঘোষণা। ট্রাম্প বলেছেন যে, তিনি ইরানের পারমাণবিক ক্ষমতা ধ্বংস করে দিয়েছেন। যদি এটি সত্যি হয়, তাহলে ইসরায়েলকে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেওয়া উচিত, কারণ ইসরায়েল এই যুদ্ধ শুরু করেছিল ইরানের পারমাণবিক ক্ষমতা ধ্বংস করার জন্য। যদি ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি না করে এবং যুদ্ধ চলতে থাকে, তাহলে এই যুদ্ধ পুরো অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়বে।

এই যুদ্ধের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে আমেরিকার। আমেরিকার সামরিক শক্তি নিয়ে কেউ সন্দেহ করতে পারে না, কিন্তু ইতিহাস দেখায় যে, তাদের সমস্ত সামরিক শক্তি থাকার পরও আমেরিকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধে পরাজিত হয়েছে। কোথা থেকে শুরু করব এবং কোথায় শেষ করব? ১৯৫৫ সালে আমেরিকা ভিয়েতনামে একটি যুদ্ধ শুরু করেছিল। ২০ বছর ধরে এই যুদ্ধ চলেছিল। অবশেষে আমেরিকা পরাজিত হয়। ২০০১ সালে আমেরিকা আফগানিস্তানে তালেবান ও আল-কায়েদার বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেছিল। ২০ বছর পর আমেরিকা তালেবানের সঙ্গে একটি শান্তি চুক্তিতে সই করে এবং লজ্জিত হয়ে আফগানিস্তান থেকে পালিয়ে যায়।

আমার মনে আছে, যখন আমেরিকা অক্টোবর ২০০১ সালে আফগানিস্তানে হামলা করেছিল, তখন পাকিস্তান তাদের সেনাকে ঘাঁটি দিয়েছিল, কিন্তু সমস্ত বিমান শক্তির পরও আমেরিকা তালেবানকে পরাজিত করতে পারেনি। তালেবান সেই যুদ্ধকে দীর্ঘ করে পাল্টা আঘাত হানে। তালেবানের কাছে ক্ষেপণাস্ত্র ছিল না। ইরানের কাছে ক্ষেপণাস্ত্রও রয়েছে এবং একটি শক্তিশালী নৌবাহিনীও রয়েছে, যা হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে বিশ্ব অর্থনীতির জন্য সংকট সৃষ্টি করতে পারে।

অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকে পাকিস্তান আমেরিকাকে ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ থেকে বিরত রাখতে সর্বাত্মক চেষ্টা করেছে, কিন্তু ট্রাম্প তা মানেননি। আমি আগে বলেছিলাম যে, ট্রাম্পের ব্যক্তিত্ব ও চরিত্রকে শুধু ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ থামানোর প্রেক্ষাপটে দেখবেন না। তিনি গাজায় ফিলিস্তিনিদের গণহত্যার ওপর শুধু চোখ বন্ধ করেননি, বরং ফিলিস্তিনিদের গাজা থেকে বিতাড়িত করার প্রস্তাবও দিয়েছিলেন। এখন তিনি ইরানে হামলা করেছেন এবং বিশ্ব শান্তিকে হুমকির মুখে ফেলেছেন। তিনি শান্তির নয়, যুদ্ধের বার্তাবাহক হয়ে উঠেছেন। তার রাজনৈতিক ও নৈতিক মর্যাদা মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে এবং এখন তিনি কাশ্মীর সমস্যার সমাধানে মধ্যস্থতার ভূমিকা পালন করারও যোগ্য নন।

পাকিস্তানকে ট্রাম্প থেকে কোনো ভালো আশা করা উচিত নয় এবং নিজেদের অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলো ঠিক করার প্রয়োজন। ট্রাম্প যে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘনকে উৎসাহিত করেছেন, তা ভারতকে উৎসাহিত করবে। পাকিস্তানকে এই অঞ্চলে একটি নতুন যুদ্ধ থেকে বাঁচাতে হবে এবং ভারতীয় ষড়যন্ত্রের মোকাবিলা করতে হবে। সোজা কথা, নেতানিয়াহুর বন্ধু ও মিত্র পাকিস্তানের বন্ধু হতে পারে না। ট্রাম্প থেকে কোনো ভালো আশা না করে, নিজেদের পারমাণবিক শক্তি রক্ষা করুন।

 [হামিদ মীর পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক। উর্দু দৈনিক জং থেকে লেখাটি অনুবাদ করেছেন: সাইমুম রিদা]

এসএকে/


সম্পর্কিত খবর

সর্বশেষ সংবাদ