।। ড. ইব্রাহীম খলিল।।
চালহীন-বেড়াহীন গ্রামের মাদরাসায় আমার লেখাপড়া শুরু। সেখানে হুজুররা এমপিওর সামান্য বেতন পেতেন তিন মাস পরপর। সেই টাকা নিয়ে তাদের কেউই ঘরে ফিরতে পারতেন না। দোকানে জমে যাওয়া বাকি পরিশোধ করতে করতেই সব শেষ হয়ে যেতো।
থানা শহরের আলিম (পরে ফাজিল, বর্তমানে কামিল) মাদরাসার প্রিন্সিপ্যাল ছিলেন আব্বা। তাকেও দেখেছি একইভাবে সংসার সামলাতে। বর্গা দেওয়া জমি থেকে পাওয়া ফসল অবশ্য আব্বাকে কিছুটা নিশ্চিন্ত রাখতো, খাওয়া তো আর বন্ধ হচ্ছে না!
আব্বার মাদরাসায় ইবতিদায়ি সেকশনে কয়েকজন শিক্ষক ছিলেন। দাখিল সেকশনে কয়েকজন। পর্যায়ক্রমে আলিম ও ফাজিলে। সেটা অবশ্য বেতনের খাতায়। তা না হলে প্রয়োজনে সবাই যেতেন সব ক্লাসে। এমনকি আব্বাও মাঝে মাঝে ইবতিদায়ি প্রথম শ্রেণিতে যেতেন। কথা বলতেন। মজা করতেন।
আব্বা মসজিদের খতিব ছিলেন। ঈদগাহেরও খতিব ছিলেন। খুব কাছে থেকে মসজিদের খাদেম, ঈদগাহের খাদেম, মাদরাসার বিভিন্ন স্তরের শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের জীবন আমি দেখেছি। অভাবের সাথে প্রবল যুদ্ধ করেও কীভাবে হাসিমুখে তারা দিন পার করেছেন। অভিযোগহীন, শোকরপূর্ণ, শান্তিময়। এভাবেই জীবন উৎসর্গ করেছেন দীনি ইলমদের খেদমতে।
আশেপাশে হাফেজি মাদরাসা ছিল। পরবর্তীতে পরিচিত হয়েছি কওমি মাদরাসার সাথে। সর্বত্রই অধিকাংশ শিক্ষকের দারিদ্র্যপীড়িত সংগ্রামী কিন্তু অভিযোগহীন স্বস্তিকর জীবনযাপন আমি দেখেছি। ‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি’ বলে তারা স্বচ্ছলতাহীন, তৃপ্তিহীন, মাঝেমাঝে প্রয়োজনীয় চিকিৎসাহীন থেকেও ভালো থেকেছেন।
আমার দেখা এ সকল উস্তাতদের মধ্যে হাতেগোনা দুই একজন জীবন সায়াহ্নে এসে জমি বিক্রি করে অথবা পেনশনের সামান্য টাকার সাথে নানাভাবে আরও কিছু টাকা জমিয়ে হজ করেছেন। অধিকাংশই উমরাহ কিংবা হজ কোনোকিছুই করতে পারেননি। অথচ কালো গেলাফে ঢাকা কারুকর্যময় আল্লাহর ঘর আর সবুজ গম্বুজের ছায়ায় ঘুমিয়ে থাকা মহাবিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রেমী পুরুষের রওজা মুবারাক স্পর্শ করার জন্য কী আবেগ যে তাদের ছিল! কী অভূতপূর্ব, কী অনন্য ছিল সেই আবেগ। তারা তাদের আকাঙ্ক্ষার কথা বলতেন আর দরদর করে প্রেমাশ্রুতে সিক্ত হতো শুভ্র এলোমেলো দাড়ি।
এখনও যারা মসজিদে, মক্তবে, হাফেজি, কওমি, আলিয়া মাদরাসায় খেদমত করছেন, তাদের অধিকাংশ একইরকম আবেগ লালন করেন বুকের গহীনে, একইভাবে প্রেমাশ্রুতে ভিজে যায় তাদের কপোল, কিন্তু নসিব হয় না নবীজির রওজা মুবারক জিয়ারাতের ভাগ্য, কালো গেলাফের স্পর্শে বাস্পরুদ্ধ কণ্ঠে ঘোষণা করতে পারেন না, ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক!’
আপনার আমার চারপাশে এমন অসংখ্য মসজিদ-মাদরাসার খাদেম, কুরআন-কিতাবের খাদেম রয়েছেন। আর্থিক অসঙ্গতির জন্য বেঁচে থাকার সংগ্রামেই যাদের নাভিশ্বাস উঠে গেছে, কিন্তু বুকের ভেতর সঙ্গোপনে লালন করছেন জীবনের চেয়ে প্রিয়তম সুরভিত স্বপ্ন মাতাফে ঘুরবেন, সাঈ করবেন, সবুজ গম্বুজ জড়িয়ে ধরে নিকট থেকে বলবেন, আসসালাতু আসসালামু আলাইয়াকা ইয়া রাসূলাল্লাহ!
আমরা অনেকেই অনেক অনেক লক্ষ টাকা ব্যয়ে অনলাইনে-অফলাইনে প্রসিদ্ধ কিছু সংখ্যক উলামাকে তো নিয়মিত হজ বা উমরাহে পাঠাচ্ছি। এবার একটু ভিন্ন চিন্তা হোক।
ব্যয় করার জন্য প্রাক্কলিত অর্থের পরিমাণ ঠিকই থাকুক কেবল খুঁজে খুঁজে এমন কিছু লোকদেরকে বের করি, যারা একনিষ্ঠ মনে কওমি বা আলিয়া মাদরাসা কিংবা মসজিদে দীনের খেদমতে নিয়োজিত রয়েছেন, গোপনে অশ্রু ঝরাচ্ছেন কাবা তাওয়াফ ও রওজা জিয়ারাতের প্রিয়তম আকাঙ্ক্ষায়। এরপর আমাদের প্রাক্কলিত অর্থে একজনকে হজ বা উমরায় প্রেরণের পরিবর্তে তাদের কয়েকজনকে হজ বা উমরাহে প্রেরণ করি।
বিশ্বাস করুন, অক্ষম আবেগে অশ্রু ঝরানো এমন কিছু আল্লাহর বান্দাহ আর নবীর উম্মতকে যদি হেজাজের কাফেলায় শামিল করতে পারেন, তাদের প্রেমাবেগ ও ভক্তিতে যেভাবে মাতাফ স্নাত হবে, যে ঢেউ তুলবে ইশকে ইলাহি ও ইশকে রাসূলের মহাসমুদ্রে, পৃথিবীর কোন সুনামি তেমন ঢেউ কখনও তৈরি করতে পারেনি, পারবেও না। আর এই ঢেউ সরাসরি পৌঁছে যাবে আরশে আজীমে, রওজা মুবারাকে। এমন আবেগ ও অশ্রু অবশ্যই কবূল হবে ইনশাআল্লাহ।
অল্প কিছুদিন পরেই উমরাহ মৌসুম শুরু হবে। প্রাক-হজ নিবন্ধনও শুরু হয়েছে। আসুন, এমন আল্লাহ পাগল, নবীপ্রেমিক অসমর্থ লোকদের খুঁজে খুঁজে বের করি আর তাদের চিরআরাধ্য স্বপ্ন সফল করে দিয়ে নিজেরা মাকবুল হজ ও উমরাহর সওয়াব নিশ্চিত করি। অনেক লক্ষ টাকা ব্যয়ে প্রসিদ্ধতম কাউকে কাউকে পাঠিয়ে এমন নিশ্চয়তা আমরা কোনোভাবেই পাবো না।
আসুন, যাদের সামর্থ আছে তারা নতুন চিন্তা করি, নতনুভাবে সিদ্ধান্ত নেই এবং খুঁজতে শুরু করি।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা তার বান্দাদের কোনো আন্তরিক চেষ্টাকেই তো ব্যর্থ করেন না। ইনশাআল্লাহ, আমাদের চেষ্টাও ব্যর্থ হবে না।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়; বহুগ্রন্থ প্রণেতা
এনএইচ/